ইসলামী সাহিত্যের অনন্য সাধক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান
সাদিক আহমদ: আজ থেকে প্রায় তিন দশক পূর্বের কথা। আমি তখন সপ্তম কিংবা অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। ১৯৮৫/’৮৬ ঈসায়ী সাল। সবেমাত্র মাসিক ‘মদীনা’ ম্যাগাজিনটির সাথে পরিচিত হলাম। জনৈক হিতাকান্কীর মাধ্যমে এর দু’একটি কপি আমার হস্তগত হলো। কী অপূর্ব নাম! মাসিক ‘মদীনা’! আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র হিজরতগাহ্ ‘মদীনাতুন্নবী’ (সা.) (পূর্ব নাম-ইয়াসরিব)-এর বরকতময় নামে নামকৃত ‘মদীনা’ নামটি প্রত্যেক ঈমানদারের হৃদয় মন সহসাই কেড়ে নিতে সক্ষম। তাই ম্যাগাজিনটির এ সুন্দর ও চমকপ্রদ নামটি আমাকে দারুণ প্রভাবিত করে। কবির ভাষায় বলা যায়ঃ ভালোবাসা চাইনি খোদা, লন্ডন আমেরকিার- ‘মদীনা’ প্রেমিক হতে চাই মোরা, এই হলো আবদার।
যাক- প্রাতিষ্ঠানিক/দরসী জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি ইসলামের বৈষয়িক/বিবিধ জ্ঞানানুশীলনের অদম্য বাসনায় প্রিয়নবীজীর প্রিয়শহর, ইসলামের প্রসারকেন্দ্র ও নবীজীর সর্বশেষ কর্মস্থল পবিত্র ‘মদীনা’র বরকতময় নামে নামকৃত এ ম্যাগাজিনটির (মাসিক ‘মদীনা’) গ্রাহক হওয়া ও নিয়মিত অধ্যয়নের জন্য মন ব্যাকুল হয়ে উঠলো। আলহামদুলিল্লাহ! কিছুদিন যেতে না যেতেই সেই তৃষ্ণা মেটানোর এক সুবর্ণ সুযোগ এসে পড়লো। স্থানীয় একটি মাদ্রাসার জনৈক শ্রদ্ধাভাজন উস্তাদ ‘মদীনা’র এজেন্ট হলেন। আমি নিয়মিত উনার কাছ থেকে পত্রিকাটি সংগ্রহ করতে লাগলাম। সেই থেকে অদ্যাবধি মাসিক মদীনা ও এর সম্পাদক সাহেবের সাথে আমার সম্পর্ক ও হৃদ্যতা। তখন থেকেই আমি মাসিক ‘মদীনা’র প্রতিটি কলাম গভীর মনযোগের সাথে পড়তাম এবং নিজেও কিছু লেখালেখি করা যায় কি না তা নিয়ে ভাবতাম। এমন ভাবোদয়ের মধ্যেই একদিন মাসিক ‘মদীনা’র মাননীয় সম্পাদক সাহেবের পরামর্শ ও সহযোগিতা কামনা করে তার নিকট একটি পত্র লিখলাম। অধমের ন্যায় একজন সাধারণ পাঠকের প্রতি সামান্যতম অবজ্ঞা না দেখিয়ে শ্রদ্ধাভাজন সম্পাদক সাহেব অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পত্র পাঠালেন। তার প্রেরিত জবাবী পত্রখানা পেয়ে এ অধম কতটুকু প্রীত ও আনন্দিত হয়েছিলো তা ভাষায় ব্যক্ত করা অসম্ভব।
উল্লেখ্য যে, শ্রদ্ধাভাজন দাদা মরহুম, ঐতিহ্যবাহী বানিয়াচঙ্গের তৎকালীন যুগের বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন, উস্তাদুল উলামা আল্লামা আব্দুর রহমান (রাহ.) (মৃত্যুঃ বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক)-এর জীবনীমূলক একটি নিবন্ধ ইতোমধ্যেই তৈরি করেছিলাম। এটি মাসিক মদীনা’য় ছাপানো যাবে কি না তা জানতে চেয়ে সম্পাদক সাহেব বরাবরে একটি পত্র পাঠিয়েছিলাম। সম্পাদক সাহেব আমার সেই পত্রের উত্তর ০৬ ডিসেম্বর ’৯২ইং তারিখে লিখে পাঠালেন। একজন নবীন লেখক হিসেবে আমার নিকট এ পত্রটি ছিলো যেন চাঁদ হাতে পাবার নামান্তর।
