৮০তে পা দিলেন আল মাহমুদ
“শতাব্দীর সূর্যের শেষ অস্তগমন মুহূর্তের আমি এক নিরাসক্ত সাক্ষী।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আমি কৌতুহলহীন পরম দ্রষ্টাদের একজন।
আমি কবি।”
(আল মাহমুদ, আমি, দূরগামী : শতাব্দীর সাক্ষী: ১৪০০ বাংলা)
বাংলা সাহিত্যের গর্ব আল মাহমুদ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌড়াইল গ্রামের মুল্লা বাড়ির আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যে অনন্য সংযোজিত একটি নাম। কবি হিসেবে একটি উজ্জ্বল তারকা। সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতে তার স্বতত বিচরণ। যেখানেই হাত দিয়েছেন সুনামের সাথে খ্যাতি জুড়েছে তাতে। তিনিও উত্তরত্তোর সেই খ্যাতির মর্যাদা রেখেছেন। তিনি বিরামহীনভাবে তার পদচারণা অব্যাহত রেখেছেন। ফলে সবমাত্রায় তিনি সফলতা পেয়েছেন। কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক কিংবা সম্পাদক হিসেবে তার সার্থক বিচরণ স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। সব কিছুর মধ্যে আমরা তাকে দেখি। কবির তকমা তার নামের সাথে একাকার হয়ে গেছে।
কবিতার জন্য তাড়া খাওয়া আল মাহমুদকে পুলিশ হন্য হয়ে খুঁজছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া ভাষা আন্দোলন কমিটি’র একটি লিফলেটে তার চার লাইনের একটি কবিতা ছাপা হয়েছিল। তাতে তাকে পালিয়ে যেতে হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে। সেই পলায়ন যে বাংলা সাহিত্যের অমর গহ্বরে ডুকে যাবে, স্থায়ী মর্যাদার আসনে তাকে অধীষ্ঠিত করবে তা কেউ কি সেদিন কল্পনা করতে পেরেছিল। সেই মানুষটিই তার পথ চলাকে সার্থক করেছেন। নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেকে মেলে ধরেছেন। তাই আজ তিনি হয়েছেন কবিতার সম্পদ। বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।
১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌড়াইল গ্রামের মুল্লা বাড়ির ব্যবসায়ী ও সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে কবি মীর আব্দুস শুকুর আল মাহমুদ জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তার এই দীর্ঘ নাম আল মাহমুদেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। আজ আল মাহমুদ বলতে সেই কালের কলস, লোক-লোকান্তর কিংবা সোনালি কাবিন আর কাবিলের বোন, উপমাহদেশ এর আল মাহমুদকেই সবাই এক নামে চেনে।
কবিতার শাখা-প্রশাখায় যার বিচরণ, যিনি কবিতার পড়তে পড়তে বসত করেন প্রতিটি সময়, তিনি তো কবিতাকেই ভালোবাসবেন। কবিতা, কবিতার শব্দ বহমান নদীর মতো করেই তার হাতে ধরা দেবে। মানুষ, মাটির রূপ-গন্ধ তাকে সৌরভ ছড়াবে আর তিনি সেই সৌরভ থেকে সবটুকু নিংড়ে নেবেন নিজের করে এটাই তো স্বাভাবিক। শব্দ সে জন্যই তার কবিতার চিন্তার সাথে তাল মিলিয়ে চলে। তার ভাষা হয় কবিতায় প্রাঞ্জল, স্বতঃস্ফূর্ত, গতিময়।
ত্যাগ আর প্রচেষ্টায় যে কবি নিজেকে আত্মনিয়োজিত করেছেন কবিতায়, ঘর ছেড়ে বের হয়েছেন কবিতার জন্য তাকে আজ গর্বিত কবি মনে করা হয়। জীবনের সময়ে সাথে তালমিলিয়ে চলার পথে তিনি তার প্রতি মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা দেখছেন। বলা যায়, কবিতা তাকে যেভাবে আপন করে নিয়েছে মানুষ, পাঠকও তাকে সেভাবে আপন করে নিয়েছে। দুয়ের সমন্বয়ে তিনি আজ এমন এক জায়গায় পৌঁছেছেন যেখানটা তার জন্যই মানানসই। কবিতার ভিতর দিয়ে সদ্য বহমান থাকলেও তিনি গল্প, উপন্যাসে একই সমান্তরালে চলমান, একই সাথে খ্যাতিমান। তিনি গদ্য রচনায়ও সমান সিদ্ধহস্ত।
নিরবিচ্ছিন্ন কাব্যসত্তার তাকে এনে দিয়েছে অনেক উচ্চতর এক স্থান। কবিতার বিষয়-আশয় তার অনিবার্য হয়ে উঠেছে বাংলার রূপ। বিষয় বৈচিত্র্যে ধরা পড়ে নদী, নারী, মাটি, মানুষ, প্রেম-প্রকৃতি। মাটি মানুষের টান এখানে অনেক গভীর, অনেক দৃঢ়। তাই তিনি পেয়েছেন সব সময় ফুল আর ভালোবাসা। আল মাহমুদের এই বন্ধন তার ঐহিত্যের সাথে গাঁথা। এটা তাকে দিয়েছে অনেক কিছু। তিনিও পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসা। তার কবিতার বিষয় বৈচিত্র্য তাকে বাংলা কাব্যভুবনে অমর করে রাখবে। তিনি অনিবার্যভাবে পাঠকের কাছে উঠে আসবেন বারবার। আসবেন ফিরে ফিরে প্রয়োজনে।
