চ্যালেঞ্জের মুখে তুরস্কের একেপি পার্টি

Turkyমাসুমুর রহমান খলিলী: তুরস্কের আগামী ১ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য সংসদীয় পুনর্নির্বাচনে কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়েছে ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি)। গত ৭ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ১২ বছর ক্ষমতায় থাকার পর প্রথম একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় একে পার্টি। দল হিসেবে অধিক আসনে বিজয়ী হলেও সংসদের অন্য তিন দলের কোনোটির সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন সম্ভব হয়নি। ফলে প্রেসিডেন্ট এরদোগান ১ নভেম্বর পুনর্নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হলে একেপিকে ১৮টি আসন বাড়াতে হয়। এ আসন বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে আগের নির্বাচনে প্রাপ্ত ৪০.৯ শতাংশ থেকে ভোট ৩ থেকে ৪ শতাংশ বাড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে।
এ লক্ষ্য অর্জনের পথ নানা কারণে তুরস্কের বর্তমান পরিস্থিতিতে বেশ চ্যালেঞ্জের। এর একটি কারণ হলো তিন দফায় ক্ষমতায় থাকার পর সঙ্গত কারণেই স্টাবলিশমেন্ট-বিরোধী একটি মনোভাব সাধারণ ভোটারদের একটি অংশের মধ্যে সৃষ্টি হয়ে গেছে। তারা বিকল্প নেতৃত্ব দেখতে চাইছে। দ্বিতীয়ত, একে পার্টির ক্যারিসমেটিক নেতা রজব তাইয়েব এরদোগান প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর দলের প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দানের সুযোগ এখন আর তার নেই। বিকল্প হিসেবে দলের চেয়ারপারসনের দায়িত্ব নিয়েছেন আহমেদ দাভুতোগলুর। তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই দলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেও আন্তর্জাতিক পরিসরে তার যে ইমেজ রয়েছে, ততটা কারিশমা নেই অভ্যন্তরীণ জনমত ও রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে। এর ফলে দাভুতোগলুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রথমবারের নির্বাচনে দলের ভোট ৯ শতাংশের মতো কমে যায়, আর একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় দল।
পুনর্নির্বাচনে হারানো গরিষ্ঠতা ফিরে পেতে একে পার্টি ইতোমধ্যে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ও বাস্তবায়ন কমিটি পুনর্গঠন করে অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের আবার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন আরবাকান প্রতিষ্ঠিত দল সাদাত পার্টির সাথে নির্বাচনী সমঝোতার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। রক্ষণশীল ও জাতীয়তাবাদী ভোটারদের আবার দলের সমর্থক বলয়ে ফিরিয়ে আনতে একাধিক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদী পিকেকে গেরিলাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান চালিয়ে কুর্দি কট্টরপন্থী প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণে আনার প্রচেষ্টা গ্রহণ। একই সাথে সীমান্তের ওপারে তুরস্কের নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী আইএসের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এ দু’টি কাজে একে পার্টিকে কঠিন ঝুঁকি নিতে হয়েছে। প্রথমত, আইএসের বিরুদ্ধে অভিযানের ফলে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকিতে পড়তে পারে। ইতোমধ্যে একাধিক অন্তর্ঘাতী ঘটনা ঘটেছে, যার সাথে আইএসের সম্পৃক্ততার কথা বলা হচ্ছে। অন্য দিকে পিকেকে গেরিলাদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করার ফলে একে পার্টির শান্তিপ্রক্রিয়া শুরুর কারণে কুর্দিদের মধ্যে যে সমর্থন বলয় সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে ধস নামবে। ইতোমধ্যে কুর্দিপ্রধান এলাকায় একে পার্টির একাধিক অফিসে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া কুর্দি এজেন্ডার প্রতি পাশ্চাত্যের বিশেষ সমর্থন থাকার কারণে সরকারের এ পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের ক্ষেত্রে নেতিবাচক হিসেবে কাজ করতে পারে।
তুরস্কের একে পার্টির বিরুদ্ধে একধরনের সর্বাত্মক প্রচারাভিযান চালানো হলে দেশটির মধ্যে সৃষ্ট অস্থিরতা একে পার্টির প্রতি সমর্থন বাড়াতে পারে। একেপি ৭ জুনের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর পর তুরস্কের জাতীয় মুদ্রা লিরা রেকর্ড মাত্রায় মূল্য হারায়। নতুন বিনিয়োগে একধরনের স্থবিরতা নামে। অর্থনীতির বিকাশ হার কমে আসে। এ কারণে তুরস্কের স্থিতি প্রত্যাশীরা একে পার্টি একক সরকার গঠনের সক্ষম হওয়ার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করুক সেটি চাচ্ছেন।
