খালেদা জিয়ার ৭০তম জন্মদিন
১৫ আগস্ট শনিবার বিএনপি চেয়ারপার্সন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী, ২০ দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ৭০তম জন্মদিন। তিনি ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট পশ্চিম দিনাজপুরের (ভারতের জলপাইগুড়ি) জন্ম গ্রহণ করেন। তার গ্রামের বাড়ি ফেনী জেলার ফুলগাজী গ্রামের বিখ্যাত মজুমদার বাড়ি। পিতা ইস্কান্দার মজুমদার ও মা তৈয়বা মজুমদার। ১৯৬০ সালে দিনাজপুর সরকারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন খালেদা খানম পুতুল। পরে দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে লেখাপড়া করেন তিনি। কলেজে পড়ার সময় তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। জিয়াউর রহমান-খালেদা জিয়া দম্পতির দুই সন্তান তারেক রহমান পিনু আর আরাফাত রহমান কোকো। গত ২৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়ার একটি হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান কোকো। ১৯৮১ সালের ৩১ মে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে নিহত হন। এ সময় পর্যন্ত গৃহবধূই ছিলেন খালেদা জিয়া। পরে দলের নেতা-কর্মীদের আহবানে বিএনপির হাল ধরেন তিনি। ন্যায়নীতি ও আদর্শের কারণে তিনি দেশে এবং বিদেশে আপোষহীন নেত্রী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। বেগম খালেদা জিয়া তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃত করেন। বিএনপির চেয়ারপার্সন হিসেবে একটানা ৩০ বছর পূর্ণ করলেন স্বাধীনতা পরবর্তী দেশে সর্বোচ্চ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির বর্তমান চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া।
বেগম খালেদা জিয়া শৈশব ও কৈশোর জীবন অতিবাহিত হয় দিনাজপুরের মুদিপাড়া গ্রামে। তার পিতা এস্কান্দার মজুমদার পেশায় ব্যবসায়ী ছিলেন। মা বেগম তৈয়বা মজুমদার ছিলেন দিনাজপুরের চন্দবাড়ির মেয়ে। বেগম খালেদা জিয়া পড়াশোনা করেন দিনাজপুর মিশন স্কুল এবং গার্লস স্কুল সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কতিপয় বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার গুলীতে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে শাহাদাতবরণ করেন। জাতির সংকট মুহূর্তে একজন সার্থক গৃহবধূ ও মা থেকে বেগম জিয়া বিএনপিতে অপরিহার্য হয়ে পড়েন। বাস্তবতার নিরিখে তাকে রাজনীতিতে আসতে হয়েছে। ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি বেগম খালেদা জিয়া জাতীয়তাবাদী দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীর আহ্বানে তার স্বামীর প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপির একজন প্রাথমিক সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে তিনি আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, সততা, সাংগঠনিক প্রজ্ঞা ও জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল তিনি দলের বর্ধিত সভায় প্রথম বক্তৃতা করেন। বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের অসুস্থতায় তিনি ১৯৮৪ সালের ১২ জানুয়ারি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন এবং একই বছরের ১০ মে বিএনপির চেয়ারপার্সন হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রথমবার নির্বাচিত হন। ১৯৯৩ সালে ১ সেপ্টেম্বর দলের চতুর্থ কাউন্সিলে দ্বিতীয়বার এবং সর্বশেষ ২০০৯ সালের ৪ ডিসেম্বর পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে তৃতীয়বারের মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপির চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন।
বিএনপির চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব গ্রহণ করার পরই নানা প্রতিকূলতার মধ্যে পড়েন বেগম খালেদা জিয়া। সাবেক সেনা প্রধান লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও দলকে ঐক্যবদ্ধ রেখে বেগম জিয়া তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। এরশাদের দীর্ঘ ৯ বছরের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে শুধু আন্দোলনই নয়, তার সাথে কোন রকম সমঝোতা না করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তিনি আপোষহীন ভূমিকা পালন করেন। যে কারণে বেগম খালেদা জিয়া ন্যায় ও আদর্শের প্রশ্নে একজন আপোষহীন নেত্রী হিসেবে ব্যাপক খ্যাতি ও সুনাম অর্জন করেন। বেগম জিয়া তার দক্ষ নেতৃত্বের মাধ্যমে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলে এরশাদের পতন ত্বরান্বিত করেন। ১৯৮৩ সালে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে সাত দলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বরে ৭ দলীয় ঐক্যজোটের মাধ্যমে এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ দফায় আন্দোলন চলতে থাকে। ১৯৮৬ সালের ২১ মার্চ রাতে আ’লীগ সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবার সিদ্ধান্ত নিলে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন আরো তীব্র হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ দল ভেঙ্গে ৮ দল ও ৫ দল হয়। ৮ দল নির্বাচনে যায়। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দল ও ৫ দল ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের নবসূচনা করে। ১৯৮৭ সাল থেকে খালেদা জিয়া ‘এরশাদ হটাও’ এক দফার আন্দোলন শুরু করেন। একটানা নিরলস ও আপোষহীন সংগ্রামের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় বিএনপি। তারই সুবাদে বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে প্রথমবারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। এরপর ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয়বার এবং ২০০১ সালে জোটগতভাবে নির্বাচন করে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। তিনি একমাত্র নেতা যিনি এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৩ বার দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া দু’বার বিরোধীদলীয় নেতার ভূমিকা পালন করেন।
