বদলে যাচ্ছে লন্ডনের বাংলাটাউন

Bricklaneলন্ডনের পাতাল রেলের অলগেট ইস্ট স্টেশনে নেমে মিনিট দুয়েক হাঁটলেই ব্রিক লেন। বাংলা টাউনের শুরু। কমাস আগেও সড়কটিতে ঢোকার মুখে ছিল ক্লিফটন নামে বাংলাদেশি একটি রেস্তোরাঁ ছিল। হাত বদলে এখন সেটির নাম হয়েছে এফিস। তুর্কি রেস্তোরাঁ। হাত বদলের এই ঘটনা একটি মাত্র নয়।
ব্রিক লেনের বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ স্যাফরনের ম্যানেজার আহমেদ উদ্বেগের সাথে বর্ণনা করলেন, কিভাবে আস্তে আস্তে বাংলাদেশি মালিকানাধীন রেস্তোরাঁ, দোকানপাট হাত বদলাচ্ছে।
স্যাফরন রেস্তোরাঁর ঠিক উল্টো দিকে বাংলাদেশি মালিকানাধীন একটি ট্রাভেল এজেন্টের দোকান বন্ধ হয়ে সেটি হয়েছে পূর্ব ইউরোপীয় একটি কফির দোকান।
আরও বিশ গজ সামনে দাওয়াত নামে একটি বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ উঠে গিয়ে তার জায়গায় হয়েছে ক্যানটিন নামে ধোপদুরস্ত একটি আর্জেন্টাইন শতেক রেস্তোরাঁ।
পূর্ব লন্ডনের ব্রিক লেন এবং আশপাশের এলাকা বেশ ক’দশক ধরে বাংলাদেশী অভিবাসী অধ্যুষিত। অনেকদিন ধরেই এলাকাটির আনুষ্ঠানিক নাম বাংলাটাউন। এখানকার সড়কগুলোর নামও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় লেখা। কারি নামে খ্যাত ভারতীয় উপমহাদেশের খাবার খেতে এখনও এ এলাকাতেই ভিড় করেন মানুষজন।
কিন্তু হালে ব্রিক লেন এবং বাংলাটাউন দ্রুত বদলে যাচ্ছে। কমছে কারি রেস্টুরেন্ট, বাংলাদেশি মুদির দোকান বা গ্রসারি এবং সেইসাথে এলাকার বাঙালি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা।
গত ছ-সাত বছরে ব্রিটেনের কারি ক্যাপিটাল নামে খ্যাত ব্রিক লেনের ডজন খানেক বাংলাদেশি মালিকানাধীন রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। জায়গা নিচ্ছে, স্টেক হাউস, চীনা রেস্তোরাঁ, আধুনিক পশ্চিমা ক্যাফে।
ফ্যাশন, প্রযুক্তি আর দেয়াল চিত্র
বছর পাঁচেক আগে ব্রিক লেনের লাগোয়া এক সড়কে অফিস নিয়েছে সিক্স অরেঞ্জেস নামে তথ্যচিত্র নির্মাতা একটি প্রতিষ্ঠান। তার অন্যতম কর্ণধার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত চিত্রনির্মাতা শফিউর রহমান।
বললেন গত পাঁচবছরেই চোখের সামনে অনেক পরিবর্তন হতে দেখছেন তিনি।
“এলাকায় বিত্তশালী মানুষের ভিড় বাড়ছে। সেইসাথে হুহু করে বেড়ে যাচ্ছে বাড়ি ভাড়া, বাড়ির দাম। ফলে যেসব মানুষ বহুদিন ধরে এই এলাকায় কম্যুনিটি তৈরি করেছে, তারা চলে যাচ্ছে বা চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে।”
ব্রিকলেনের একটা অংশের চেহারা নব্বইয়ের দশক থেকেই বদলাতে থাকে।
Bricklane2ব্রিকলেন মসজিদ থেকে মিনিট তিন-চার হাঁটলেই ব্রিকলেন অন্য চেহারা নিতে শুরু করে বছর বিশেক আগ থেকেই। আধুনিক তরুণ তরুণী, কবি শিল্পীদের আড্ডার অন্যতম জায়গা হয়ে উঠছে এলাকাটি । সেইসাথে সংখ্যা বাড়ছে পানশালা, ফ্যাশন শপ, আর্ট স্টুডিও।
বছর কয়েক আগেও যে ভবনে ছিল বাংলাদেশি বই, রেস্টুরেস্ট বা চুল কাটার দোকান, সেখানে এখন অত্যাধুনিক অফিস স্পেস। ধোপদুরস্ত পোশাকে অঅদুনিক তরুণ তরুণীরা ল্যাপটপ সামনে নিয়ে সেখান কাজ করছেন।
