ইন্টারেস্ট রেইট বাড়ানোর আভাস দিলেন ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্ণর
ইন্টারেস্টের বেইজ রেইট (কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত সুদের হার) বাড়ানোর আভাস দিয়েছেন ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্ণর মার্ক কারনি। এর ফলে যাদের বাড়ির মর্গেজ রয়েছে তাদের মর্গেজের কিস্তির পরিমাণ বাড়তে পারে।
ক্রেডিট কার্ড বা বিভিন্ন ধরণের আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যক্তিগত ঋণ যাদের আছে তাদের ক্ষেত্রে প্রদেয় সুদের হার বাড়ার ব্যাপক সম্ভাবণা রয়েছে। গভর্ণর মার্ক কারনি যাদের মর্গেজ বা ঋণ রয়েছে তাদেরকে ইন্টারেস্টের বেইজ রেইট বাড়ার বিষয়টি মাথায় রেখে আর্থিক ব্যবস্থাপনা পরিচালিত করার সুপারিশ করেছেন। চলতি বছরের শেষে কিংবা ২০১৬ সালের শুরুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেইজ হার বাড়বে বলে আভাস দেন তিনি।
ব্রিটেনের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক কর্মপন্থা নির্ধারণে গত ২৪ জুলাই মঙ্গলবার সরকারের ট্রেজারি সিলেক্ট কমিটির মুখোমুখি হন গভর্ণর। তিনি এমপিদের জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক খুব শীগ্রই ইন্টারেস্টের বেইজ রেইট বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা করছে। তবে তিনি ইঙ্গিত করেন যে, বেইজ রেইট বাড়ানো হলেও তা খুব শীগ্রই আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে না।
২০০৭ সালে বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দা শুরুর আগে ব্রিটেনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত ইন্টারেস্টের বেইজ রেইট ছিলো ৫ শতাংশ। বাজারের অবস্থা বিবেচনায় বেইজ রেইট কিছুটা উঠা নামা করলে তা ৪ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবন্ধ থাকতো। তখন ওই হারই বেইজ রেইটের জন্য স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু বিশ্বব্যাপী মন্দা শুরু হলে অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড ইন্টারেস্টের বেইজ রেইট ধীরে ধীরে কমিয়ে আনে। ২০০৯ সালে তা মাত্র শূণ্য দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনে। এই রেইটকে বলা হচ্ছে ‘আল্ট্রা থিন’ ইন্টারেস্ট রেইট। গত প্রায় ছয় বছর ধরেই ব্রিটেনে সুদের বেইজ রেইট ‘আল্ট্রা থিন’ পর্যায়ে রয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বেইজ রেইট শূণ্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানো হলে এক লাখ ৫০ হাজার পাউন্ডের মর্গেজের জন্য কিস্তির পরিমাণ মাসে ৩৮ পাউন্ড বাড়বে। সাধারণত বেইজ রেইটের সাথে ২ যোগ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মর্গেজের সুদের হার নির্ধারণ করেন। ২০১৬/২০১৭ সালের দিকে বেইজ রেইট বেড়ে যদি ২ দশমিক ৫ শতাংশ হয়, তাহলে মর্গেজের সুদের হার হবে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। সেক্ষেত্রে এক লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড মর্গেজের বিপরীতে মাসিক কিস্তির পরিমাণ ৬৭৩ পাউন্ড থেকে বেড়ে হবে ৮৩৩ পাউন্ড। মর্গেজ প্রোভাইডার ‘ন্যাশনওয়াইড’ সাধারণত এই হিসাবেই সুদের হার নির্ধারণ করে। সুদের হারের ভেরিয়েবল চুক্তির ক্ষেত্রে মূলত মর্টগেজ রিপেমেন্টের পরিমাণ এভাবে বৃদ্ধি পাবে। যাদের ফিক্সড টার্ম মর্গেজ চুক্তি রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে সুদের বেইজ হার বৃদ্ধি কোনো প্রভাব ফেলবে না।
পার্সোনাল লোন এবং ক্রেডিড কার্ডের সুদের হারের বিষয়ে মানিকমস ওয়েবসাইটের এন্ড্রু হেগার বলেন, বেশির ভাগ ক্রেডিট কার্ড এবং পার্সোনাল লোনের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো সুদের ফিক্সড রেইট নির্ধারণ করে দেয়। এ কারণে এসব ক্ষেত্রে বেইজ রেইট বাড়ার ফলে সুদের হার বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগ নেই। যাদের ফিক্সড রেইড চুক্তি নেই তাদের ক্ষেত্রে সুদের হার বৃদ্ধি পাবে। যেমন হ্যালিফেক্সের ক্রেডিড কার্ড প্রদানের চুক্তিতে বেইজ রেইট বাড়ার ফলে সুদের হারের পরিবর্তন হবে বলে উল্লেখ রয়েছে।
