যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক বাজারে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ
এইচ এম আকতার: একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পোশাক রফতানির সর্ববৃহৎ বাজার যুক্তরাষ্ট্র। এ বাজারে বাংলাদেশ ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ছে। প্রতিযোগিতার এই বাজার দখল করে নিচ্ছে ভিয়েতনাম। মার্কিন বাজার দখলে ভিয়েতনাম দ্রুতগতিতে এগিয়ে গেলেও স্থবির হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। আগামীতে বাংলাদেশের অবস্থান আরো খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অর্জন করতে না পারলে সামনে পোশাক শিল্পের ভয়াল দিন অপেক্ষা করছে। ভিয়েতনামসহ আরো ১০ দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি কার্যকর হলে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প খাতের এই দুর্দিন শুরু হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বাণিজ্য বিভাগের অধীন অফিস অব টেক্সটাইল এন্ড এপারেলের (অটেক্সা) তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০১৫-এর এপ্রিল পর্যন্ত বাজার দখল বিবেচনা করলে বাংলাদেশের অবস্থান প্রায় একই অবস্থায় আছে। যদিও এ সময়ে প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও হন্ডুরাসের বাজার দখলে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে পোশাক পণ্য রফতানিতে ভিয়েতনাম ক্রমেই বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিযোগী হয়ে উঠছে। যদিও দেশটির শ্রম মজুরি বাংলাদেশের তুলনায় বেশি।
এ রিপোর্টে দেখা গেছে, ২০০০ সালে মার্কিন পোশাক বাজারে বাংলাদেশের দখল ছিল ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। ২০১৫-এর এপ্রিল শেষে তা কিছুটা বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অন্যদিকে ২০০০ সালে দশমিক ১৯ শতাংশ বাজার দখল থাকলেও বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিযোগী ভিয়েতনামের বর্তমান অংশ ১২ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
জানা গেছে, বৈশ্বিক পোশাকের বাজারে সর্ববৃহৎ সরবরাহকারী দেশ চীন। যুক্তরাষ্ট্রেও রফতানিকৃত পণ্যের পরিমাণ ও আয় দুই হিসাবেই শীর্ষ স্থানে রয়েছে দেশটি। পণ্য পরিমাণের বিচারে শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে চীনের পরে বাকি নয়টি দেশ হলো ভারত, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, মেক্সিকো, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, হন্ডুরাস ও কম্বোডিয়া। আয়ের বিচারে চীনের পরে অবস্থানকারী দেশগুলো হলো ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, ভারত, হন্ডুরাস, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান ও দক্ষিণ কোরিয়া।
২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি করে ৪৮৩ কোটি ৪১ লাখ ১১ হাজার ডলারের। ২০১৩তে আমদানির পরিমাণ ছিল ৪৯৪ কোটি ৭৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার। এ হিসাবেই ২০১৪ সালে দেশটি থেকে বাংলাদেশের রফতানি আয় কমেছে ২ দশমিক ২৯ শতাংশ।
অটেক্সার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০০ সালে ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া ও হন্ডুরাসের বাজার অংশ ছিল যথাক্রমে দশমিক ১৯, ৬ দশমিক শূন্য ৩, ৩ দশমিক ২৬ এবং ৬ দশমিক ৪১ শতাংশ। এ হিসাবে সে বছর চীনের পরেই সবচেয়ে বেশি অংশ ছিল বাংলাদেশের। এর পরের অবস্থানগুলো ছিল হন্ডুরাস, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামের।
এদিকে ২০১৩ সালে বাজার দখলে এগিয়ে যায় ভিয়েতনাম। সে বছর মার্কিন বাজারে দেশটির অংশ ছিল ৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ। একই সময়ে বাংলাদেশের তা ছিল ৬ দশমিক ৮১ শতাংশ। ইন্দোনেশিয়া ও হন্ডুরাসের ছিল যথাক্রমে ৫ দশমিক শূন্য ৮ এবং ৪ দশমিক ৩২ শতাংশ।
২০১৪ সালে ভিয়েতনামের বাজার দখলের পরিমাণ বেড়ে হয় ১০ দশমিক ৭৩ শতাংশ। সে বছর বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া ও হন্ডুরাসের অংশ দাঁড়ায় ৬ দশমিক ২৮, ৪ দশমিক ৮৬ এবং ৪ দশমিক ২৩ শতাংশ। ২০১৫-এর এপ্রিল পর্যন্ত মার্কিন পোশাক বাজারে ভিয়েতনামের অংশ বেড়ে দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৩৬ শতাংশ। একই সময়ে বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া ও হন্ডুরাসের দখলে ছিল যথাক্রমে ৭ দশমিক ৬৭, ৫ দশমিক ৫৬, ৪ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ।
বাজার দখলের চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ১৫ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ধারাবাহিকভাবেই শক্তিশালী হয়েছে ভিয়েতনাম। অন্যদিকে ২০০০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বাজার দখল ৬ শতাংশের গ-ি পেরোয়নি। কেবল ২০১৫তেই বাংলাদেশের তা সাড়ে ৭ শতাংশের বেশি ছিল। কিন্তু একই সময়ে ভিয়েতনামের অংশ সাড়ে ১২ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে যায়।
এ প্রসঙ্গে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, পোশাক পণ্যের রফতানি গন্তব্যগুলোর মধ্যে একক দেশ হিসেবে সর্ববৃহৎ বাজার হলো যুক্তরাষ্ট্র। তবে নানা কারণেই বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী করা যাচ্ছে না। এর মধ্যে শুল্ক সমস্যার পাশাপাশি সাম্প্রতিক কারণগুলোর মধ্যে আছে শ্রমনিরাপত্তাসহ কমপ্লায়েন্স ব্যবস্থাপনা।
আগামীতে বাংলাদেশের অবস্থান আরো খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এমন মন্তব্য করে শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, ভিয়েতনামসহ আরো ১০ দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি হতে যাচ্ছে। এ চুক্তি হলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অর্জন করতে না পারলে সামনে পোশাক শিল্পের ভয়াল দিন অপেক্ষা করছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শ্রম মজুরি কম হলেও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এ সুবিধা কাজে লাগাতে পারছে না। এর মূল কারণ দেশটিতে বাংলাদেশের রফতানি করা পণ্য প্রায় ১৬ শতাংশ আমদানি শুল্ক দিয়ে আমদানি করেন মার্কিন ক্রেতারা। আর টিপিপি সম্পাদিত হলে বাংলাদেশ আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যার প্রভাব পড়বে বাজার দখলের অংশে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের অতিরিক্তি গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, যুক্তরাষ্ট্র শিগগিরই ভিয়েতনামসহ ১২ দেশের সঙ্গে টিপিপি করতে যাচ্ছে। এ চুক্তির আওতায় তারা যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত পণ্য রফতানি সুবিধা পেলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের রফতানি পণ্যের মধ্যে ১০টির সাদৃশ্য আছে। সেজন্য টিপিপি হলে অন্য রফতানিকারক দেশ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে নীতি সুরক্ষা দেয়া উচিত।