মোল্লা মুহাম্মদ ওমর : গুজব এবং বাস্তবতা
হামিদ মীর: মোল্লা মুহাম্মদ ওমরের জীবন-মৃত্যুর আসল কাহিনী এখনো সামনে আসেনি। শক্তিধর শত্র“রা তার মাথার মূল্য হেঁকেছিল ১০ মিলিয়ন ডলার। তবুও তারা ডলার ও আধুনিক টেকনোলজির মাধ্যমে মোল্লা মুহাম্মদ ওমরকে খুঁজে পায়নি। আর আজ বন্ধ কামরায় একজন অপরজনের সামনে এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য যে, মোল্লা মুহাম্মদকে হাতকড়া লাগানো বা মিসাইল হামলায় তার মৃত্যুর ঘোষণা করার স্বপ্ন বাস্তবরূপ লাভ করেনি। মোল্লা মুহাম্মদ ওমরের বেঁচে থাকা তার শত্রুর জন্য পরাজয় ছিল। আর তার মৃত্যুও তার শক্তিধর শত্রুর জন্য পরাজয়ের ঘোষণা বটে। মোল্লা মুহাম্মদ ওমরের জীবন-মৃত্যুর অপূর্ণ কাহিনীকে ভিত্তি করে তালেবানের ভবিষ্যতের পর্যালোচনা করা আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
চিন্তার বিষয় হলো, আমেরিকার ওয়ান্টেড এক পলাতক ব্যক্তি প্রকাশ্যে না এসেই তালেবানকে এত শক্তিশালী কিভাবে করলেন যে, আমেরিকা তাদের সাথে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত হলো? আমেরিকান থিংক ট্যাংক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক এক গবেষণা মোতাবেক ২০০১ সালের পর থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত ২০১৫ সাল আফগানিস্তানে সম্মিলিত যৌথ বাহিনীর জন্য সবচেয়ে কঠিন সাল। কেননা তালেবান হামলা আফগানিস্তানের দক্ষিণ থেকে উত্তর পর্যন্ত প্রতিটি কোনায় ছড়িয়ে পড়েছে। এক দিকে আফগানিস্তানের ভৌগোলিক বাস্তবতা, অপর দিকে মোল্লা মুহাম্মদ ওমর ও তালেবান সম্পর্কে গুজবের ঝড়। আমেরিকা গুজবের মাধ্যমে বিশ্ব মিডিয়ায় প্রোপাগান্ডার যুদ্ধে সফলতার সাথে লড়াই করেছে, কিন্তু মোল্লা মুহাম্মদ ওমর গুজবের পরিবর্তে এক ভৌগোলিক বাস্তবতারূপে আমেরিকার সামনে টিকে থাকেন। মোল্লা মুহাম্মদ ওমরের জীবন-মৃত্যুর বেশির ভাগটাই গুজবে আক্রান্ত। এ অধম স্বীকার করে যে, বহু বছর আগে আফগানিস্তানে যখন তালেবানের উত্থান ঘটে, তখন আমার মনে হয়েছিল তালেবান আমেরিকার সমর্থনপুষ্ট। কেননা তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিনিধি রবিন র্যাফেল তালেবানকে সহায়তা করেছিলেন। ১৯৯৫ সালে প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো আমার ভুল ধারণা নিরসনের চেষ্টা করেন। তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিরুল্লাহ বাবর আমাকে জানান, উত্তরাঞ্চলীয় জোট কাবুলে পাকিস্তানের দূতাবাসে হামলা করেছে, এ জন্য পিপলস পার্টির সরকার তালেবানকে সমর্থন করছে। তালেবান পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষার আশ্বাস দিয়েছিল। নাসিরুল্লাহ বাবরের মাধ্যমে মোল্লা মুহাম্মদ ওমর ও তালেবানের সাথে আমার পরিচয় ঘটে।
