শোলাকিয়ায় বৃহত্তম ঈদজামাত অনুষ্ঠিত
দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায়। আজ সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হয় এ জামাত। এরপর দীর্ঘ মোনাজাত। মোনাজাতে দেশ জাতি ও মুসলিম উম্মাহ’র শান্তি কামনা করা হয়। দেশের সর্ববৃহৎ এ জামাতে অংশ নিতে ভোর থেকেই মুসল্লিদের ঢল নামে। সকাল শুরু হওয়ার আগেই কোলাহলে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো কিশোরগঞ্জ। শহরের সবগুলো প্রবেশ পথ দিয়ে এগুতে থাকে মুসল্লিদের মিছিল। সবার উদ্দেশ্য শোলাকিয়া। এক সময় জেলা শহরের পূর্বপ্রান্তে নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত শোলাকিয়ার মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। ঈদগাহমুখি সকল সড়ক মুসল্লিদের দখলে চলে যাওয়ায় কয়েক ঘণ্টার জন্য কিশোরগঞ্জ শহরের সব সড়কে যান চলাচল বন্ধ ছিলো।
এবারের ঈদুল ফিতরের জামাতে ৩ লাখের মতো মুসল্লি অংশ নেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। মানুষের ভিড়ে জনসমুদ্রে হয় শোলাকিয়া ময়দান। আগত মুসল্লিদের অনেকে মাঠে জায়গা না পেয়ে পার্শ্ববতী রাস্তা, তিনপাশের ফাঁকা জায়গা, নদীর পাড় ও বাড়ীর ছাদে জায়গা করে নিয়ে জামাতে শরীক হন। গত কয়েক দিন টানা বৃষ্টির পর আজ ঈদের দিন সকাল থেকেই ছিল আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। তবে শেষ পর্যন্ত রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়ায় মুসল্লিরা দেশের সর্ববৃহৎ এ ঈদ জামাতে নামাজ আদায় করেন। জামাতে ইমামতি করেন মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। জামাতকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিলো তিন স্তরের। সহস্রাধিক পুলিশ, আর্মড পুলিশ ও র্যাব সদস্যের কঠোর নিরাপত্তা ও নজরদারিতে শন্তিপূর্ণভাবে নামাজ শেষ হয়। মাঠের চারপাশে ছিলো নিরাপত্তা চৌকি। পুরো এলাকায় সিসি ক্যামেরা বসানো ছাড়াও মাঠের ২৮টি প্রবেশ পথে মেটালডিটেক্টর দিয়ে মুসল্লিদের দেহ তল্লশি করা হয়। নামাজ শেষে দেশ-জাতি ও মুসলিম উম্মাহর জন্য মঙ্গল কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়।
জামাতে জেলা পরিষদের প্রশাসক অ্যাডভোকেট মো. জিল্লুর রহমান, জেলা প্রশাসক জিএসএম জাফর উল্লাহ, পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন খানসহ জেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকমীসহ জাতীয় ও স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ অংশ নেন। ৪৫ বছর ধরে এ মাঠে নামাজ আদায় করছেন ময়মনসিংহের ভালুকার কাসর গ্রামের আখতার হোসেন মণ্ডল (১০৯)। এ ধরণের অসংখ্য লোকের খোঁজ পাওয়া গেছে যারা দীর্ঘদিন ধরে এখানে নামাজ পড়তে আসেন।
মাঠের সুনাম ও নানা জনশ্রুতির কারণে ঈদের কয়েক দিন পূর্ব থেকেই কিশোরগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চল ও সারাদেশের বিভিন্ন জেলা তথা ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, গাজীপুর, নরসিংদী, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, জামালপুর, খাগড়াছড়ি, শেরপুর, যশোর, খুলনা ও চট্রগ্রামসহ বিভিন্ন জেলা থেকে শোলাকিয়ায় মুসল্লিদের সমাগম ঘটে। এবারও বিভিন্ন জেলা থেকে মুসল্লিরা আসেন। এদের অনেকেই ওঠেছিলেন হোটেলে, কেউবা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। আবার অনেকেই কোথাও জায়গা না পেয়ে রাত কাটিয়েছেন শোলাকিয়া মাঠের খোলা আকাশের নিচে।
উল্লেখ্য, কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের পূর্বপ্রান্তে নরসুন্দা নদীর তীর ঘেঁষে অবস্থিত প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী এ শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে ১৭৫০ সাল থেকে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সে হিসাব অনুসারে শোলাকিয়া ঈদগাহের বয়স ২শ’ ৬৬ বছর। প্রতিষ্ঠার ৭৮ বছর পর ১৮২৮ সালে প্রথম বড় জামাতে এই মাঠে একসঙ্গে ১ লাখ ২৫ হাজার অর্থাৎ সোয়ালাখ মুসল্লি ঈদের নামাজ আদায় করেন। এই সোয়ালাখ থেকে এ মাঠের নাম হয় ‘সোয়ালাখিয়া’, যা উচ্চারণ বিবর্তনে হয়েছে শোলাকিয়া। স্থানীয় হয়বতনগর সাহেব বাড়ির ঊর্ধ্বতন পুরুষ শাহ সুফি সৈয়দ আহমদ (র:) সে জামাতে ইমামতি করেন।
