একজন ঐশী ও কিছু কথা

Oisheআবদুল্লাহ্ আল মেহেদী: বর্তমানে দেশের বহুল আলোচিত ও সমালোচিত একটি মানুষ ঐশী। বাবা-মার অবাধ্য বখে যাওয়া একমাত্র মেয়ে। যেন অন্ধকার জগতে নিমজ্জিত ঐশী। নেশা, বন্ধুদের সঙ্গে অবাধ মেলামেশা, ড্যান্স পার্টিতে নিয়মিত অংশগ্রহণ, পনের দিন বাসার বাইরে থাকা ও রাত করে বাসায় ফেরাসহ নানান জঘন্য কাজে লিপ্ত ছিল ঐশী। বয়স তেমন নয়, কৈশোর জীবন শেষ প্রান্তে ও যৌবনের প্রারম্ভে। রাজধানীর একটি অভিজাত ইংলিশ মিডিয়ামে ও-লেভেলে পড়ত সে। মা-বাবার আদরের সন্তান ঐশী। কিন্তু সেই প্রিয়তম বাবা-মাকে নিজ হাতে হত্যা করল সে। কত নির্মম ও বেদনাময় এ ঘটনা। নানান মানুষের নানান কথা, ধিক্কার, অভিশাপ, সমালোচনা চলছে তাকে ঘিরে। মেয়েরা এমন কাজ করতে পারে? শুধু এই প্রশ্ন। কারণ মেয়েদের মন স্বভাবতই কোমল।
শুধু ঐশী নয়, এমন শত শত ঐশী আছে দেশে। ইয়াবা সেবন, ধূমপান, রাত জেগে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, দেরি করে বাসায় ফেরা—এমন হাজারো অভিযোগ। জানা যায়, রাজধানীর অভিজাত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের টার্গেটে পরিণত হচ্ছে। নিজের অজান্তেই অনেকে ইয়াবার নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। অনেকে জড়িয়েও পড়ছে জীবনবিধ্বংসী মাদকের ব্যবসায়। আবার অনেকে কাজ করে ইয়াবার ক্যারিয়ার হিসেবে। বেশ কয়েক দফায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র গ্রেফতার হয়েছে। রাজধানীর চামেলীবাগে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমান তাদেরই মেয়ে ঐশী রহমানের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন। ঐশী ধানমন্ডির ১৬ নম্বর রোডের অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ও-লেভেলের ছাত্রী। এ স্কুলটির ছাত্রছাত্রীদের বড় একটি অংশ ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদকে আসক্ত বলে অভিযোগ ছিল দীর্ঘদিন থেকেই। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে গেলে কোনো শিক্ষার্থীই শিক্ষকের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। তাই অভিভাবকদের উচিত মাদকসহ যে কোনো বাজে নেশা থেকে সন্তানকে বাঁচাতে ব্যক্তিজীবনে শৃঙ্খলা ও ধর্মীয় অনুশাসন পালনে বাধ্য করা, নীতি-নৈতিকতা শেখানো, পারিবারিক শিষ্টাচার ও দেশপ্রেম শেখানো। বন্ধু নির্বাচন ও সন্তানের বাইরে একাকী সময় কাটানোর বিষয়ে খেয়াল রাখা উচিত। তাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দৈনন্দিন একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি অভিভাবকদের এসব বিষয়ে ব্যাপকভাবে উত্সাহিত করা হয়।
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের টার্গেটে পরিণত হওয়ার নেপথ্য কারণ হিসেবে জানা গেছে, সাধারণত ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সন্তানরা ইংলিশ মিডিয়াম ও বেসরকারি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। তাদের অনেকের হাতেই থাকে প্রচুর টাকা। কোমলমতি শিক্ষার্থী বখাটে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকে আসক্ত হয়। ইয়াবা সেবনে স্লিম থাকা যায়, দুঃখ ভুলে থাকা যায়, ইয়াবা যৌন উত্তেজক ইত্যাদি আকর্ষণীয় দিক তুলে ধরে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করে। সিগারেটের অভ্যাসের মতো করে প্রথমে বিনা পয়সায়, পরে পয়সা দিয়ে এবং এক পর্যায়ে চরম নেশাগ্রস্ত হয়ে যে কোনো উপায়ে ইয়াবা সেবনের জন্য টাকার জোগাড় করে আসক্তরা।
ইয়াবাসহ ভয়ঙ্কর সব মাদকের থাবা আগামী প্রজন্মকে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ইয়াবাসহ মাদকের ভয়াবহ এই আগ্রাসন নিয়ে অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত। ঐশীর হাতে তারই মা-বাবা খুনের ঘটনা সেই আতঙ্ক ও উদ্বেগ বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেকেই যেন নিজের সন্তানদেরই বিশ্বাস করতে পারছেন না। এর থেকে উত্তরণের পথ কী?