বুরহানুদ্দীন রাব্বানী, আহমদ শাহ মাসউদ, হেকমত ইয়ার ও রশীদ দোস্তামের সাথেও বাবর সাহেবের যোগাযোগ ছিল। তিনি তালেবান ও উত্তরাঞ্চলীয় জোটের মাঝে সমঝোতার জন্য তৎপর ছিলেন। যাতে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে তুর্কমেনিস্তান থেকে পাকিস্তান পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইন বসানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেন। মার্কিন তেল কোম্পানি ইউনোকল তালেবানকে তাদের ‘পাইপলাইন পুলিশ’ হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল, কিন্তু তালেবান কারো জন্য ব্যবহার হতে প্রস্তুত ছিল না। ১৯৯৬ সালের শুরুতে তালেবান মোল্লা মুহাম্মদ ওমরকে একজন সেনা কমান্ডার থেকে আমিরুল মুমিনিন বানিয়ে দেয়। ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে রবিন র্যাফেল তার সাথে সাক্ষাতের জন্য কান্দাহার পৌঁছেন। কিন্তু মোল্লা মুহাম্মদ ওমর তার সাথে ফটোসেশন করে উত্তরাঞ্চলীয় জোটের ওপর প্রভাব বিস্তারের প্রয়োজন মনে করেননি। তিনি তার সহকর্মীদের সাক্ষাতের জন্য প্রেরণ করেন। ১৯৯৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তালেবান কাবুল দখল করে। ১৯৯৬ সালের ৬ নভেম্বর তালেবান ইসলামাবাদে উত্তরাঞ্চলীয় জোটের সাথে আলোচনায় বসার ইচ্ছা প্রকাশ করে। নাসিরুল্লাহ বাবর এক সমঝোতা স্মারকের প্রস্তাবিত খসড়াও তৈরি করে ফেলেছিলেন, কিন্তু ৫ নভেম্বর রাতে বেনজির ভুট্টোর সরকারকে উৎখাত করে দেয়া হয়। এভাবেই উভয় পক্ষ আর কাছাকাছি আসতে পারল না।
বিশ্ব মিডিয়ায় এ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয় যে, তালেবান আইএসআইয়ের সৃষ্টি। আর মোল্লা মুহাম্মদ ওমরকে আইএসআই পাকিস্তানে লুকিয়ে রেখেছে। তালেবান গঠনে আইএসআইয়ের কোনো ভূমিকা ছিল না। বরং ১৯৯৪ সালে তালেবানের এক প্রধান বিরোধী গুলবুদ্দীন হেকমত ইয়ারের সাথে আইএসআইয়ের বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তালেবানের সাথে প্রাথমিক সম্পর্ক স্থাপন করেন নাসিরুল্লাহ বাবর। এরপর প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর নির্দেশনা মোতাবেক আইএসআইয়ের প্রধান জেনারেল জাভেদ আশরাফ কাজী তালেবানকে ইসলামাবাদে সাক্ষাতের জন্য আমন্ত্রণ জানালে মোল্লা মুহাম্মদ ওমর ইসলামাবাদে আসতে অপারগতা প্রকাশ করেন এবং কয়েকজন সহচরকে সাক্ষাতের জন্য পাঠান। ওই সাক্ষাৎকালে তালেবান আইএসআই ও হেকমত ইয়ারের মাঝে ঘনিষ্ঠতা নিয়ে অভিযোগ উত্থাপন করে। এরপর পাকিস্তানের সরকার ও রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো তালেবানকে সহায়তা করে। মোল্লা মুহাম্মদ ওমর যত দিন কাবুলের শাসক ছিলেন, তিনি পাকিস্তানের স্বার্থের প্রতি খেয়াল রেখেছেন। তবে পাকিস্তান বা সৌদি আরব কখনো কারোই চাপিয়ে দেয়া আদেশ তিনি পালন করেননি। অথচ উভয় দেশই তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