তার কালজয়ী কবিতাগুলো তাকে অমর করে রাখবে। সোনালি কাবিনের কবি তিনি। কিন্তু তার কবিতাগুলো পড়ার টেবিল থেকে রাজপথের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে আছে। তিনি পুকুরে শরীরের ভিতর হারিয়ে যাওয়া ধনের জন্য উতলা। আবার পরম প্রভুর প্রতি সিজদায় তার দৃঢ়চিত্তের ঘোষণা দেন। তিনি রাজপথের উত্তাল দিনগুলোর সাথে প্রকৃতির ভিতর প্রেম খুঁজে নেন। প্রেম খোঁজেন একান্তে নদী, নারী, মানুষ, মৃত্তিকার ভিতর। নানা বৈচিত্র্যময় উত্থান পতনের মতো তার জীবন এই দিনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার জীবনের মতোই তার কবিতা হয়েছে বৈচিত্র্যময়।
জীবনের বৈচিত্র্যে তিনি ১৯৭২ সালে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসীদের মুখপাত্র এবং সরকারবিরোধী একমাত্র রেডিক্যাল পত্রিকা ‘গণকণ্ঠ’র সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। পত্রিকাটি তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলে। হইচই হয় পত্রিকা নিয়ে। যার ফলে কবিকে তার খ্যাতির মূল্যও দিতে হয়। এক সময় তাকে জেল খাটতে হয়েছিল।
আল মাহমুদ একজন আধুনিক কবি। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি। তার হৃদয় কবিতায় মোড়া। তিনি নিজেই কবিতায় সজ্জিত। তিনি গোটা জীবনই কবিতার জন্য ব্যয় করেছেন। কবিতার পিছনে ছুটেছেন। বর্ষায় বৃষ্টির মতো আজ বাংলা কবিতার সাথে তার সম্পৃক্ততা বাঁধা পড়েছে। আপন আঙ্গিক তৈরির মধ্যে দিয়ে এক স্বতন্ত্র নদী মৃত্তিকার বুকে সৃষ্টি করেছেন। যেখানে পৌঁছেছেন সেখান থেকে কেউ তাকে আর ফেরাতে পারবে না। তাকে সরানো তো যাবেই না। তিনি নিজেই নিজেকে এতদিন যেভাবে মেলে দিয়েছেন এখন তার কালি সেই সজীব রসে সিক্ত। গদ্যে পদ্যে তিনি রুচির মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। কবিতার পাশাপাশি তার ছড়াগুলো সব সময় জীবন্ত বলেই মনে হয়।
তিনি সাহিত্যকে একটি উচ্চমানের সৃষ্টিশৈলি দিয়ে ঋদ্ধ করেছেন। পাঠককে রুচিশীল পাঠের সাথে পরিচয় করিয়েছেন। সুন্দর চেতনা সমৃদ্ধ নান্দনিকতায় পাঠককে আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে তার এই ক্ষমতা শ্রদ্ধার।
তার গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় শতাধিক। উল্লেখযোগ্য কিছু গ্রন্থ হলো, কবিতা : লোক লোকান্তর; কালের কলস; সোনালি কাবিন; মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো; প্রহরান্তরের পাশ ফেরা; আরব্য রজনীর রাজহাঁস; মিথ্যেবাদী রাখাল; আমি, দূরগামী; বখতিয়ারের ঘোড়া; দ্বিতীয় ভাঙন; নদীর ভেতরে নদী; উড়াল কাব্য; বিরামপুরের যাত্রী; না কোন শূন্যতা মানি না প্রভৃতি। ছোটগল্প : পান কৌড়ির রক্ত; সৌরভের কাছে পরাজিত; গন্ধবনিক; ময়ূরীর মুখ প্রভৃতি। উপন্যাস : কাবিলের বোন; উপমহাদেশ; পুরুষ সুন্দর; চেহারার চতুরঙ্গ; আগুনের মেয়ে; নিশিন্দা নারী প্রভৃতি। শিশুতোষ : পাখির কাছে ফুলের কাছে; একটি পাখির লেজ ঝোলা। প্রবন্ধ : কবির আত্মবিশ্বাস; কবির সৃজন বেদন; আল মাহমুদের প্রবন্ধ সমগ্র। ভ্রমণ : কবিতার জন্য বহুদূর; কবিতার জন্য সাত সমুদ্র প্রভৃতি। এছাড়াও প্রকাশিত হয়েছে আল মাহমুদ রচনাবলী, কবিতা সমগ্র-১, ২ উপন্যাস সমগ্র-১, ২, ৩।
তার কবিতার স্বীকতি তিনি পেয়েছেন। কালের কলস আর লোক-লোকান্তর, মাত্র দুটি কবিতা বই প্রকাশের পর কবিতার জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৮)। পেয়েছেন জয়বাংলা পুরস্কার (১৯৭২), হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৪), জীবনানন্দ দাশ স্মৃতি পুরষ্কার (১৯৭৪), সুফী মোতাহার হোসেন সাহিত্য স্বর্ণপদক (১৯৭৬), ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬), একুশে পদক (১৯৮৭), নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৯০), সমান্তরাল (ভারত) কর্তৃক ভানুসিংহ সম্মাননা পদক- ২০০৪, কবি গোলাম মোহাম্মদ ফাউন্ডেশন পুরস্কার (২০০৬) সহ অনেক সম্মাননা।
এই কবির ৮০তম জন্মদিনে কবিকে লাল গোলাপ শুভেচ্ছা।