ইয়েমেন যুদ্ধে প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ জনগণ
ইয়েমেন সংকটে এখন পর্যন্ত সাড়ে তিন হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। যার মধ্যে অর্ধেকের বেশি দেশটির নিরীহ সাধারণ জনগণ। তাদের সঙ্গে লড়াইরত দুইপক্ষের কারোর সঙ্গেই কোনো ধরনের বৈরিতা নেই। এরপরও তারা মারা পড়ছে। আর তারা মারা যাচ্ছে আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর তৈরি বিভিন্ন ধরনের সমরাস্ত্র এবং বোমার আঘাতেই। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে এসব তথ্য।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্যমতে, ইউরোপ থেকে বেশ কিছু সমরাস্ত্র এবং গোলাবারুদ আমদানি করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। সৌদি আরবের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে ইয়েমেনে বোমা ফেলছে আরব আমিরাতও। এসব বোমার মধ্যে এমকে৮২ এবং এমকে৮৪ ইতালিতে তৈরি। জার্মান কোম্পানি রেইনমেটাল ইতালিতে এসব বোমা বানায়। এই বোমাগুলোই ইয়েমেন হামলায় ব্যবহার করা হচ্ছে। আর এতে শত্রুপক্ষের চেয়ে ইউরোপে তৈরি এসব বোমায় সাধারণ ইয়েমেনিদের মৃত্যুর মিছিলই লম্বা হচ্ছে। এসব বোমার পাশাপাশি ইয়েমেনের একটি গ্রামে আমেরিকান ক্লাস্টার (গুচ্ছ) বোমারও সন্ধান পেয়েছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। উল্লেখ্য, এই ক্লাস্টার বোমার ব্যবহার অনেক আগেই আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবু আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসে তৈরি এসব ক্লাস্টার বোমা ২০১১ সালে সৌদি আরবের কাছে বিক্রি করেছে ওয়াশিংটন। এসব বোমার অবৈধ ব্যবহারের বিষয়ে আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হলে তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখবে বলে জানায়। ব্যাস, ওই পর্যন্তই। আসলে বিষয়টি সম্পর্কে জানার কোনো আগ্রহই দেখায়নি আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
আমেরিকার ক্লাস্টার বোমা ছাড়াও আরো বিভিন্ন ধরনের সমরাস্ত্র সৌদি আরব ইয়েমেন হামলায় ব্যবহার করছে বলেও জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। সৌদি আরব বর্তমান আমেরিকান সমরাস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। অতীতে সমরাস্ত্র বিক্রি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ইয়েমেন সংকট শুরু হওয়ার পর হামলা অব্যাহত রাখতে সৌদি আরব আমেরিকান সমরাস্ত্র কেনা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ইয়েমেনে হামলা অব্যাহত রাখতে আমেরিকা ছাড়াও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকেও বাদশাহ সালমানের দেশ সমরাস্ত্র আমদানি করছে।
এসব সমরাস্ত্র ইয়েমেনে অবৈধভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে সৌদি আরব আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ভঙ্গ করছে বলে মন্তব্য করেছেন বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। কারণ, সৌদি আরব যেভাবে ইয়েমেনে বোমা নিক্ষেপ করছে, সেটা বিদ্যমান মানবাধিকার আইন সমর্থন করে না। এ জন্য সমরাস্ত্রের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক মুখপাত্র বলেন, ‘এসব সমরাস্ত্র ব্যবহার করে দুর্বল কোনো গোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার চালানোসহ মানবাধিকার ভঙ্গের সম্ভাবনা থাকলে অস্ত্র বিক্রির লাইসেন্স অনুমোদন করা উচিত নয়।’ কিন্তু এর বাস্তবায়ন না থাকায় ইয়েমেনে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, হৌথি বিদ্রোহীদের হামলায়ও ইয়েমেনে অনেক সাধারণ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। ইরানের সহায়তায় হৌথিরা তাদের বিরুদ্ধে অবস্থানকারী ইয়েমেনিদের হত্যা করছে বলে অভিযোগ করে আসছে রিয়াদ। কিন্তু তেহরান সবসময়ই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
এদিকে ইয়েমেন সংকট নিরসনে রাজনৈতিক সমাধানকেই সবচেয়ে উত্তম পন্থা বলে মনে করে আমেরিকা এবং তার পশ্চিমা মিত্রগোষ্ঠী। আবার একই সঙ্গে তারা ইয়েমেনে সৌদি আরবের বোমা হামলা অব্যাহত রাখারও পক্ষপাতী। কিন্তু এভাবে সংকট নিরসন সম্ভব নয় বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এ ছাড়া হামলাকারী দেশকে সমরাস্ত্র রপ্তানি অব্যাহত রেখে সংকট সমাধানের তাগাদা দেয়ার বিষয়টিও অস্বাভাবিক বলে মনে করেন তারা। এর আগে জাতিসংঘ গৃহীত বেশ কিছু শান্তি আলোচনা প্রচেষ্টা ভেস্তে যাওয়ায় এই সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন তারা। আবার অস্ত্রবিরতি চুক্তির প্রস্তাবের মাধ্যমে সংকট সমাধানের উদ্যোগ গৃহীত হলেও সেটা কৌশলে এড়িয়ে গেছে দুইপক্ষই। সে ক্ষেত্রে সৌদি আরব এবং তার মিত্রপক্ষকেই সংকট সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে বলে মত দেন বিশ্লেষক শার্লট আলফ্রেড। তার মতে, সৌদি আরব হামলা বন্ধ করলেই শান্তি আলোচনা এবং অস্ত্রবিরতি চুক্তির পথ প্রশস্ত হবে। নইলে আমেরিকা এবং ইউরোপের রপ্তানি করা সমরাস্ত্রে হৌথি বিদ্রোহীর চেয়ে সাধারণ ইয়েমেনিই ধুঁকবে বেশি। ঠিক এখন যেমনটা হচ্ছে।