১৯৯৭ সালে আফগান তালেবানের এক প্রতিনিধিদলকে আমেরিকা সফরের জন্য আহ্বান করা হয়। ওই সময় এক আরব এনজিওর মাধ্যমে তালেবানকে উসকানি দেয়া হয় যে, তারা চীনের সিংকিয়াং প্রদেশের স্বাধীনতাকামী মুসলমানদের সাহায্য করলে তাদের অনেক উপকার হবে। ওই ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করতে পাকিস্তানি আলেমে দীন মুফতি নিজামুদ্দীন শামযায়ী ও মাওলানা ফজলুর রহমান খলীল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিছুদিন পর পাকিস্তানে চীনের রাষ্ট্রদূত লু শু লীন কান্দাহার সফর করেন। মোল্লা মুহাম্মদ ওমর চীনা রাষ্ট্রদূতকে আশ্বাস দেন যে, তালেবান চীনের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করবে না। অপর দিকে, পাকিস্তান ও সৌদি আরব সরকারের সাথে মোল্লা মুহাম্মদ ওমরের সম্পর্কের মাঝে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়। সৌদি ইন্টেলিজেন্সের প্রধান তুরকি আল ফায়সাল ১৯৯৮ সালের জুন ও সেপ্টেম্বরে মোল্লা মুহাম্মদ ওমরের সাথে দু’বার সাক্ষাৎ করেন এবং উসামা বিন লাদেনকে আফগানিস্তান থেকে বের করে দেয়ার দাবি জানান। মোল্লা মুহাম্মদ ওমর তা প্রত্যাখ্যান করেন। যখন তুরকি আল ফায়সাল চাপ সৃষ্টি করলেন, তখন মোল্লা মুহাম্মদ ওমর এক গ্রাম্য পাখতুনের রূপ ধারণ করে এত কঠিন ভাষা ব্যবহার করলেন যে, তুরকি আল ফায়সাল ঘর্মাক্ত হয়ে গেলেন। ওই সময় আইএসআইয়ের প্রধান জেনারেল জিয়াউদ্দীন বাটকে মোল্লা মুহাম্মদ ওমরের কাছে পাঠানো হয়। আলোচনার বিষয় ছিল উসামা বিন লাদেন। বাট সাহেবও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন।
মোল্লা মুহাম্মদ ওমর উসামা বিন লাদেনের জন্য তার শাসনক্ষমতাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে ফেলেন। ১৯৯৯ সালের আগস্টে কান্দাহারে মোল্লা মুহাম্মদ ওমরের বাসস্থানে ট্রাক বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে হামলা করা হয়। ওই হামলায় তার এক ছেলে ও স্ত্রীসহ পরিবারের চারজন সদস্য মারা যান। মোল্লা মুহাম্মদ ওমর সামান্য আহত হন। তবে ওই হামলার পরে আমেরিকার ব্যাপারে তার মনোভাব আরো কঠিন হয়ে যায়। ওই হামলার জবাব দেয়ার জন্য উসামা বিন লাদেন আমেরিকায় ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও পেন্টাগনে হামলার পরিকল্পনা শুরু করেন। তবে মোল্লা মুহাম্মদ ওমর ওই পরিকল্পনা সম্পর্কে বেখবর ছিলেন। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকায় আল কায়েদার হামলা শুধু মোল্লা মুহাম্মদ ওমরের জন্য নয়, বরং বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের জন্য বহু সমস্যা দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ২০০১ সালে ১৬ সেপ্টেম্বর জেনারেল পারভেজ মোশাররফ আইএসআইয়ের প্রধান জেনারেল মাহমুদ আহমদকে মোল্লা মুহাম্মদ ওমরের কাছে পাঠান এবং উসামা বিন লাদেনকে আফগানিস্তান থেকে বের করে দেয়ার দাবি জানান। মোল্লা মুহাম্মদ ওমরের বেশ আফসোস ছিল যে, উসামা বিন লাদেন কয়েকটি বিষয়ে আমিরের আনুগত্যের দাবি পূরণ করেননি। তবে তিনি জেনারেল মাহমুদকেও না করে দেন। এরপর পাকিস্তান ও সৌদি আরবসহ পুরো বিশ্ব তালেবানের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়ে গেল। ২০০১ সালের নভেম্বরে তালেবান সরকারের ইতি টানার কয়েক দিন আগে কাবুলে তালেবানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোল্লা আব্দুর রাজ্জাক