তিনি লিখলেন, “জনাব! সালাম বা’দ আরজ; আপনার পত্র পেয়েছি। জবাবে আরজ, লেখা পাঠাতে পারেন। মুদ্রণ উপযোগী হলে অবশ্যই মদীনাতে প্রকাশ করা হবে। লেখা না দেখে তা প্রকাশ করা যাবে কি না তা অগ্রিম বলা সম্ভব নয়। তবে নতুন লেখকগণকে সব সময়ই আমি বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। আমার লক্ষ্য নতুন নতুন লেখক তৈরি করা এবং আল্লাহর রহমতে মাসিক ‘মদীনা’ এ পর্যন্ত অনেক নতুন লেখক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। আরো অনেক নতুন লেখক চাই। আপনি শ্রম স্বীকার করতে রাজি থাকলে আমার পরিপূর্ণ সহযোগিতা পাবেন। আপনাদের সার্বিক সহযোগিতা কাম্য।”
পত্র পেয়ে কালবিলম্ব না করে জীবনের প্রথম লেখাটি মাসিক মদীনায় ছাপানোর জন্য মদীনা কার্যালয়ের ঠিকানায় ডাকযোগে পাঠিয়ে দিলাম। আর এ লেখাটি মনোনীত হলো কি না তা জানানোর অনুরোধ জানিয়ে সম্পাদক সাহেব বরাবরে একটি পত্রও লিখলাম। আলহামদুলিল্লাহ! মাননীয় সম্পাদক সাহেব যথাসময়ই উত্তরপত্র পাঠালেন। উত্তর পত্রের মাধ্যমে জানতে পারলাম, আমার ওই লেখাটি হযরতের শুধু পছন্দই হয়নি বরং এ ধরনের আরো লেখা পাঠানোর জন্য তিনি আমাকে নির্দেশ দিলেন। আমার সেই প্রতিক্ষিত লেখাটি ‘বানিয়াচঙ্গের মাওলানা আব্দুর রহমান (রাহ.)’ শিরোনামে মাসিক ‘মদীনা’র মার্চ ১৯৯৩ইং সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
মাসিক ‘মদীনা’ হলো লেখক সত্ত্বার সূতিকাগার। আর পরম শ্রদ্ধাভাজন সম্পাদক সাহেব আমার স্বপ্নের ডালপালাকে বিস্তৃত হওয়ার উপযোগী আলো বাতাস যেন সরবরাহ করলেন। কেননা মাননীয় সম্পাদক সাহেব সেদিন যদি আমার এ লেখাটি তার জননন্দিত পত্রিকা মাসিক ‘মদীনা’য় না ছাপাতেন এবং উত্তরপত্র পাঠিয়ে লেখালেখির প্রতি আমাকে উৎসাহিত না করতেন, তাহলে আমার সাহিত্য সাধনা হয়তো বা অঙ্কুরেই থেমে যেতো। তাই আমি তার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ। কেননা তার উদারতা ও মহানুভবতার পরশ পেয়েই এ অধম লেখালেখির জগতে অনুপ্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ ও সু-সাহিত্যিক আল্লামা মুহিউদ্দীন খান অপর একটি পত্রে লেখালেখি সম্পর্কে আমাকে উপদেশ দিতে গিয়ে লিখেছেন ‘লিখালেখির জন্য একটু পাগলামী ধরনের মনযোগ চাই’। যাক, বিভিন্ন সময়ে এ প্রাজ্ঞ লেখকের পরামর্শ পেয়ে আমি ধন্য হয়েছি, এখনো হচ্ছি। মূলত, তার সম্পাদিত ও প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাদ্বয় যথাক্রমে মাসিক ‘মদীনা’ ও সাপ্তাহিক ‘মুসলিম জাহানে’ আমার লেখালেখির হাতেখড়ি। অদ্যাবধি জাতীয় ও স্থানীয় অনেক পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও সাময়িকীতে লেখালেখির সুযোগ হয়েছে ও হচ্ছে এবং এ পর্যন্ত অধমের রচনা, অনুবাদ ও সম্পাদনায় ৬/৭টি মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখক, অনুবাদক ও গবেষক হযরতুল আল্লাম আলহাজ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান দামাত বারাকাতুহুম আমার সাহিত্যগুরু। অনেক লেখকের মতোই আমিও তার সাহিত্যশিষ্য। বলাবাহুল্য যে, মাসিক ‘মদীনা’র যুগোপযোগী ও ক্ষুরধার লেখনী আমাকে দারুণভাবে আকৃষ্ঠ করেছিলো। আর