মা-বাবার অবাধ্য সন্তানরা যখন নেশায় আসক্ত হয় তখন তারা এমন কাজ করে যা কল্পনা করা কঠিন। মনোচিকিত্সক মোহিত কামাল তার এক সাক্ষাত্কারে বলেছেন—‘চিকিত্সা করতে গিয়ে আমাকে অনেক কঠিন সত্যের মুখোমুখি হতে হয়েছে, ছেলে মায়ের গলায় বঁটি ধরে মাদকের টাকা নেয়, মেয়ে আসবাবপত্র ভেঙে ফেলে, সারাদিন মেয়ে দরজা বন্ধ করে রাখে, সন্তানদের সামনে স্বামী স্ত্রীকে মারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী এসে বলে আমাকে বাঁচান, আর পারছি না স্যার।’
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তথ্য মতে, শুধু রাজধানীতেই ইয়াবা ব্যবসায়ীর সংখ্যা কমপক্ষে ১৫ হাজার। বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে রয়েছে দু’শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ী।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের মতে, পরিবারের কাছ থেকে বেশুমার হাত খরচের টাকা পাওয়া ছেলেমেয়েরাই এখন ইয়াবা নেশায় বেশি আসক্ত হচ্ছে। এমনকি চিকিত্সক, প্রকৌশলী, তরুণ ব্যাংকারদের কাছেও ইয়াবার কদর অনেক।
বহু আগে থেকেই রাজধানীর অভিজাত এলাকায় ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বখে যাওয়া সন্তানরা ‘ইয়াবা ক্লাব’ গঠন করেছে। ওইসব ক্লাবে দিনে বা রাতে তরুণ-তরুণীরা চুর হয়ে থাকে ইয়াবার নেশায়। পড়াশোনা কিংবা আড্ডার নামে ক্লাবে জমে ওঠে ইয়াবার আড্ডা। আশির দশকের শেষদিকে ফেনসিডিল ছড়িয়ে পড়ে মাদকরাজ্যে। নব্বইয়ের দশকের শেষে মাদক হিসেবে ইয়াবা প্রথম ধরা পড়লেও বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়নি। এখন সেই ইয়াবা বড়িতে ভাসছে গোটা দেশ। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ার জন্য দায়ী সামাজিক পরিস্থিতি। সন্তানরা কোথায় যাচ্ছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে কিনা এ বিষয়ে খোঁজখবর বাড়াতে হবে বাবা-মাকে। শিক্ষকদেরও অনেক দায়িত্ব রয়েছে। আগে শিক্ষকরা ক্লাসের বাইরে গিয়েও অনেক দায়িত্ব পালন করতেন। সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ভালো শিক্ষাটাই দিতেন শিক্ষার্থীদের। এখন আর তা লক্ষ্য করা যায় না। ধর্মহীন পারিবারিক ব্যবস্থা এসব সমস্যার জন্য দায়ী। ইসলাম যাবতীয় নেশাদ্রব্যকেই হারাম ঘোষণা করেছে। এ সমস্যা থেকে উত্তরণে দরকার ধর্মীয় অনুশীলন ও পারিবারিক বন্ধন আরও জোরদার করা। দাম্পত্য জীবন যদি ইসলামভিত্তিক আদর্শগত হতো তাহলে এমনটা হতো না। সন্তানরা যদি বাবা-মায়ের কাছে কোনো কিছু শেয়ার করতে না পারে তাহলে তারা ঝুঁকে পড়ে বাইরের দিকে। বাবা-মাকে সন্তানদের আবদার ও চাহিদা বুঝতে হবে, শুনতে হবে। বিচ্ছিন্নতাই দায়ী এসব কাজের জন্য।
কর্মকাজে সবাই ব্যস্ত থাকে শহর জীবনে, শুধু টিভি আর কম্পিউটারের মাঝেই শিশুদের বিনোদন জগত্। বাবা-মা দু’জনই থাকে বাইরে। সন্তানকে একা বন্দি থাকতে হয় বদ্ধ বাসায়। খেলার জন্য নেই সবুজ মাঠ বা প্রান্তর, নেই সামাজিক প্রীতি-ভালোবাসা। যার যার নিজস্ব জীবন নিয়েই থাকে। পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশীর সঙ্গে নেই তেমন আন্তরিক সম্পর্ক। বাবা-মার চাপ, পড়াশোনার চাপ, সঙ্গহীন একাকী জীবন, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, মানসিক যাতনা, দায়িত্ব-কর্তব্যের মুখোমুখি না হাওয়া, উদারতা না বোঝাসহ প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত শহুরে জীবন এজন্যই দায়ী।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button