পেট্রল রফতানি করবে বাংলাদেশ
প্রথমবারের মতো জ্বালানি তেল পেট্রল রফতানি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এজন্য এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। শুরুতে ১৫ হাজার মেট্রিক টন পেট্রল রফতানি করা হবে। আজ দরপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ বিশ্ববাজার থেকে চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের পরিশোধিত ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে আসছে। জ্বালানি বিভাগ ও বিপিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বিপিসির চেয়ারম্যান এ এম বদরুদোজ্জা এ প্রসঙ্গে বলেন, রোববার পর্যন্ত কোনো দরপত্র জমা পড়েনি। কাল (সোমবার) দরপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন। এদিন দরপত্র জমা পড়ার আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, গ্যাসক্ষেত্র থেকে যে কনডেনসেট পাওয়া যাচ্ছে, তা পরিশোধন করে আমরা পেট্রল ও অকটেন পাচ্ছি, যা আমাদের দেশের চাহিদার চেয়ে বেশি। এ কারণে পেট্রল রফতানি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
জ্বালানি বিভাগ ও বিপিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশে গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন গ্যাসফিল্ড থেকে গ্যাসের উৎপাদন বাড়িয়েছে সরকার। বর্তমানে দেশের মোট গ্যাস চাহিদার অর্ধেকের বেশি মিটিয়ে থাকে বহুজাতিক মার্কিন কোম্পানি শেভরন। গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সম্প্রতি কোম্পানিটি দৈনিক গ্যাসের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে ফিল্ডগুলো থেকে গ্যাসের সঙ্গে যে পরিমাণ কনডেনসেট (গ্যাসের উপজাত) উৎপাদিত হচ্ছে, তা দেশের সরকারি-বেসরকারি ফ্র্যাকশনেশন প্লান্টগুলো প্রক্রিয়াজাত করতে পারছে না। সম্প্রতি কনডেনসেট রিজার্ভ করতে না পারায় এবং ফ্র্যাকশনেশন প্লানগুলোর কনডেনসেটের চাহিদা না থাকায় সরকার বাধ্য হয়ে গ্যাসের উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। এছাড়া কনডেনসেট বা এ থেকে উৎপাদিত জ্বালানি তেল পেট্রল বা অকটেন রিজার্ভ করার মতো স্থানও নেই। গ্যাস উৎপাদনের সঙ্গে কনডেনসেট উৎপাদন সম্পৃক্ত বিধায় কনডেনসেট রিজার্ভ নিয়ে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি অর্থবছর গ্যাসক্ষেত্রের কনডেনসেট প্রক্রিয়া করে দেশের পেট্রল এবং অকটেনের চাহিদা মিটিয়ে অন্তত ২ লাখ মেট্রিক টন রফতানি করা যেতে পারে।
এ অবস্থায় কনডেনসেট থেকে উৎপাদিত পেট্রল রফতানির অনুমতি চেয়ে জুলাই মাসের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব পাঠায় জ্বালানি বিভাগ। একই মাসের মাঝামাঝিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মতি পাওয়ার পর দরপত্র আহ্বান করে বিপিসি। আজ ওই দরপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন।
