বিবিসি’র বিশেষ ডকুম্যান্টারী
অন্যরকম উচ্চতায় ইস্ট লন্ডন মসজিদ
তাইছির মাহমুদ: মসজিদ, মাদ্রাসা, ইসলামিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা মুসলিম কমিউনিটি সম্পর্কে ব্রিটেনের মূলধারার একশ্রেণীর মিডিয়ার নেতিবাচক প্রচারণা যখন একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার, সেই মুহূর্তে বিবিসি প্রচারিত একটি ডকুম্যান্টারি ইস্ট লন্ডন মসজিদ ও লন্ডন মুসলিম সেন্টারকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছে অন্যরকম উচ্চতায় । ‘ওয়েলকাম টু দ্য মস্ক’- নামক এ ডকুম্যান্টারিটি নির্মাণ করেন অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী ব্রিটিশ সাংবাদিক রব লিস। তিনি দীর্ঘ আট মাস ইস্ট লন্ডন মস্ক, লন্ডন মুসলিম সেন্টার ও মারিয়াম সেন্টার ঘুরে পর্যবেক্ষণ করে এটি নির্মাণ করেন। ফিল্মিংকালে তিনি পর্যবেক্ষণ করেন- কীভাবে নামাজ পড়া হয়, কীভাবে ম্যানেজম্যান্ট মিটিং হয়, এমনকি কীভাবে অজু করা হয়। তিনি তার এক সৎ ভাই মুসলমান হলেও উগ্রপন্থা বেছে নিয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন। ডকুম্যান্টারিটি গত ৩০ সেপ্টেম্বর বুধবার রাত ৮ টায় বিবিসিতে প্রচারিত হওয়ার পর মুসলিম ও ননমুসলিম সোসাইটিতে ব্যাপক সাড়া পড়ে। ইস্ট লন্ডন মসজিদ যে শুধু নামাজেরই স্থান নয়, বরং এখানে কমিউনিটির মানুষের সেবায় বহুমুখী কার্মকা- পরিচালিত হয়ে থাকে তা অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটে ওঠেছে ডকুম্যান্টারিতে। এতে ইস্ট লন্ডন মসজিদের প্রাইমারী স্কুল, সেকেন্ডারী স্কুল, বিজনেস সেন্টার, ফিটনেস সেন্টার, ফ্রি লিগ্যাল সার্ভিস, ম্যারেজ ব্যুারো ইত্যাদি সার্ভিসের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইস্ট লন্ডন মসজিদ ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ মসজিদ হওয়ায় এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি সবসময়ই মূলধারার মিডিয়ার তীর্যক দৃষ্টি থাকে।
মসজিদের ভেতরে গোপনীয় কার্মকা- পরিচালিত হয়ে থাকতে পারে- এমন ভ্রান্ত ধারণাও পোষণ করে কোনো কোনো মিডিয়া। কিন্তু এবার একজন ব্রিটিশ সাংবাদিক তাঁর পেশাগত দায়িত্বপালনের জন্য দীর্ঘ ৮ মাস মসজিদের ভেতরের কার্মকা- পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে- মসজিদ সকলের জন্য উন্মুক্ত একটি জায়গা। এখানে গোপনীয় কিছু থাকতে পারে- এমন ধারণা পোষণ করা সম্পুর্ণ অমূলক। মুসলমান কমিউনিটি সম্পর্কে এক শ্রেণীর মিডিয়ার নেগেটিভ প্রচারণা নন মুসলিমদের মধ্যে যে নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়ে থাকে, বিবিসির ডকুম্যান্টারী এই বিভ্রান্তি দূর করতে সহায়তা করবে বলে মনে করছেন বিশিষ্টজন। রব লিস তাঁর ডকুমেন্টারিতে লন্ডনে ইসলামবিদ্বেষী কার্মকা-ের ভয়াবহ বিস্তারের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে তুলে ধরেছেন। সত্তর এবং আশির দশকে ইমিগ্রান্টস কমিউনিটি প্রতিনিয়ত বর্ণবাদী হামলার শিকার হতেন। স্কুলে যাতায়াতের পথে তাঁদের সন্তানদের ব্রিটিশ ন্যাশনাল ফ্রন্টের বর্ণবাদীরা অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতো এবং যখন-তখন হামলা চালাতো। এটা ছিলো তখনকার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এখন আগের মতো বর্ণবাদ না থাকলেও অন্যভাবে আছে। আগে ইমিগ্রান্টরা বর্ণবাদের শিকার হতেন, আর এখন তাদের ছেলেমেয়েরা ইসলামবিদ্বেষী আক্রমনের শিকার হয়ে থাকেন। স্কুল কলেজে তাদেরকে একটি প্রশ্নের মুখোমুখী হতে হয়? তারা কি আইএস সম্পর্কে জানে? আইএস এর সাথে কি তাদের কোনো সম্পর্ক আছে? তারা কি চরমপন্থী? শুধু মুসলমান হওয়ার কারণে তাদেরকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। এটা অন্যরকম এক বর্ণবাদ বলে মন্তব্য করা হয় ডকুম্যান্টারিতে।
