সিরীয় যুদ্ধে সংকটগ্রস্ত মানবিকতা ও বিশ্বের ঔদাসীন্য
মানুষের অনুভূতিজগতে বিপর্যয় ডেকে আনে যুদ্ধ। প্রথম গুলীর শব্দে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে যে ব্যক্তি, দেখা যায় লাগাতার বোমাবর্ষণ ও মৃত্যুর ঘটনার অভিজ্ঞতায় ভোঁতা হয়ে যায় তার স্পর্শকাতরতা ও চিত্যানুভূতি। ক্রমাগত যুদ্ধ ও তার বীভৎস মানসিক প্রতিক্রিয়া অনেক সময়ই নিরুপায় মানুষকে করে তোলে নিয়তিনির্ভর। পাশাপাশি যুদ্ধজনিত মানসিক অবস্থার কথা উপেক্ষা করে বহু সময়ই মানুষ যুক্তির মধ্য দিয়ে যুদ্ধের সমাপ্তি খুঁজতে তৎপর হয়ে ওঠেন। আসলে মানুষের সবচেয়ে বড় কাম্য হচ্ছে- স্বস্তিতে ও শান্তিতে বেঁচে থাকা। অব্যাহত যুদ্ধ কেউই চায় না।
সিরীয় যুদ্ধে বিশ্বের সংবেদনহীনতায় যুদ্ধগ্রস্ত ও আশপাশের বিবেকসম্পন্ন মানুষ বিস্মিত না হয়ে পারেন না। জনগণ আরও বেশি বিস্মিত ও মর্মাহত হন সিরীয় শিশুদের অকারণ ও অকাল মৃত্যুর মর্মান্তিক ঘটনায়। যখন-তখন, যেখানে-সেখানে যুদ্ধবিমানের হানায় ও বোমাবর্ষণের বিকট গর্জনে সিরিয়ার মানুষ আজ এত বেশি অভ্যস্ত এবং এত বেশি নির্বেদ ও নির্বিকার যে, যুদ্ধসৃষ্ট কোনো অনুভূতি বা চিন্তা তাদের মনে কোনো সাড়া যেন জাগায় না। জীবন ও সংসার নির্বাহের ভাবনায় ও কাজে তাদের ব্যস্ততাদৃষ্টে কেউ যদি মনে করেন, মানুষগুলোর চেতনার মৃত্যু ঘটেছে তাহলে তাকে দোষ দেয়া যাবে না। রেস্তোরাঁগুলো সেখানে আবার সরগরম হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে; প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছে নাইটক্লাবগুলো। যুদ্ধগ্রস্ত এলাকার মানুষ অস্ত্রাঘাতে মৃত্যুপথযাত্রী আহতকে নিয়ে যখন হাসপাতালের পথে ছুটছেন, ঠিক সে সময়ই দেখা যাচ্ছেÑ সরকারি বাহিনী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় শারীরিক সৌন্দর্য রক্ষায় যতœবান নারীরা দলে দলে ভিড় করছেন তাদেরই লক্ষ্য করে আয়োজিত প্রসাধনী দ্রব্যের মেলায়। গাড়ি দৌড় প্রতিযোগিতা চলছে। কোথাও চলছে সাড়ম্বর বৈবাহিক অনুষ্ঠান। আর যাই হোক, জীবন তো থেমে থাকতে চায় না। ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার ফর মিডল ইস্ট স্টাডিজের ডিরেক্টর জোসুয়া ল্যান্ডিজ বলেন, বিদ্রোহী যোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় অনবরত সশস্ত্র হামলায় ত্রাস সৃষ্টি করে রাখা ও বিদ্রোহীদের বিধ্বস্ত করা এবং নিজের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য উপচে পড়ছে। দুনিয়ার সামনে সিরিয়ার এই চিত্র তুলে ধরে নিজেকে একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক দেখানোই হচ্ছে প্রেসিডেন্ট আসাদের রণকৌশল।
সরকার নিয়ন্ত্রিত সিরীয় এলাকায় রাজপথ-গলিপথ ছেয়ে গেছে আসাদের ছবিসংবলিত পোস্টারে। দেখানো হচ্ছে, সফল যোদ্ধা আসাদকে। কোথাও আসাদ একজন স্বার্থকাম বণিক; কোথাও পিতার ভূমিকায় আসাদ। অন্য একটি পোস্টার শহরে সমান ঔজ্বল্যে শোভা পাচ্ছে- সেটি হচ্ছে হিযবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসারাল্লাহের।
দামেস্কের দক্ষিণাংশে গুতায় এবং মাত্র ১০ কিমি দূরে অবস্থিত ‘দুমা’য় রাসায়নিক বোমাবর্ষণে সামরিক-বেসামরিক অজস্র মানুষ হত্যায় আসাদ সরকারের লিপ্ততা সম্বন্ধে সরকার নিয়ন্ত্রিত এলাকার বাসিন্দারা যথোচিত ওয়াকিবহাল হওয়া সত্ত্বেও যথারীতি ক্যাফেতে, সমুদ্রসৈকতে ও নাইটক্লাবে ভিড় জমিয়ে যখন জীবনের আনন্দ আস্বাদন করে চলেছেন, সে সময়ই রাসায়নিক বোমাবর্ষণে সৃষ্ট ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে অসহায় ও নিরপরাধ নারী ও শিশুর লাশ টেনে তোলা হচ্ছে। মনে রাখতে হবে- অন্য কোথাও নয়, খোদ রাজধানী দামেস্কে অথবা রাজধানীর উপকণ্ঠে। স্বার্থের খাতিরে মানবিকতা বোধ মানুষ কতখানি বিসর্জন দিতে প্রস্তুত- প্রশ্নের জবাব রয়েছে সম্ভবত একমাত্র নৃবিজ্ঞানীদের কাছে, অন্য কারো কাছে নয়।
কারোর নির্বিঘ্ন জীবন ও সুখোল্লাস কামনায় বাধাদান করতে পারেন না কেউই। কিন্তু প্রতিবেশী ভাই-বেরাদরের অপঘাত মৃত্যু দুর্দশায় দৃকপাত না করে শুধু নিজের জীবন ও নিজের সুখ সম্ভগকেই জীবনের একমাত্র ধ্যেয় বিবেচনায় ব্যস্ত সমস্ত ব্যক্তিকে নিষ্ঠুর অনৈতিকতা ও অমানবিতার অপরাধে অপরাধী না ঠাউরে পারা যায় না। নিরপরাধ মানুষ চোখের সামনে অকারণ মৃত্যুবরণ করবে এবং আমি নির্বিকারচিত্তে স্বার্থসাধনে প্রবৃত্ত থাকবো- আল্লাহ আমায় পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন এজন্য নয়। পৃথিবীতে মানুষের অবতরণের সময়ই আল্লাহ মানুষকে জীবনযাপনের দিকনির্দেশনা দিয়ে পাঠিয়েছেন। জীবনযাত্রা পরিচালিত হতে হবে স্রষ্টা নির্দেশিত লক্ষ্যের পথে। পাশেই নির্দোষ মানুষ নিহত হবেন এবং আমি রইবো অবিচল- এমন জীবনযাপন হচ্ছে পশুজগতের বৈশিষ্ট্য; হৃদয় মনমস্তিষ্ক ও অনুভূতিসম্পন্ন মানুষের নয়।