এমনকি বছর পাঁচেক ধরে ব্রিক লেন এখন লন্ডনের দেয়ালচিত্রের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। শুধু ব্রিটেন নয়, সারা বিশ্বের শীর্ষ দেয়ালচিত্র শিল্পীরা ব্রিক লেন এলাকায় এসে তাদের কাজের কিছু নমুনা তুলে ধরতে চাইছেন। শুধু দেয়াল চিত্র দেখতে প্রতিদিন দলে দলে পর্যটক ব্রিক লেনে আসছেন।
চলে যাচ্ছেন বাংলাদেশিরা
ব্রিক লেনে শুধু যে বাংলাদেশি রেস্তোরা দোকানপাট হাত বদলাচ্ছে তা নয়, বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর সংখ্যাও কমছে দ্রুত হারে।
আব্দুন নুর ১৯৬৮ তে লন্ডনে আসার পর থেকে ব্রিক লেন এলাকাতেই থাকেন। ব্রিক লেন মসজিদে জোহরের নামাজ পড়ে বেরুলে তার সাথে কথা হলো। বললেন পাঁচ-সাত বছর আগেও নামাজের মসজিদে লোক হতো, এখন আর তা হয় না।
কারণ, এলাকায় বাড়ি ভাড়া, বাড়ির দাম প্রচণ্ড রকম বাড়ার কারণে বহু বাংলাদেশি তাদের বাসা ভাড়া দিয়ে দুরে চলে যাচ্ছেন। “আমার অনেক প্রতিবেশী গত কয় বছরে চলে গেছেন।”
ব্রিক লেনের সবচেয়ে পুরনো বাংলাদেশি মুদিখানার দোকান তাজ স্টোরসের অন্যতম কর্ণধার আব্দুল কাইয়ুম জামাল বললেন, ব্রিক লেনের রূপান্তর হচ্ছে।
“আমার বাবা চাচারা ৮০ বছর আগে যখন এই দোকান খুলেছিলো, তখন ব্রিক লেনে ছিল ইহুদিরা, তারপর আইরিশরা, তারপর আসে বাংলাদেশিরা। এখন বাংলাদেশিরা চলে যাচ্ছে, আসছে পেশাজীবী পয়সাওয়ালা ইউরোপীয়রা।”
“কষ্ট লাগে। আমার জন্ম এখানে, এখানেই বড় হয়েছি। সবাই জানে এটা বাংলাদেশিদের জায়গা…বাংলা টাউন, অনেকটা চায়না টাউনের মত…কিন্তু সেটা বদলে যাচ্ছে…খুব দ্রুত বদলাচ্ছে।”
ব্রিকলেনের যে সব ভবনে বাংলাদেশি এসব রেস্টুরেন্ট এবং দোকান সেগুলোর অধিকাংশের মালিক তারা নয়। মি জামাল জানালেন, দিন দিন ভাড়া এত বাড়ছে যে বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ-দোকানগুলোর জন্য ব্যবসা চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে।
এই বাস্তবতার সাথে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে মি জামাল। তিনি জানালেন, একসময় যেখানে দোকানের ৯০ শতাংশ জিনিসপত্র ছিল বাংলাদেশ থেকে আনা পণ্য, এখন বড় জোর ৫০ শতাংশ।
“আমরা এখন অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর চাহিদামত জিনিসপত্রও বিক্রি করছি।”
এই পরিবর্তনকে ব্রিক লেনের বাঙালিরা অবধারিত ঘটনা হিসেবেই দেখছেন।
ব্রিক লেনের মসালা রেস্টুরেন্টের মালিক এবং বাংলাটাউন রেস্টুরেন্ট সমিতির প্রেসিডেন্ট গুলজার খান এই পরিবর্তনে খুব অখুশি নন। “আগে এখানে ছিল শুধু কারি রেস্টুরেন্ট, এখন অন্যান্য খাবারের রেস্টুরেন্ট আসছে। ফলে নানারকম মানুষ আসছে..ব্যবসার জন্য সেটা মন্দ নয়।”
যেভাবে ব্রিক লেন এবং আশপাশের এলাকার ডেমোগ্রাফি অর্থাৎ জনসংখ্যার চালচিত্র বদলাচ্ছে, তাতে ব্রিটেনের কারি ক্যাপিটাল, বাংলাটাউন -এসব নামের যৌক্তিকতা, এই এলাকার কয়েক দশকের বৈশিষ্ট্য আর কতদিন ধরে রাখা যাবে – এ প্রশ্নে এখানকার বাসিন্দাদের কেউই খুব একটা ভরসা পাচ্ছেনা না। -বিবিসি

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button