সম্প্রতি পূর্ব লন্ডনের বেথনাল গ্রীন একাডেমি থেকে তিন স্কুলছাত্রী সিরিয়ায় আইএস-এ যোগদানের পর একশ্রেণীর ডানপন্থী মিডিয়া যেভাবে ইস্ট লন্ডন মসজিদকে জড়িয়ে নানা অপপ্রচার শুরু করে তাও উঠে আসে ডকুম্যান্টারিতে। মিডিয়া ছাড়াও সরকারের বিভিন্ন পলিসির কারণে ইস্ট লন্ডন মসজিদকে যে প্রায়শই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয় তাও উল্লেখ করেন সাংবাদিক রব লিস। ডকুম্যান্টারিতে দেখানো হয়, আইএস এর বিরুদ্ধে ইস্ট লন্ডন মসজিদ কথা বলার কারণে একটি গোষ্ঠী মসজিদে এসে বিশৃংখলা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তাদেরকে মসজিদ থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। আইএস ইসলামের নাম নিয়ে যা করছে তা কোনোভাবেই ইসলামিক কাজ নয়- কথাগুলো তুলে ধরা হয়েছে মসজিদের এক তরুণ ভলান্টিয়ারের ভাষ্যে। এতে করে ইস্ট লন্ডন মসজিদের সংস্পর্শে বেড়ে ওঠা তরুণ প্রজন্ম যে চরমপন্থার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ তাও ফুটে উঠে। মসজিদের কমিউনিকেশন অফিসার সালমান ফার্সি সিরিয়াগামী তিনছাত্রীকে ফিরিয়ে আনতে তাঁর পরিাবারকে সহযোগিতা করছেন বলে দেখানো হয়। এতে করে বিভিন্ন স্পর্শকাতর বিষয়ে কমিউনিটির মানুষের সাহায্যে ইস্ট লন্ডন মসজিদ কীভাবে ভুমিকা রাখে সেই চিত্র ফুটে ওঠে। ডকুম্যান্টারিতে মারিয়াম সেন্টারে মহিলাদের পৃথক নামাজের হল দেখিয়ে সাংবাদিক রব লিস বলেন, বহুজাতিক ব্রিটিশ সোসাইটিতে সেগরিগেশনের (পুরুষ-মহিলার পৃথক বসার ব্যবস্থা) বিষয়টি তাঁকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তিনি এ ব্যাপারে জানতে সাক্ষাৎ করেন ইমাম ও খতীব শায়খ আব্দুল কাইয়ূম এর সাথে। প্রশ্ন করেন, মসজিদে সেগরিগেশনের কারণ কী? জবাবে ইমাম আব্দুল কাইয়ূম বলেন, আমরা এখানে কুরআন ও হাদীসের নির্দেশ মতো চলি। যে কারণে মুসলমানদের শুকরের মাংস খাওয়া বৈধ নয়, যে কারণে আমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, সেই এই একই কারণে আমাদের সেগরিগেশন করতে হয়। এটা আল্লাহর নির্দেশ। সেগরিগেশন ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশনা জানতে পেরে তাঁর কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। রব লিস ঘুরে বেড়ান লন্ডন মুসলিম সেন্টারে অবস্থিত সেকে-ারি স্কুল লন্ডন ইস্ট একাডেমীতে। ডকুম্যান্টারিতে স্কুলের ছাত্ররা বলেন, এক সময় অফস্ট্যাডের কর্মকর্তারা স্কুল পরিদর্শনে এলে ছাত্রদেরকে লেখাপড়া নিয়ে প্রশ্ন করতেন। এখন প্রশ্ন করা হয় আইএস সম্পর্কে। মুসলিম শিক্ষার্থীদেরকে সবসময় সন্দেহের চোখে দেখা হয়। এটা বড়ই দুঃখজনক। তাছাড়া সাম্প্রতি দেড় মিলিয়ন পাউ-ে ইস্ট লন্ডন মসজিদ সংলগ্ন সিনাগগ ক্রয়ের বিষয়টি দেখানো হয়। চ্যানেল এস স্টুডিওতে ফান্ডরেইজিং অনুষ্ঠানের দৃশ্য দেখিয়ে সিনাগগ ক্রয়ে কমিউনিটির মানুষের স্বতম্ফুর্ত সাড়া দেয়ার বিষয়টি ইতিবাচক দৃষ্টিতে তুলে ধরা হয়। উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে ব্রিটিশ সাংবাদিক রব লিস- এর দুটো ডকুম্যান্টারি ‘মাই ব্রাদার দ্য ইসলামিস্ট’ এবং ‘মাই ব্রাদার দ্য টেরোরিস্ট’ বিবিসিতে প্রচার হওয়ার পর ব্যাপক সাড়া পড়ে। গুগলে ওয়েলকাম টূ দ্য মস্ক টাইপ করে সার্চ করলেই বিবিসি আইপ্লেয়ারে দেখা যাচ্ছে এই ডকুম্যান্টারী।