এ জন্যই মাননীয় সম্পাদক সাহেবকে একনজর দেখা, তার মুখ নিঃসৃত মূল্যবান বাণী শোনা ও তার সান্নিধ্যে যাবার একান্ত বাসনা সেই কৈশোরেই আমার মনে দানা বেঁধেছিল। আমার ওই আশা পূর্ণ হয়েছিল আজ থেকে অন্যূন দু’যুগ পূর্বে হবিগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামেয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া উমেদনগর (টাইটেল) মাদ্রাসায় অনুষ্ঠিত (যতদূর মনে পড়ে ‘শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিছে দেহলভী (রাহ.)-এর বৈপ্লবিক চিন্তাধারা’ শীর্ষক) এক সেমিনারে। ওই দিনই এ মহান ব্যক্তিত্বকে আমার জীবনের প্রথম দেখার সুযোগ হয়েছিল। প্রবাদ আছে ‘রতনে রতন চিনে’। তাই ‘মুহিউদ্দীন খান’ নামক এ মহারত্নকে যেমনি চিনেছিলেন সমকালীন বিশ্বের খ্যাতিমান অনেক উলামা-মাশায়েখ, সুধীবৃন্দ ও গুণীজন; তাকে তেমনি চিনেছিলেন এবং মূল্যায়ন করেছেন, ‘হবিগঞ্জের উলামা সমাজের পুরোধা ব্যক্তিত্ব, ইসলামী আন্দোলনের অগ্নিপুরুষ, হবিগঞ্জ ইসলামী সংগ্রাম পরিষদ’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মুজাহিদে মিল্লাত আল্লামা মুখলিসুর রহমান রায়ধরী (রাহ.) এবং তদীয় সুযোগ্য ভাগ্না, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মোফাস্সিরে কোরআন, শায়খুল হাদীছ আল্লামা তাফাজ্জুল হক (মুহাদ্দিছে হবিগঞ্জী) দা. বা. প্রমুখ মনীষীগণ। তাই দেখা যেতো উপরোক্ত দু’মনীষী এ গুণী ব্যক্তিকে তাদের নিজ নিজ মাদ্রাসার বার্ষিক সভায় এবং হবিগঞ্জের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মাহফিলে প্রায়ই দাওয়াত করে নিয়ে আসতেন। এমনি সুবাদে হবিগঞ্জ শিরিষতলায় আয়োজিত ইসলামী সংগ্রাম পরিষদের এক মহাসমাবেশে একবার এবং উমেদনগর টাইটেল মাদ্রাসায় বহুবার হযরতের (খান সাহেবের) মহা মূল্যবান বয়ান শুনার সৌভাগ্য এ অধমের হয়েছে। অবশ্য পরবর্তীতে এ মনীষীর সাথে আরো ঘনিষ্ঠ হবার, বারবার তার সাহচর্যে যাবার সুযোগ হয়েছে। মাসিক মদীনা কার্যালয়ে এবং উনার নিজ বাসভবনে বহুবার গিয়েছি, প্রত্যেক সাক্ষাতে অনেক উপদেশ, পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা পেয়ে খুবই উপকৃত হয়েছি। আর এ জন্য আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। একই সুবাদে নিজের লেখা বইপত্রগুলো তার করকমলে হাদিয়া পেশ করেছি। তিনি অত্যন্ত খুশী হয়েছেন এবং লেখালেখির ব্যাপারে আরো অগ্রসর হবার পরামর্শ ও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, প্রাণখোলে দো’য়া করেছেন। আলহামদুলিল্লাহি আ’লা যালিক! আল্লামা মুহিউদ্দীন খান এদেশের রত্ন, আমাদের গৌরব। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় ব্যক্তিত্ব, ইসলামী চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবী। তিনি বাংলা ভাষায় ইসলামী সাহিত্যের সফল রূপকার, জীবন্ত মহীরুহ ও কিংবদন্তী। এ দেশের মাটি ও মানুষ তার কাছে ঋণী। দেশ ও জাতির খেদমতে তার অবদান ইতিহাসের পাতায় চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে যুগ যুগ ধরে।