জানা গেছে, বর্তমানে দেশে পেট্রোবাংলার আওতাধীন বিভিন্ন কোম্পানির সরকারি পর্যায়ে চারটি ও বেসরকারি পর্যায়ে ১০টি ফ্র্যাকশনেশন প্লান্ট রয়েছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের আওতাধীন রয়েছে ইস্টার্ন রিফাইনারি (ইআরএল) ফ্র্যাকশনেশন প্লান্ট। কিন্তু কনডেনসেট উৎপাদনের সঙ্গে ফ্র্যাকশনেশন প্লান্টে পরিশোধনের পরিমাণ খুব সামান্য। একই সঙ্গে কনডেনসেট থেকে যে পরিমাণ পেট্রল উৎপাদিত হচ্ছে, সে পরিমাণ চাহিদা দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে নেই। এতে গ্যাস উৎপাদনের সঙ্গে উৎপাদিত কনডেনসেট নিয়ে বিপাকে পড়েছে সরকার।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডের লিকুইড রিকভারি ইউনিট চালু হওয়ার পর এ ফিল্ড থেকে দৈনিক ৯ হাজার ব্যারেল কনডেনসেট উৎপাদিত হচ্ছে। জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশের গ্যাসক্ষেত্রে ৩ লাখ ২১ হাজার মেট্রিক টন কনডেনসেট উৎপাদিত হয়েছে। গত অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন। আর চলতি অর্থবছরে এর পরিমাণ হবে ৫ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন। দেশের ১৪টি কেন্দ্রে এ বিপুল পরিমাণ কনডেনসেট পরিশোধনের সুযোগ থাকলেও দেশের বাজারে কনডেনসেট থেকে পরিশোধিত এ পরিমাণ পেট্রল ও অকটেন ব্যবহারের সুযোগ নেই। দেশে সর্বোচ্চ সাড়ে ৩ লাখ পেট্রল এবং অকটেনের চাহিদা রয়েছে। আর বাইরে আরও ২ লাখ টন অতিরিক্ত থাকে যায়। গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কনডেনসেটের উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পাবে। এতে পেট্রল এবং অকটেনের উৎপাদনও বাড়বে।
সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১৪টি প্রতিষ্ঠান কনডেনসেট পরিশোধন করে পেট্রল ও অকটেন তৈরি করছে। এর মধ্যে সরকারের চারটি পরিশোধন কেন্দ্র এসজিএফএল, বিজিএফসিএল, আরপিজিসিএল ও ইআরএল মিলিয়ে ৩ লাখ ২৮ হাজার ৬৬৪ মেট্রিক টন কনডেনসেট পরিশোধনের ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু সরকারের এ চারটি প্রতিষ্ঠান এপ্রিল পর্যন্ত ২ লাখ ১১ হাজার ৩৪৫ মেট্রিক টন পরিশোধন করেছে। অন্যদিকে ১০টি বেসরকারি কোম্পানির ক্ষমতা রয়েছে ৭ লাখ ২৪ হাজার ৬৬৪ মেট্রিক টন। তবে তারা এপ্রিল পর্যন্ত পরিশোধন করছে ২ লাখ ৮৮ হাজার ৭৯৫ মেট্রিক টন।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে দেশে দৈনিক গড়ে ১ হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন কনডেনসেট উৎপাদিত হয়। তবে এখন দৈনিক ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ মেট্রিক টন কনডেনসেট পরিশোধন করছে। বাকিটা পুড়িয়ে ফেলতে হচ্ছে। এতে দৈনিক ৩০ শতাংশ মূল্যবান এ পেট্রোলিয়াম পুড়িয়ে ফেলা হয়।
সম্প্রতি দেখা গেছে আশুগঞ্জে কনডেনসেট ট্যাঙ্কারের ধারণ ক্ষমতা প্রায় ৭১ হাজার মেট্রিক টন। এ পরিমাণ কনডেনসেট এখানে প্রায় সব সময় মজুদ রাখতে হচ্ছে। ফলে বিবিয়ানা থেকে উত্তোলিত কনডেনসেট সেখানে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে বিবিয়ান গ্যাসক্ষেত্রে কনডেনসেট বৃদ্ধি পাওয়ায় ওই ক্ষেত্রের দুটি লিকুইড রিকভারি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে এ ক্ষেত্রের গ্যাসের উৎপাদনও কমে যায়। দেশে পেট্রল, অকটেন এবং জেট ফুয়েলের চাহিদা না থাকায় বেশিরভাগ সময় তা অবিক্রীত থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকারি প্লান্টের ফ্র্যাকশনেশনে উৎপাদিত পেট্রোলিয়াম পণ্যই অবিক্রীত থেকে যায়। দেশে চাহিদা বৃদ্ধি না পাওয়ায় অথবা বিদেশে রফতানির সুযোগ না থাকায় বেসরকারি কোম্পানিগুলো কনডেনসেট নিতে চায় না।