বেগম জিয়া দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) দু’বার চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব পালন করেন। নির্বাচনের ইতিহাসে খালেদা জিয়ার একটি অনন্য রেকর্ড হচ্ছে গত ৫টি সংসদ নির্বাচনে ২৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবকটিতেই তিনিই জয়ী হয়েছেন। বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বেগম জিয়াই একমাত্র নেত্রী যিনি গণতন্ত্রের জন্য কোনো অন্যায় এবং দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে আপোষ করেননি। নানা ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী বেগম জিয়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে দূরদর্শীতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। সেনা সমর্থিত গত ওয়ান ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খালেদা জিয়াকে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘদিন কারাবাসের পর তিনি আইনী লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে সবকটি মামলায় জামিন নিয়ে মুক্তি লাভ করেন। কারাগারে থাকাকালে তাকে বিদেশে নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি যেতে রাজি না হওয়ায় ষড়যন্ত্রকারীদের চেষ্টা সফল হয়নি।
নীলনকশার নির্বাচনে তাকে হারানোর পর বর্তমান সরকার তাকে তার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছে। এমন অভিযোগ বিএনপির। তার নামে নতুন করে মামলা দেয়া হয়েছে। সরকার তাদের দলীয় নেতা-কর্মীর নামে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এমনকি আদালত কর্তৃক মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামীদের সাজা মওকুফ করে নিলেও বেগম খালেদা জিয়ার নামে দায়েরকৃত কোন মামলা এখন পর্যন্ত প্রত্যাহার করা হয়নি। বরং মামলার চার্জশিট দেয়া হচ্ছে। দেয়া হয়েছে নতুন মামলা। জোটের অন্যতম শরীক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর, সেক্রেটারি জেনারেলসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেফতার করে জোট ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র করছে। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হচ্ছে। রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। জামায়াত নেতাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের মিথ্যা অভিযোগ এনে ফাঁসি ও অথবা যাবজ্জীবন কারাদেন্ডের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। যদিও এই বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে দেশে বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। সবাই বলছে এই বিচার প্রশ্নবিদ্ধ। দেশবাসী আশা করছে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে আ’লীগ সরকারের বাকশালী কায়দায় নির্যাতন বন্ধে রাজপথে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করবে। দেশের জনগণও ফিরে পাবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন। ইতোমধ্যে একতরফাভাবে সংবিধান সংশোধন, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন, দেশবিরোধী চুক্তিসহ বিভিন্ন জনবিচ্ছিন্ন কর্মকা-ের প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে বেগম জিয়া। তারই ধারাবাহিকতায় প্রথমে ১৮ দল এবং বর্তমানে ২০ দলসহ সমমনা দলগুলোকে নিয়ে বৃহৎ ঐক্য গড়ারও কাজ চলছে। আগামী কিছুদিনের মধ্যে আবারো সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনের ডাক দিবেন খালেদা জিয়া।
প্রতিবছরই বিএনপি ও অঙ্গ দলগুলো খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালন করে থাকে। প্রায় প্রতি বছর রাত বারোটা এক মিনিটে (১৫ আগস্ট রাত ১২টা ১ মিনিট) গুলশান কার্যালয়ে খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে বিএনপি এবং অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা কেক কেটে দলীয় নেত্রীর জন্মদিন পালন করে। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের পক্ষ থেকে ৭০ পাউন্ড কেক কাটা হয়েছে বলে মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, আমরা ৭০ পাউন্ড কেক কেটে ম্যাডামের ৭০তম জন্মদিন উদযাপন করেছি। এছাড়া বিএনপি, মহানগর বিএনপিসহ অন্যান্য অঙ্গ দলের পক্ষ থেকেও কেক কাটা হয়েছে বলে জানা গেছে। গুলশানে জন্মদিন পালনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ সিনিয়র নেতারা উপস্থিত ছিলেন। রাতে গুলশানের বাসায় চেয়ারপার্সনকে শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে বলে জানা গেছে। ছাত্রদলের পক্ষ থেকেও খালেদার জিয়ার জন্মদিন উপলক্ষে ৭০ পাউন্ড কেকের অর্ডার দেওয়া হয়েছে। আজ শনিবার সকাল ৮টায় নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কেক কেটে ‘প্রিয় নেত্রী’ এর জন্মদিন পালন করবে ছাত্রদল। এ বিষয়ে ছাত্রদলের দফতর সম্পাদক মো. আবদুস সাত্তার পাটোয়ারি বলেন, আমাদের নেত্রীর জন্মদিন উপলক্ষে ৭০ পাউন্ড কেক অর্ডার দিয়েছি। শনিবার সকাল ৮টায় নয়াপল্টনে কেক কাটা হবে।