এ সংক্রান্ত নানা তথ্য পর্যালোচনা করে জানা গেছে, শাহ সুফি সৈয়দ আহমদ (র.) এর পূর্বপুরুষগণ সুদূর মক্কা শরিফ থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে আগমন করে বর্তমান ভারতের বর্ধমান জেলার টেংগাপাড়ায় বসবাস শুরু করেন। সৈয়দ আহমদ (র.) এর পিতা সৈয়দ ইবরাহিম (র.) উত্তর কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামী শিক্ষা প্রচার-প্রসার ও দাওয়াতের কাজ করতে গিয়ে কিশোরগঞ্জ শহর থেকে সাত মাইল দূরবর্তী কান্দাইল গ্রামে পদার্পণ করেন। পরবর্তীতে সেখানে স্থানীয় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে বিবাহ করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। কিন্তু সাংসারিক জীবনকে তিনি আবদ্ধজীবন মনে করে আল্লাহর বাণী প্রচারের তাগিদে বেরিয়ে পড়েন। একপর্যায়ে হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে তাবলীগ জামাতসহ মক্কা শরিফে চলে যান এবং সেখানেই ইন্তিকাল করেন। এদিকে মরহুম সৈয়দ ইবরাহিম (র.) এর বাড়িতে রেখে যাওয়া গর্ভবতী স্ত্রীর এক পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। স্বামীর পূর্ব নির্দেশ মোতাবেক পুত্রের নামকরণ ও পরবর্তী সময়ে বয়ঃপ্রাপ্ত হলে ১২ বছর বয়সে শিক্ষা-দীক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ঢাকার আজিমপুর দায়রা শরিফে প্রেরণ করা হয়। বালকপুত্র সৈয়দ আহমদ সেখানে ২৪ বছর অবস্থান করে শিক্ষা-দীক্ষায় পরিপক্ক জ্ঞান লাভের পর পীরের নির্দেশে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় চলে আসেন। সেখানে শহীদ ময়েজ উদ্দিন মজনু (র.) এর মাজারের পাশে একটি ঘর তৈরি করে ইবাদত-বন্দেগীসহ ইসলামের বাণী প্রচারে মনোনিবেশ করেন। ক্রমে সৈয়দ আহমদ (র.)-এর সুনাম ও সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে দলে দলে লোকজন তার কাছে এসে দ্বীনি শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকে। এ সময় ঈশা খাঁ’র বংশধরগণ জঙ্গলবাড়ি ও হয়বতনগর এলাকার জমিদারদ্বয় সৈয়দ আহমদ (র.) কে শ্রদ্ধার আসনে স্থান দেন এবং তার সামগ্রিক দ্বীনি দাওয়াতী কাজের সহযোগিতা করেন। এ সময় সে এলাকায় কোন মসজিদ না থাকায় ১৮২৭ সালে সৈয়দ আহমদ (র.) বাড়ি সংলগ্ন জায়গায় একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। মসজিদ প্রতিষ্ঠার পর পরই তিনি ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য ঈদগাহ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তিনি তার ক্রয়কৃত তালুক সম্পত্তিতে ঈদগাহ মাঠ প্রতিষ্ঠা করার মনস্থির করেন এবং এ ব্যাপারে জঙ্গলবাড়ি ও হয়বতনগরের জমিদারদ্বয়কে সহায়তা করার অনুরোধ জানিয়ে আসন্ন ঈদুল ফিতরের প্রথম জামাতে শরীক হওয়ার দাওয়াত করেন। জমিদারদ্বয় দাওয়াত কবুল করেন এবং এই অঞ্চলের আপামর জনসাধারণের অংশগ্রহণে শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে ১৮২৮ সালের ঈদ-উল-ফিতরের ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। শাহ সুফি সৈয়দ আহমদ (র.)-এর ইমামতিতে অনুষ্ঠিত হয় ঈদের প্রথম জামাত।
বাংলার বারো ভূঁইয়ার অন্যতম ঈশা খাঁ’র ৬ষ্ঠ বংশধর হয়বতনগরের জমিদার দেওয়ান মান্নান দাঁদ খান তার মায়ের অসিয়াত মোতাবেক ১৯৫০ সালে শোলাকিয়া ঈদগাহের জন্য ৪.৩৫ একর জমি ওয়াক্ফ করেন। সেই ওয়াক্ফ দলিলে উল্লেখ রয়েছে, ১৭৫০ সাল থেকে এ মাঠে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিশোরগঞ্জ মৌজার এ মাঠের মূল আয়তন বর্তমানে ৬.৬১ একর।