প্রজন্মবান্ধব এক স্বপ্নযাত্রীর মহাপ্রয়াণ
মো. আবুল হাসান/খন রঞ্জন রায়: ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও খ্যাতনামা পরমাণু বিজ্ঞানী এপিজে আব্দুল কালাম তরুণদের আকাশসমান স্বপ্ন দেখতে বলতেন। বলতেন জীবনের লক্ষ্য বড় করে স্থির করতে। এই অসামান্য স্বাপ্নিক এবং প্রত্যাশার কথক নিজের জীবনকেও পরিপূর্ণ করে তুলতে পেরেছিলেন। এই স্বপ্নযাত্রী গত ২৭ জুলাই না ফেরার দেশে চলে গেলেন ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলংয়ে তরুণ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করার সময় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন, পরে হাসপাতালে তিনি প্রাণত্যাগ করেন।
আবুল পাকির জয়নুল আবেদিন আবদুল কালাম ১৯৩১ সালের ১৫ অক্টোবর তামিলনাড়ুর উপকূল সংলগ্ন রামেশ্বর গ্রামের এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন নৌকার মাঝি। শৈশবেই তাঁকে জীবিকার তাগিদে কাজ শুরু করতে হয়। স্কুল শেষে সংবাদপত্র বিতরণ করতেন বাড়ি বাড়ি গিয়ে। গণিতে আগ্রহ থাকলেও পাঠ করেছেন পদার্থবিজ্ঞানে। পরে এ্যারোস্পেস নিয়ে পড়াশোনা করেন। এরপর তিনি সেনাবাহিনীর জন্য ছোট হেলিকপ্টারের নক্সা করতেন। ১৯৯২ সালে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য বিজ্ঞান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর ৭৯তম জন্মদিনকে জাতিসংঘ বিশ্ব ছাত্রদিবস হিসেবে ঘোষণা করে। চল্লিশ বছর ধরে বিভিন্ন বিজ্ঞান ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। শুধু ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে সফল ছিলেন তা নয়, ভারতের চন্দ্রযান অভিযানেরও তিনি পথিকৃৎ। অকৃতদার এই বিজ্ঞানী বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে নিয়েও মহৎ চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।
জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই প্রখ্যাত বিজ্ঞানী কাজ করে গেছেন দেশ ও মানুষের কল্যাণে। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন শেষে আর পাঁচজনের মতো অবসরে না গিয়ে তিনি জ্ঞানালোকে নবীন প্রজন্মকে দীক্ষিত করতে ঘুরেছেন ভারতের বিভিন্ন বিদ্যাপীঠে। এসেছেন বাংলাদেশেও। তাঁর লেখা বইগুলোতেও আছে স্বপ্ন ও জীবনকে জয়ী করার কথা।
জাতির প্রতি তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। রাষ্ট্রপতির দায়িত্বকালে তিনি ‘জনগণের রাষ্ট্রপতি’ হিসেবে পরিচিতি পান। ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান ও ড. জাকির হোসেন এর পর তিনি তৃতীয় রাষ্ট্রপতি যিনি ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব ‘ভারতরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত হন। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর যখন জানতে পারলেন তার সারাজীবনের ব্যয়ভার সরকারই বহন করবে, তখন প্রত্যন্ত গরিব গ্রামের মানুষের সেবায় প্রোভাইডিং আরবান অ্যামেনিটিস টু রুরাল অ্যারিয়স নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করে তার সব জমানো অর্থই দান করে দেন সেখানে।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ দু’টি প্রকল্প সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে দায়িত্ব পালন শেষে পঁচাত্তর বছর বয়সে শুরু করেছিলেন তরুণদের নিয়ে নতুন আন্দোলন ‘হোয়াট ক্যান আই গিভ’। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই আন্দোলনের মাধ্যমে তরুণদের পথ দেখিয়েছেন। এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল তরুণদের মধ্যে এই বোধ জাগ্রত করা যে, সমাজ বা রাষ্ট্র কী দিয়েছে, তা ভাবার আগে ভাবতে হবে আমি সমাজকে কী দিতে পারি।
যদিও তিনি ৮৩ বছর বয়সে মারা গেছেন, তবুও মনে হয় আসলে তার অকালমৃত্যু হয়েছে। কিছু কিছু মানুষ থাকেন, যারা যত পরিণত বয়সেই মারা যান না কেন, আমাদের কাছে সবসময়ই সেটা অকালমৃত্যুই মনে হয়। কারণ তারা পৃথিবীকে প্রতিদিন এতকিছু দিয়ে যান যে, আমাদের স্বার্থেই তাদের বেঁচে থাকা প্রয়োজন। এপিজে আবদুল কালাম ছিলেন সে ধরনের ব্যক্তি। যত দিন বেঁচে ছিলেন, পৃথিবীকে শুধু দিয়েই গেছেন। তিনি মৃত্যুর পূর্বমুুহূর্তেও বাংলাদেশের সীমান্তের ওপারেই শিলং শহরে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টের ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে ‘বসবাসযোগ্য একটি পৃথিবী’ নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছিলেন।