আখুনজাদের কাছে জানতে চাইলাম যে, তিনি কি উসামা বিন লাদেনের জন্য তার শাসনক্ষমতা কোরবানি করে দেবেন? তিনি প্রত্যুত্তরে বললেন, তার নেতা মোল্লা মুহাম্মদ ওমরের কাছে ক্ষমতার চেয়ে আফগান জাতির মর্যাদা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এর কিছু দিন পরই তালেবানের ক্ষমতা শেষ হয়ে গেল, তবে তালেবান শেষ হয়ে যায়নি। তালেবানের শেষ না হওয়ার বড় কারণ তালেবানের স্তরভিত্তিক ভূমিকা। বিশ্বের কাছে এটা এক উগ্রপন্থী ধর্মীয় আন্দোলন। বাস্তবে এটা ধনিক শ্রেণীর গোত্রীয় সর্দার ও দুর্নীতিবাজ সামরিক নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রাম্য কৃষকদের সশস্ত্র আন্দোলন, যার নেতৃবৃন্দের কাছে হারানোর কিছুই ছিল না। মোল্লা মুহাম্মদ ওমর ২০০২ সালে তার কার্যকৌশল পরিবর্তন করেন। তিনি উত্তর আফগানিস্তানে তাজিক, উজবেক ও হাজারে গোত্রের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি করেন। বামিয়ান, দায়কুন্ডি ও গজনীতে শিয়াদের তালেবানে যুক্ত করেন ও ইরানের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন। শিয়া ও ইরানের ব্যাপারে তার পরিবর্তিত নীতি প্রমাণ করে যে, আফগান তালেবান ও পাকিস্তানি তালেবানের মাঝে অনেক পার্থক্য। ২০১৫ সালের মে মাসে আফগান তালেবানের এক প্রতিনিধিদল ইরান সফর করে। কাবুল সরকারে যুক্ত উত্তরাঞ্চলীয় জোটের প্রতিনিধি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নুরুল হক উলুমি এ সফরে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আফগান তালেবান ইরানে না গেলে হয়তো আফগান ইন্টেলিজেন্স মোল্লা মুহাম্মদ ওমরের মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশ করত না। নুরুল হক উলুমি সাবেক কমিউনিস্ট আর্মি জেনারেল ও ড. নজিবুল্লাহর শাসনামলে কান্দাহারের গভর্নর ছিলেন। কাবুল সরকার ও তালেবানের সাথে আলোচনা শুরু হওয়া সত্ত্বেও তালেবানের মুখপত্র শরিয়ত উলুমির সমালোচনা থেকে বিরত হয়নি। কেননা উলুমি আফগানিস্তানের জেলগুলোতে তালেবান কয়েদিদের ওপর সীমাহীন অত্যাচার করেছেন। উলুমির সন্দেহজনক মনোভাবের কারণে তালেবান শান্তি আলোচনায় বেশ সতর্ক ছিল। কেননা আলোচনায় আফগান ইন্টেলিজেন্সকেও গোছালো দেখা যায়নি।
আলোচনায় আগ্রহী বিশ্ব শক্তিকে মনে রাখতে হবে, শান্তি আলোচনার নামে তালেবানকে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের বিনিময়ে কেনা বেশ মুশকিল। তালেবানকে দুর্বল আর আইসিসকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে না। গুজবের মাধ্যমে প্রোপাগান্ডার যুদ্ধে জয়লাভ করা যেতে পারে, তবে আফগানিস্তানের গ্রাম্য ও পাহাড়ি এলাকার ভৌগোলিক বাস্তবতা পরিবর্তন করা যাবে না। মোল্লা মুহাম্মদ ওমরের নাম আর তালেবানের গ্রাম্য যোদ্ধা কাবুলের ধনী শাসকদের সামনে ভৌগোলিক বাস্তবতার রূপ ধারণ করে বাধা সৃষ্টি করে যাবে।
লেখক : পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ০৮ আগস্ট, ২০১৫ থেকে
উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব