বিনিয়োগ আকর্ষণে লন্ডনে রোড শো অনুষ্টিত
বাংলাদেশ মানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভবন ধস কিংবা রাজনৈতিক হানাহানির দেশ নয়। দেশটি রাজনৈতিক কারণে যতটা অস্থিতিশীল, অর্থনৈতিকভাবে তার চেয়ে বেশি স্থিতিশীল। প্রাকৃতিক দুর্যোগে যতটা বিপর্যস্ত, তার চেয়ে বেশি সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে। সমস্যাগুলোর প্রচার বেশি হলেও বাস্তবে বাংলাদেশের ইতিবাচক দিক ও সম্ভাবনা অসীম। যে কারণে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে বিনিয়োগ আকর্ষণে বৃহস্পতিবার লন্ডনে অনুষ্ঠিত রোড শো’তে এ কথাগুলোই ওঠে আসে বক্তাদের কণ্ঠে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের উদ্যোগে পূর্ব লন্ডনের বাণিজ্যিক এলাকা ক্যানারি ওয়ার্ফের একটি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় ওই রোড শো। গতকাল ছিল দুদিনের এ আয়োজনের প্রথম দিন।
চারটি ভিন্ন ভিন্ন সেশনে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক ই এলাহি চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান, বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান সাইদ এ সামাদ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বাংলাদেশের অর্জন ও বিনিয়োগের সুযোগসুবিধাগুলো তুলে ধরেন।
রোড শো’তে যুক্তরাজ্যপ্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ব্রিটিশ বিনিয়োগকারীরাও অংশ নেন। লেডউড নামে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির হিসাব নির্বাহী পিটার কর্নিশ, গ্রেডলিংক ইউকের পরামর্শক ডেভিড গি, আইএম পাওয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গর্ডন জে ডিকি এবং স্পেন্সার্স নামে একটি কোমল পানীয় প্রস্ত্ততকারক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি মার্ক কিংসহ উপস্থিত বেশ কয়েকজন সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
তাঁরা বলেন, রোড শোতে এসে বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের ধারণা অনেকখানি বদলে গেছে। এদের কেউ জ্বালানি, কেউ শিক্ষা আবার কেউবা পণ্য উৎপাদন খাতে বিনিয়োগের কথা বিবেচনা করছেন। টেলিযোগাযোগ খাতে আগ্রহী পিএনও মার্কেটিং কোম্পানির নিল এন্ডারসন বলেন, গতকালের সেমিনারে মূলত আর্থিক খাত নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ফলে তাঁর আগ্রহের খাত নিয়ে খুব বেশি জানা সম্ভব হয়নি। তবে বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি অনেক কিছু জানতে সক্ষম হয়েছেন বলে জানান। তিনি বলেন, টেলিযোগাযোগ খাত সম্পর্কে জানতে তিনি দ্বিতীয় দিনের সেমিনারেও হাজির হবেন।
প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক ই এলাহি চৌধুরী বলেন, বর্তমান সরকার ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ জন্য দেশের যোগাযোগ, জ্বালানি, সেবা ও প্রযুক্তি খাত থেকে শুরু করে অবকাঠামো নির্মাণে বিপুল বিনিয়োগ দরকার। সরকার এসব খাতে বিদেশি ও বেসরকারি বিনিয়োগকে স্বাগত জানাচ্ছে। বিনিয়োগের জন্য সরকার প্রয়োজনীয় সকল সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করতে প্রস্তুত বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অর্জন তুলে ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, এক দশকের ব্যবধানে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দুই দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে বর্তমানে ২৬ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। যা বাংলাদেশের সাত মাসের আমদানি চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট। তিন বছরে মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৩ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশে। বিশ্বব্যাপী মন্দা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল রয়েছে। শুধু গত আগস্ট মাসেই রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে এর আগের মাসের তুলনায় ২৮ শতাংশ।
ডিজিটালাইজেশনের আওতায় এসেছে সমগ্র ব্যাংকিং খাত। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০১৫ সালে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে উল্লেখ করে গভর্নর বলেন, বাস্তবে চলতি বছর প্রবৃদ্ধি হবে ৭ শতাংশের বেশি। অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের অবদানের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, দেশের আর্থিক সম্পদের ৮০ শতাংশের মালিকানা রয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে।
বাংলাদেশে ব্যবসার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কোটস গ্রুপ পিএলসি ইউকের পল ফরম্যান, ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ব্যবস্থাপক কামরান বকর, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী আবরার এ আনোয়ার, গ্রিন ডেলটা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারজানা চৌধুরী ও গ্রামীণ ফোনের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা দিলিপ পাল। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব আবুল কালাম আজাদ, ব্লুমবার্গের এডিটর এট লার্জ গেভিন সার্কিন টম টেইলারসহ আরও অন্তত ২০ জন তাঁদের বক্তৃতায় বাংলাদেশে বিনিয়োগের সম্ভাবনা তুলে ধরেন।
রোড শো’তে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, পদ্মা ব্রিজ, রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, কর্ণফুলি নদীর নিচ দিয়ে টানেল নির্মাণ, ঢাকায় নতুন ফ্লাইওভার ও এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে নির্মাণ, পাঁচটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা, সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ ও কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠাকে বড় বিনিয়োগের অগ্রাধিকার হিসেবে তুলে ধরা হয়।