তিনি একাধিকবার বাংলাদেশে এসে নতুন প্রজন্মকে উজ্জীবিত করেছেন। জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ, জ্ঞান আহরণ, অনেক বড় সমস্যায় পড়লেও লক্ষ্য থেকে সরে না আসা এবং কোনো কাজে সাফল্য ও ব্যর্থতা দু’টোকেই নেতৃত্বগুণে সামাল দিতে পারার বিষয় সমূহকে সাবলীলভাবে তরুণ প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন পরামর্শ ও আশাবাদ- কাউকে পরাজিত করা সহজ; কিন্তু কাউকে জয় করা অত্যন্ত কঠিন। এটি আমাদের সবারই মনে প্রাণে বিশ্বাস করা উচিত সবাইকে বড় স্বপ্ন দেখার পাশাপাশি তা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করার পরামর্শ দিতেন এমন কিছু করে যাওয়ার কথা বলতেন যাতে আমাদের অনুপস্থিতিতেও পৃথিবী আমাদের মনে রাখে।
সমস্যাকে কখনো এড়িয়ে যেতে না করেছেন। বরং সমস্যা এলে তার মুখোমুখি দাঁড়ানোর কথা বলেছেন। সমস্যাবিহীন সাফল্যে কোনো আনন্দ নেই বলেও দৃঢ়ভাবে বলতেন। জ্ঞান আহরণ থেকে কখনো বিরত না থাকার কথা বলতেন। এই জ্ঞানই অন্য গুলাবলি অর্জনে সাহায্য করবে। নিজেকে অনন্যসাধারণ করে তোলার চেষ্টার কথা বলতেন। আমাদের চারপাশের পৃথিবী সর্বদা সাধারণের কাতারে নিয়ে আসার চেষ্টায় লিপ্ত। হতাশ না হয়ে নিজেকে স্বপ্নপূরণের কতটা কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারছি সেদিকে নজর রাখার কথা বলতেন। তিনি বলতেন, মানব সমাজে সমস্যা থাকা প্রয়োজন সাফল্য উপভোগের জন্য। মা, বাবা ও শিক্ষক, এই তিন স্তরের মানুষই পারেন তরুণদের যথাযথ শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে দেশ ও সমাজকে উন্নত করতে। ড. কালাম রচিত ‘ইন্ডিয়া টোয়েন্টি টোয়েন্টি’ গ্রন্থে যে আশাবাদ ব্যক্ত হয়েছে, তা আমাদেরও আশাবাদী করে তোলে। তিনি ২০২০ সালের মধ্যে ভারতেক ‘নলেজ সুপারপাওয়ার’ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন।
তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। দেশটি পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতি ও জনবহুল। বেকারের সংখ্যাও ভয়াবহ। কারণ আমাদের দেশে পর্যাপ্ত শিল্প-কলকারখানা নেই। শিক্ষিত-অশিক্ষিত বেকার যুবকদের আত্ম-কর্মসংস্থান ও চাকরির তেমন সুযোগ-সুবিধাও নেই। ফলে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বাড়া মানেই বেকারত্বের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া। আর আমাদের দেশের বেকারের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। ১৬ কোটি মানুষের দেশে ৩ কোটি বেকার এ সংখ্যাটি দেশের উন্নয়নের অন্তরায়। আর বেকারত্ব জীবন যুবকদের কাছে একটি অভিশাপ। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের প্রতিটি পরিবারের কর্তাব্যক্তি মনে করে তাদের সন্তানরা লেখাপড়া শিখে একটি ভালো চাকরি পেয়ে বাকি জীবনটা আরাম-আয়েশে কেটে যাবে। তরুণদের শিক্ষা প্রশিক্ষণের অভাবে স্বপ্ন স্বপ্নেই থাকে। স্বপ্নের সাথে বাস্তবের ফারাক যোজন যোজন। বেকার তরুণ জনগোষ্ঠীকে দিয়ে কোন জাতির স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয় না।
ডিপ্লোমা শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি অগ্রসর হতে পারে না। ডিপ্লোমা শিক্ষার টার্গেটে দিন দিন পরিবর্তন ঘটছে। বিশ্বায়ন, প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, সমাজের চাহিদার পরিবর্তনের সাথে সংগতি রেখে ডিপ্লোমা শিক্ষার উদ্দেশ্য ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে। সকল দেশেই পণ্য ও পেশাভিত্তিক ডিপ্লোমা কোর্স চালু করে দরিদ্র, প্রতিবন্ধী, কর্মমেধাবী, দুর্গম এলাকার তরুণদের কর্মক্ষম হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। ডিপ্লোমা শিক্ষা গ্রহণ করে ছোট ছোট স্বপ্নগুলোকে সম্মিলিতভাবে বড় স্বপ্নে বাস্তবায়ন হচ্ছে। ডিপ্লোমা শিক্ষা গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশের সুচিন্তার ফসল বিভাগীয় ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আন্তর্জাতিকমানের শিক্ষা পদ্ধতি অনুসরণ করে তরুণদের প্রয়োজনীয় ডিপ্লোমা শিক্ষার সুযোগ করে দেওয়া ও শিক্ষা-সংস্কৃতি, ক্রীড়া, সামাজিকতার মাধ্যমে তাদেরকে সুন্দর সন্তান হিসেবে গড়ে তোলা। তাহলে একজন ছাত্র শুধু শিক্ষা জীবন পর্যন্ত নয় সারা জীবন নতুন নতুন স্বপ্ন দেখতে উদ্বুদ্ধ হবে।
ড. কালাম আমাদের মধ্যে না থাকলেও তার স্মৃতি ও কর্ম আমাদের জ্ঞান, বিজ্ঞান ও মানবিকতার পথে পরিচালনা করবে। মৃত্যু যে কোনো মানুষের অনিবার্য পরিণতি, মৃত ব্যক্তির স্মৃতি ও কর্ম হচ্ছে অক্ষয় সম্পদ। আমরা বিশ্বাস করি বাংলাদেশের তরুণ সমাজের কাছেও ‘জনগণের রাষ্ট্রপতি’ এপিজে আবদুল কালামের স্মৃতি ও কর্ম অক্ষয় সম্পদ হয়ে থাকবে। তাকে স্মরণ ও অনুসরণ করে আমরা তার স্বপ্নের পথ ধরে জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও মানবিকতায় নিজেদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে যাবো- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।