২০০২ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর একে পার্টির ভোটপ্রাপ্তি ৩৪ শতাংশ থেকে ৫২ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে। এর মধ্যে রেফারেন্ডাম বাদ দেয়া হলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরদোগান সর্বাধিক ৫২ শতাংশের কাছাকাছি ভোট লাভ করেন। সংসদ নির্বাচনে ৭ জুনের আগের বার সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশের কাছাকাছি ভোট লাভ করে একেপি। স্থানীয় সরকারের একাধিক নির্বাচনে ভোটপ্রাপ্তির হার সংসদের তুলনায় কম ছিল। ৭ জুনের নির্বাচনে একে পার্টি ৪১ শতাংশ ভোট পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালেও এর আগে তার চেয়ে কম ভোট পেয়েও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে দলটি। এর কারণ ছিল কুর্দি দলগুলো তখন ন্যূনতম ১০ শতাংশ ভোটপ্রপ্তির স্তর পেরোতে না পারায় সংসদে গ্রুপ হিসেবে আসন তারা পায়নি। এর সুবিধা লাভ করেছে একে পার্টি। জুনের নির্বাচনে ১৩ শতাংশ ভোট পেয়ে কুর্দি দল এইচডিপি সংসদে ৮০টি আসন লাভ করে। এ ছাড়া রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী ভোটারদের মধ্যে যারা প্রেসিডেন্সিয়াল শাসনপদ্ধতির রূপান্তরকে সমর্থন করেনি, তারা এমএইচপিকে ভোট দিয়েছে। ফলে তাদের ভোটপ্রাপ্তি বেড়েছে।
পুনর্নির্বাচনের ক্ষেত্রে সেই মেরুকরণ আগের মতো না থাকারই সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে তুরস্কের পুনর্নির্বাচন নিয়ে যেসব জনমত জরিপ প্রকাশ হয়েছে তাতে একে পার্টির ভোটসংখ্যা ২ থেকে ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আভাস দেয়া হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল সিএইচপির ভোট কোনো কোনো জরিপে অপরিবর্তিত, আবার কোনো কোনোটিতে বাড়তে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য দিকে প্রায় সব জরিপে এমএইচপির ভোট ১ থেকে ৩ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে বলে আভাস দেয়া হয়েছে। এর একটি কারণ হিসেবে কাজ করেছে এমএইচপির ভোটারদের অনেকে কট্টর ভূমিকা নিয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠন উদ্যোগ ব্যর্থ করার জন্য এমএইচপি নেতৃত্বকে দায়ী করেন। কুর্দি দল এইচডিপির সমর্থন কুর্দি ভোট নিয়ে অপরিবর্তিত থাকলেও তুর্কিরা এবার আর একেপি ঠেকাতে এই দলটিকে ভোট দেবে বলে মনে হচ্ছে না। ফলে সার্বিক পর্যালোচনায় এইচডিপির ভোট কমতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তুরস্কে এরদোগান ও একে পার্টির প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক প্রভাবচক্রের ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়। তুরস্কের নির্বাচনে একেপির বিপর্যয়ের প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যের সার্বিক পরিস্থিতিতে পড়েছে। সিরিয়ার শরণার্থীরা তুরস্কে যে নিরাপদ আশ্রয় লাভ করেছিল তা অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ছুটেছে। ইউরোপ প্রাথমিকভাবে তাদের আশ্রয় দিতে না চাইলে এবং ভূমধ্যসাগরে শত শত শরণার্থীর সলিল সমাধি ঘটা এবং অন্যান্য মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনায় পাশ্চাত্যের প্রতি তীব্র চাপ সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে আইলান কুর্দি ও তার পরিবারের পিতা ছাড়া সবার করুণ মৃত্যুর ঘটনা বিশ্বজনমতে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এ অবস্থায় ইউরোপসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলো এক দিকে সিরিয়া ও ইরাকের শরণার্থীদের গ্রহণে বাধ্য হয়েছে, অন্য দিকে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে তাদের ভাবতে হচ্ছে। সেই সাথে তুরস্ককে অস্থির করে রাখার পদক্ষেপ পুরো ইউরোপে অস্থিরতার ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। এই বাস্তবতার ফলে তুরস্কে এরদোগান ও একে পার্টিকে ক্ষমতা থেকে বিদায় করার যেকোনো উদ্যোগ নেয়া হলে এ জন্য পাশ্চাত্যকে অনেক বড় মূল্য দিতে হবে বলে ইউরোপের নেতৃবৃন্দ উপলব্ধি করতে পারছেন।
তুরস্কের ১ নভেম্বরের পুনর্নির্বাচনের প্রভাব যে মধ্যপ্রাচ্যে বড়ভাবে পড়তে পারে, সেটি একপ্রকার নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক পরিসরে মধ্যপন্থী ইসলামপন্থীদের যে পৃষ্ঠপোষকতা তুরস্ক ও এর নেতা এরদোগান এত দিন দিয়ে আসছিলেন, সেটিকে কমিয়ে আনার ব্যাপারে চাপে থাকতে পারেন তিনি। ইতোমধ্যে তুরস্কের রাজনীতিতে সৃষ্ট অস্থিরতার কারণে মিসর থেকে তুরস্কে আশ্রয় নেয়া মুসলিম ব্রাদারহুডের অনেক নেতা আঙ্কারা ছাড়তে শুরু করেছেন। বিকল্প আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ইউরোপকে বেছে নিচ্ছেন তাদের মধ্যে অনেকে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তুরস্কের ১ নভেম্বরের নির্বাচন শুধু দেশটির অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ তাই নয়; একই সাথে এটি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button