বিশ্বজিৎ থেকে সামিউল, এরপর…
২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের অবরোধের মধ্যে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে ছাত্রলীগের একটি মিছিল থেকে জামায়াত-শিবির সন্দেহে বিশ্বজিৎকে ধাওয়া করা হয়। প্রাণ বাঁচাতে বিশ্বজিৎ একটি মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় আশ্রয় নিলেও হায়েনারা সেখানেও ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রকাশ্যে কোপানো ও পেটানো শুরু হয়।
সেখান থেকে পালিয়ে মারাত্মক জখম অবস্থায় বিশ্বজিৎ বের হয়ে রাস্তা দিয়ে দৌড় দেয়। পিছু পিছু অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে হায়েনার মতো পুনরায় ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয় বিশ্বজিৎকে। রক্তাক্ত অবস্থায় বিশ্বজিৎ রাস্তায় পড়ে থাকলেও কেউ এগিয়ে আসেননি। পরে এক রিকশাচালক স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। জেগে ওঠে বিশ্ববিবেক। জাগ্রহ হয়ে ওঠে মানুষের হৃদয়। বিশ্বজিতের খুনিদের গ্রেফতার করে অবিলম্বে বিচারের আওতায় আনার দাবি ওঠে সব মহলে। জাতি সেদিন দেখেছে হত্যার ভয়াবহ বিভৎষতা।
ঘটনার দিন অজ্ঞাতনামা ২৫ জনকে আসামি করে সূত্রাপুর থানায় মামলা দায়ের করেন এসআই জালাল আহমেদ। এরপর মামলাটি থানা থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা অফিসে হস্তান্তর করা হয়। মাত্র তিন মাসের মধ্যেই ২০১৩ সালের ৫ মার্চ ২১ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক তাজুল ইসলাম। দীর্ঘ দিন আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের বিচার কাজ শেষ না হওয়ায় নতুন করে সামিউল আলম রাজন হত্যা প্রকাশ্যে দেখল জাতি।
ঘটনার বিবরণ থেকে জানা যায়, ‘অ ভাই আমারে এক গললাস (গ্লাস) পানি দেওরেবা, আমার গলা হুকাই গেছে (শুকিয়ে গেছে), আর আমারে মারিও না, আমার আত-পাও ভাংগি গেছে (হাত-পা), সামিউলের এসব কথা বলার পরও মন গলেনি পাষণ্ড খুনিদের।
গত ৮ জুলাই সিলেট-সুনামঞ্জ রোডের কুমারগাঁও বাসস্টেশন এলাকার বড়গাঁওস্থ সুন্দর আলী মার্কেটের একটি ওয়ার্কশপের সামনে বারান্দার খুঁটিতে বেঁধে রেখে নির্যাতনে নিহত রাজনের এমন আহাজারিতে আশপাশের অনেকেরই চোখের পানি গড়িয়ে পড়লেও হৃদয়ে এতটুকু দয়ার উদ্রেক হয়নি মানুষরূপী কয়েকটি নরপশুর।
ওই দিন সকাল ৭টার দিকে শিশুটিকে এমন নির্যাতন করে লাশ গুম করা হয়। রাত ১১টার দিকে একটি মাইক্রোবাস থেকে সামিউলের লাশ উদ্ধার করা হয়। খবর পেয়ে বুধবার রাত ১১টায় থানায় গিয়ে পরিবারের সদস্যরা লাশ শনাক্ত করেন।
নিহত সামিউল কুমারগাঁও বাসস্টেশন সংলগ্ন সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের বাদেআলী গ্রামের মাইক্রোবাস চালক শেখ আজিজুর রহমানের ছেলে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক, ইউটিউবে সামিউলকে নির্যাতনের এমন দৃশ্য প্রচারের পর সিলেটে নগরীতে চলছে তোলপাড়। বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠছে, ঘাতকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির। পুলিশের কাছে জব্দকৃত শিশু সামিউলের নির্যাতনের ২৮ মিনিটের ভিডিও ফুটেজে করুণ দৃশ্য দেখা গেছে।
ভিডিওটি এতটাই নির্মম আর পৈশাচিক, সিনেমার ভিলেনরাও এই নিপীড়ন দেখে আঁতকে উঠবে। কিন্তু নিষ্ঠুর নির্যাতনকারীদের মনে সামিউলের জন্য এতটুকুও মায়া হয়নি। তারা তাকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাকে অজ্ঞাত স্থানে ফেলে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু জনতা দেখে ফেলায় ঘাতকদের গাড়িসহ আটক করে।
ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, সামিউলকে নির্যাতন করছে আর ঘাতকরা বলেছে, ‘তরে এমন শিক্ষা দিমু, হালার হালা (শালার শালা) জীবনে আর চুরি খরতে (করতে) ফারতে (পাড়বে) নায় (না)’। ঠিকই জীবন দিয়ে চুরির অপবাদের মূল্য দিয়েছে শিশুটি। কণ্ঠস্বর ও চিত্র থেকে অনুমেয় ৫/৬ জন ঘাতক মিলে এই শিশুটিকে নির্যাতন করে।
লোমহর্ষক এই নির্যাতনের ভিডিওচিত্র ফেসবুক-ইউটিউবের মাধ্যমে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। গোপন কারো তোলা ভিডিও নয়, খোদ নির্যাতনকারীরাই সেটি পরিকল্পিতভাবে তুলে এবং উল্লাস করতে করতে তার ভিডিওধারণ করেছে। ‘লাইভ নির্যাতনের’এই ভিডিওটিও তারা আবার নিজেরাই ফেসবুকে আপলোড করেছে।
নির্যাতনকারীদের যে সঙ্গী ভিডিও ধারণ করছিল, তাকে উদ্দেশ্য করে নির্যাতনকারীরা জানতে চায়, ঠিকমতো ভিডিও ধারণ হচ্ছে কি না। ‘ফেসবুকে ছাড়ি দিছি, অখন সারা দুনিয়ার মানুষ দেখব,’জবাব দেয় ভিডিওধারণকারী।
সামিউলকে তারা নির্যাতন করে হত্যা করেছে চুরির অপবাদে। ফিল্মি স্টাইলে চলা ওই নির্যাতনের সময় শিশুটির স্পর্শকাতর অঙ্গে বারবার খোচানো হয়েছে। রোলার দিয়ে সেখানে অশ্লীল ইঙ্গিতসূচক ঘা ও আঘাত করা হয়েছে। এই সময় নির্যাতনস্থলের বন্ধ মার্কেটের একটি পিলারের সঙ্গে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছিল। বাঁধন খুলে মাটিতে ফেলেও তাকে নানা ‘সিস্টমে’নিপীড়ন করতে দেখা গেছে।
টানা ২৮ মিনিটের ওই ভিডিওচিত্রের প্রতি মুহূর্তের নির্যাতনের নানা ’সিস্টম’ পরিলক্ষিত হয়েছে। নির্যাতন সইতে না পেরে শিশুটির আর্তচিৎকারের সময় সিনেমার ভিলেনের মতো অট্টহাসিতে ফেটে উঠে ঘাতকরা। আঘাত করতে করতে তারা ঘেমে উঠেছে। সেগুলো সয়ে যাওয়া শিশুটি যখন ‘পানি’খাওয়ার জন্যে তাদের বারবার অনুনয় করেছে, তখন নির্যাতনকারীরা বলছে, ‘ঘাম’ খা।
কয়েক মিনিটের জন্য সামিউলকে হাতের বাঁধন খুলে রশি লাগিয়ে হাঁটতে দেওয়া হয়। ঘাতকরা ভেবেছিল, এত নির্যাতনের পর তার আর হাঁটার শক্তি নেই। সে মাটিতে ধপ করে পড়ে যাবে। কিন্তু ভয়ে হাঁটতে থাকা শিশুটিকে উদ্দেশ করে তখন তারা বলে, ‘আড়গোড় (হাড়গোড়) দেখি এখনো ঠিক আছে, ইগুরে (ওকে) আরও মারো’।
এরপর সামিউলের বাঁহাত খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখে আরেক দফা পেটানো হয়। এভাবে দফায় দফায় শিশুটির নখে, মাথা, পেট ও ঊরুসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে রোল দিয়ে আঘাত করা হয়। এক সময় বাঁহাত ও ডানপা ধরে মুচড়াতেও দেখা যায়।
শেষ দিকে সামিউল যখন লুটিয়ে পড়ে তখন নির্যাতনকারীদের একজন সঙ্গীদের কাছে জানতে চান, ‘কিতা করতাম?’ অপর নির্যাতনকারী বলেন, ‘মামায় যে কইছন, ওই কাম করি ছাড়ি দে!’
খুন হওয়া শিশু সামিউলের পিতা আজিজুর জানান, তিনি যেদিন ভাড়ায় মাইক্রোবাস চালাতে পারেন না, সেদিন সংসার খরচ চালাতে সবজি বিক্রি করতে বের হয় সামিউল।
মা লুবনা আক্তার বলেন, ‘ওই দিন (৮ জুলাই) সামিউলের বাবা গাড়িতে (ভাড়ার ট্রিপে) ছিলেন বলে বাড়ি ফেরেননি। ভোরে টুকেরবাজার থেকে সবজি নিয়ে বিক্রির জন্য সামিউল বের হয়েছিল। সারা দিন ছেলের খোঁজ পাননি তারা। রাতে থানায় গিয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার সময় এক কিশোরের লাশ পাওয়ার সূত্র ধরে সামিউলকে শনাক্ত করা হয়।’
লুবনা বলেন, ‘আমার পুয়া (ছেলে) চোর না, এই কথা সারা এলাকার মানুষ জানে। প্রবাসী অখলতের চোর ধরার সখ পূরণ করতে গিয়া জীবন দিছে! আমি এর উচিৎ বিচার চাই।’
এদিকে, নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই জালালাবাদ থানায় চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। হত্যার প্রতিবাদে ফুঁসে উঠছেন এলাকাবাসীও। হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবিতে স্থানীয় এলাকাবাসী কুমারগাঁও বাইপাস এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ করে।
এ ঘটনায় রাজনের পিতা বাদী হয়ে জালালাবাদ থানায় একটি হত্যা মামলা (নং-২৯৭/১৫) দায়ের করেন। ওই মামলায় আসামি করা হয়েছে আটক মুহিত আলমসহ আরো কয়েকজনকে।
জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আক্তার হোসেন বলেন, ‘নির্যাতন ভিডিওচিত্রে ধারণ করার বিষয়টি শুনেছি এবং এটি দেখেছেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথাও হয়েছে।’
ওসি জানান, ঘটনার সঙ্গে মামলার আসামি চারজনই সম্পৃক্ত বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভিডিওচিত্র ধারণসহ পুরো ঘটনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মুহিতকে আদালতে সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হলে আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
ঘটনা যাই ঘটুক বিশ্লেষকরা বলছেন, ওই দিন প্রত্যক্ষদর্শীরা যদি সামিউলকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসতেন, তবে অন্তত তার প্রাণ ঝরতো না। বিশ্বজিতের বেলায় যেভাবে কেউ এগিয়ে আসেনি সামিউলের বেলাতেও তাই। দুটি ঘটনা প্রায় একই ধাচের। বিশ্বজিৎ গেছে, সামিউল গেল। এরপর কে? এই প্রশ্ন এখন বিবেকবান মানুষের কাছে।
কেন এসব ঘটনা? এর জন্য দায়ী কারা? জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার সানোয়ার হোসেন বলেন, ‘দুটি ঘটনা প্রায় একই। উভয় ঘটনাই অনেকগুলো মানুষের সামনে ঘটেছে। কিন্তু সেখানে কোনো বিবেকবান ও প্রতিবাদী মানুষ না থাকায় দুটি প্রাণ ঝরে গেছে। যতদিন না অব্দি সাহসী, প্রতিবাদী ও বিবেকবান প্রত্যক্ষদর্শী তৈরি হবে, তত দিন পর্যন্ত এ রকম ঘটনা ঘটতেই থাকবে।’ এ ঘটনায় জড়িতদের সঠিক বিচারও দাবি করেন তিনি।