অভিবাসী স্রোত : কঠিন সঙ্কটে মানবতাবাদী ইউরোপ
প্রবল স্রোতের বেগে ধাবমান অভিবাসীদের নিয়ে নতুন ও জটিল এক সঙ্কটে পড়েছে ইউরোপ। আর্থিক সঙ্কটে পতিত হবার পাশাপাশি ইউরোপের এই নতুন সঙ্কটকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে ভয়াবহ ও দুর্বিষহ সঙ্কট হিসাবে দেখা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে অভিবাসী সঙ্কট কিভাবে সামাল দেওয়া যাবে সেটাই হচ্ছে বর্তমান ইউরোপের প্রধান উদ্বেগের বিষয়। ইউরোপের আত্মপরিচয় এবং তার মূল্যবোধ ও মানবিকতার বিষয়গুলো এর সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে অভিবাসী সঙ্কট তাদের জন্য বড় ধরনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আর্থিক সঙ্কটে জর্জরিত ইউরোপকে দ্বিতীয় মহসমরের পর বৃহত্তম উদ্বাস্তু সমস্যার মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এই সব উদ্বাস্তুরা আসছে প্রধানত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সিরিয়া থেকে এবং একই সঙ্গে ইরাক, আফগানিস্তান, ইরিত্রিয়া ও সোমালিয়ার মতো দেশগুলো থেকে। ইরাক ও আফগানিস্তানও সিরিয়ার মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং এই দেশগুলো থেকে বিপুল সংখ্যক লোক তাদের বাড়িঘর ছেড়ে উন্নত ও নিরাপদ জীবনের আশায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে।
এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, গত এক বছরে ইউরোপে পাড়ি দিয়েছে রেকর্ড সংখ্যক, অর্থাৎ অন্তত ৬ কোটি উদ্বাস্তু। এদের অধিকাংশই উল্লেখিত দেশগুলো থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন পথে, বিশেষ করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন বন্দরে পৌঁছেছে। এই চরম অনিশ্চিত এবং ঝুঁকিবহুল পথ পাড়ি দিতে গিয়ে প্রাণ হারাতে হয়েছে অসংখ্য উদ্বাস্তুকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইউরোপমুখী উদ্বাস্তু মানুষের ঢল থামছে না।
এদিকে, এক খবরে জানা গেছে, পূর্ব ইউরোপীয় দেশ গ্রিসের কস দ্বীপে অবস্থানকারী এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে যাওয়া অভিবাসন প্রত্যাশীদের মাঝে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। গত মঙ্গলবার সকালে এই সহিংসতার সূত্রপাত হয়। পুলিশ ওই সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বাধ্য হয়েই তাদের উপর অগ্নিনির্বাপক গ্যাস নিক্ষেপ করে। কস দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত শহরটির একমাত্র স্টেডিয়ামে অভিবাসী নিবন্ধন কার্যক্রম চলাকালে এই সহিংসতার ঘটনা ঘটে। পার্শ্ববর্তী তুরস্ক উপকূল থেকে রাবারের ডিঙ্গি নৌকায় করে অভিবাসীদের আগমনের ঢল নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে কস কর্তৃপক্ষ। অভিবাসী সংকট নিরসনে গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচির অংশ হিসেবেই অভিবাসন প্রত্যাশীদের নিবন্ধনের ওই পদক্ষেপ নেয় দেশটির সরকার। নিবন্ধন কার্যক্রম আরো দ্রুত গতিতে সম্পন্ন করার দাবিতে শতশত অভিবাসন প্রত্যাশী মঙ্গলবার সকালে বিক্ষোভ শুরু করে। তারা দ্বীপ শহরটির প্রধান সড়কে অবস্থান ধর্মঘট করে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। এসময় আমরা কাগজ চাই, আমরা খেতে চাই এই জাতীয় স্লোগানে বিক্ষোভকারীরা তাদের দাবির জানান দেয়। গ্রিসের জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যগুলোর একটি এই দ্বীপশহর কস। বিক্ষাভকারীরা মঙ্গলবার শহরটির প্রধান পার্ক ও চত্বরগুলো অবরোধ করে রাখে।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে এশিয়া ও আফ্রিকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও যুদ্ধপীড়িত দেশগুলো থেকে গ্রিসের পূর্বাঞ্চলীয় দ্বীপগুলোতে অন্তত ১ লাখ ২৪ হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশী এসে জড়ো হয়েছে। গত বছরে একই সময়কালে যে সংখ্যক অভিবাসন প্রত্যাশী গ্রিসে গিয়ে জড়ো হয়েছিল এ বছর তার ৭৫০ শতাংশ বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী সেখানে গিয়েছে। জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এই হিসেব দিয়েছে।
ওদিকে গ্রিক পুলিশ জানিয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত যে হিসেব রাখা হয়েছে তাতে দেখা গেছে, ওই সময়কালে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৭২৬ জন অবৈধ অভিবাসন প্রত্যাশীকে দেশটিতে বেআইনীভাবে প্রবেশ বা অবস্থান করার কারণে আটক করা হয়েছে। গত বছর একই সময়ে আটক করা হয়েছিল মাত্র ৩২ হাজার ৭০ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীকে। উল্লেখ্য, গ্রিস, ইতালি, ফ্রান্স ও স্পেনসহ ইউরোপের ভূমধ্যসাগর উপকুলীয় দেশগুলোতে গত কয়েকবছর ধরেই এশিয়া আফ্রিকা থেকে লাখ লাখ অভিবাসনপ্রত্যাশী গিয়ে জড়ো হচ্ছে। এই অভিবাসী সংকট ফ্রান্স পাড়ি দিয়ে ব্রিটেনে গিয়েও উপচে পড়ছে। এতে আতঙ্কিত হয়ে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়েছে অভিবাসী সংকট পুরো ইউরোপের আর্থ-সামাজিক কাঠামোতে উলট-পালট ঘটিয়ে দিতে পারে।