তবে বেইজ রেইট বৃদ্ধি পেলেই যে প্রতিষ্ঠানগুলো কাস্টোমারদের জন্য সুদের হার বৃদ্ধি করবে এমনটি মনে করেন না এন্ড্রু হেগার। তার মতে, এখনকার আর্থিক সেবার বাজার অনেক বেশি প্রতিযোগিতাপূর্ণ। ফলে বেশ হিসাব কিতাব করেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুদের হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি মনে করেন, শূণ্য দশমিক ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বর্ধিত সুদের হার প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই এবজর্ব করে নিতে পারে। এর দায়ভার তারা গ্রাহকদের ওপর চাপাতে চাইবে না।
স্বভাবিক কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের বেইজ হার বাড়ানোর বিষয়টি যারা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অর্থ জমা রাখেন তাদের জন্য সুখকর হওয়ার কথা। কেননা, বেইজ রেইট বৃদ্ধি ঋণের সুদের হার যেমন বাড়াবে তেমনি সঞ্চয়ের সুদের হারও বৃদ্ধি করবে। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন ভিন্ন কথা। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে তারা বলেন, বেউজ রেইট বাড়লে ঋণের সুদ বাড়ায় প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু সঞ্চয়ের সুদ বাড়ায় না। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও কোনো প্রভাব নেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। বাজার প্রতিযোগিতার ওপর বিষয়টি নির্ভর করে। অর্থনেতিক মন্দার প্রেক্ষিত্রে ২০১২ সালে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড ‘ফান্ডিং ফর ল্যান্ডিং’ স্কিম চালু করে। এর ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে মূলদনের জন্য গ্রহকদের আমানতের ওপর নির্ভর করতে হয় না। ওই স্কিম চালুর আগে ব্যাংকগুলো সঞ্চয়ের ওপর সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ সুদ দিত। কিন্তু এখন দিচ্ছে ১ দশমিক ৬ শতাংশ হারে।
তবে বেইজ রেইটের যে কোনো ধরণের বৃদ্ধি ভবিষ্যৎ ঋণদানে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। বিশেষ করে এর ফলে ঘরবাড়ির মূল্য কমতির দিকে আসতে পারে। কেননা, মর্গেজের সুদের হার বাড়লে মর্গেজের খরচ বাড়বে। এতে মর্গেজ নেয়ার হার কমে যাবে। যার ফলে ঘরবাড়ি বেচা বিক্রির বাজারে ক্রেতা কমে গিয়ে মূল্য পতন ঘটতে পারে।
২০১৩ সালে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের দায়িত্ব নেয়ার পর কানাডিয়ান ব্যাংকার মার্ক কারনি ঘোষণা করেন যে, ব্রিটেনে বেকারত্বের হার ৭ শতাংশের নিচে না আসা পর্যন্ত তিনি সুদের বেইজ হার বাড়াবেন না। গত বছর থেকে ব্রিটেনের অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসে। এ সময়ে বেকারত্ব উল্লেকযোগ্য হারে হ্রাস পায়, মূল্যস্ফীতিও থাকে প্রত্যাশিত হারে। তখন সুদের বেইজ হার বাড়িয়ে শূণ্য দশমিক ৭৫ শতাংশ করার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনিটারি বোর্ডের কয়েকজন সদস্য মত দিলেও শেষ পর্যন্ত তা বাড়ানো হয়নি। এবার মার্ক করনি নিজেই বললেন যে, শীগ্রই সুদের বেইজ হার বাড়বে।
মার্ক কারনি বলেন, বেকাত্ব হ্রাস, ক্রমাগত প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি প্রত্যাশা ছাড়িয়ে শূণ্যে নেমে আসার মত ইতিবাচক বিষয়গুলো বেইজ রেইট বাড়ানোর বিষয়ে তাঁকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। তবে এটি মন্দার আগের পর্যায়ে ফিরে যাবে সেই সম্ভাবণা তিনি দেখছেন না। সুদের বেইজ হার ২ থেকে আড়াই শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে বলে তিনি ইঙ্গি দেন। অর্থনীতিবিদরাও মনে করছেন, ব্রিটেনে নতুন স্বাভাবিক বেইজ রেইট ২ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৫০ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।
গভর্ণর বলেন, সুদের হার খুবই ধীর গতিতে বাড়ানো হবে। ব্যাংকগুলো মানুষের ওপর এর প্রভাব পর্যালোচনা করবে। মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর গভীর দৃষ্টি রেখেই সুদের হার নির্ধারণ করা হবে।