কাজী নজরুল ইসলাম : আল্লাহ’তে যার পূর্ণ ঈমান
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
কাজী নজরুল ইসলাম। সমগ্র বাংলায় খ্যাতি পেয়েছেন বিদ্রোহী কবির। অভিষিক্ত হয়েছেন বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায়। তার সৃষ্টিকর্ম বাঙালি মুসলমানদের জীবনে আজও জুগিয়ে চলেছে নিরন্তর প্রেরণা। আজ সেই প্রেরণার কবির প্রয়াণ দিবস। ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, গান, প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখা এবং সাংবাদিকতা করলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই খ্যাতিমান। বাংলা কাব্যে তিনি এক নতুন যুগ সৃষ্টি করেন। ইসলামী সঙ্গীত তথা বাংলা গজল রচনারও পথিকৃৎ তিনি। নজরুল প্রায় তিন হাজার গান রচনা এবং সুর করেছেন।
কবি নজরুল ধ্যানে-জ্ঞানে, নিঃশ্বাসে-বিশ্বাসে, চিন্তাচেতনায় ছিলেন পুরোদস্তুর মানবতাবাদী মুসলিম কবি। কবিতায়, গানে, গদ্যে সর্বত্র তার এই দৃষ্টিভঙ্গি উৎকীর্ণ। শোষিত বঞ্চিত মানুষকে তিনি উদ্বুদ্ধ করেছেন সাম্য ও ন্যায়ের বন্ধনে এক হয়ে শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হতে। ১৩০৬ থেকে ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ। অঙ্কের হিসাবে তার জীবনকাল ৭৭ বছরের। সৃষ্টিশীল ছিলেন মাত্র ২৩ বছর। এই ২৩ বছরের সাহিত্যজীবনে তার বিপুল সৃজনকর্ম বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তার ছড়ানো দ্রোহী চেতনা কাঁপিয়ে দেয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত।
ইসলামী ঐতিহ্য কাজী নজরুল ইসলামকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। ইসলামের পুনর্জাগরণ বা মুসলিম ঐতিহ্য নজরুলের কবিতায় বিপুলভাবে সংবর্ধিত হয়েছিল। তিনি সুফিতত্ত্ব বা সুফিবাদ দ্বারাও প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। ইসলামকে নজরুল তার বিশ্বাসে মণ্ডিত করে প্রকাশ করেছেন। সুতরাং নজরুলকে অন্যভাবে চিত্রিত করা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
কাজী নজরুল ইসলাম যেমন শোষিত মানুষের কবি, বিদ্রোহের কবি, মানবিকতার কবি, তেমনি ইসলামী আকিদা ও ইসলামী সাম্যবাদেরও কবি। ইসলামকে কবি মনে প্রাণে গ্রহণ করেছেন। আবির্ভাব ও তিরোভাব এই দু’টি কবিতার সমন্বয়ে তিনি রচনা করেন ফাতেহা-ই-দোয়াজদহম কবিতাটি। ইসলামী জোশ সঞ্জীবিত রাখার ক্ষেত্রে নজরুল তার কবিতা ও অন্যান্য রচনার মাধ্যমে অভাবনীয় ভূমিকা রেখেছেন। ইসলামের ঝাণ্ডাকে নজরুল সবার ঊর্ধ্বে ঠাঁই দিয়েছিলেন। আন্তরিক উচ্চারণে তিনি ছিলেন আল্লাহর রাহে নিবেদিত। নজরুল তাই উচ্চারণ করেন-
‘হাসানের মতো পিব পিয়ালা সে জহরের,
হোসেনের মতো নিব বুকে কহরের।
আসগর সম দিব বাচ্চারে কোরবান,
জালিমের দাদ নেবো, দেবো আজ গোর জান।’
নজরুল কাব্যে অধ্যাত্মবাদ এবং ইসলামী সাম্য সূচিত হয়েছে মানবিকতায়। তার ইসলামী কবিতা মানবাত্মার বিকাশ ও মানবিকতার উদ্বোধন। আধ্যাত্মিক শক্তি তার আপন আত্মার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। মানবিক ধর্ম হচ্ছে আত্মত্যাগ। এই আত্মত্যাগে ইসলাম আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। ভোগীদের সংহার করার প্রেরণা নজরুল কবিতায় উচ্চারিত-‘কোরবানিরই রঙে রঙিন পরে লেবাস
পিরহানে মাখরে
ত্যাগের গুল-সুবাস,
হিংসা ভুলে প্রেমে মেতে
ঈদগাহেরই পথে যেতে
হে মোবারকবাদ দীনের বাদশাহে।’
নজরুলের ইসলামী গানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য আমাদের দারুণভাবে মুগ্ধ করে এবং ধর্মীয় ভাবাবেগে আপ্লুত করে। তার ইসলামী চৈতন্য আমাদের আলোড়িত করে। তিনি তার বিশ্বাসকেই মণ্ডিত করেছেন ইসলামী গানে। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন ও কর্মভাষিক কাঠামো পেয়েছে তার কবিতায়-
‘কত যে রূপে তুমি এলে হযরত এই দুনিয়ায়।
তোমার ভেদ যে জানে আখেরি নবী কয় না তোমায়।
আদমের আগে ছিলে আরশ পাকে তার আগে খোদায়।
আদমের পেশানীতে দেখেছি তব জ্যোতি চমকায়।
ছিলে ইব্রাহিমের মধ্যে তুমি ফুল হলো তাই নমরুদের আগুন।
নুহের মধ্যে ছিলে তাই কিশতী তার ডুবলো না দারিয়ায়’
নজরুল তার কবিতায় দেখিয়েছেন যে, ইসলামের যে ধর্মীয় অনুশাসন, সেই অনুশাসনই প্রকৃত পক্ষে মানুষের ধর্ম। নজরুলের কবিতায় যে আত্মোপলব্ধি, সেই আত্মোপলব্ধিই হচ্ছে অধ্যাত্মবাদের মূল কথা; যা ইসলাম ধর্মের শান্তির উপলব্ধির সাথে একাত্ম- ১. ‘তৌহিদ আর বহুত্ববাদে
বেঁধেছে আজিকে মহাসমর
লা শরিক এক হবে জয়ী
কহিছে আল্লাহু আকবর’
২. ‘মান আরাফা নফসাহু ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু’
ইসলাম অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতো কাজী নজরুল ইসলামের অন্তরের অন্তঃস্তলে প্রবহমান ছিল। আর তাই ইসলামের অনুশাসনে তিনি তার যাপিত জীবনের আলো হিসেবে ভেবেছেন। আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলার অঙ্গীকার ও প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। বিশ্বাসে, কর্মে তার জীবনে ইসলাম ছিল অবিকল্প। ‘খেয়াপাড়ের তরণী’ কবিতায় নজরুল তাই উচ্চারণ করেন-
‘কাণ্ডারী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা
দাড়ি মুখে সারি গান লা-শরিক আল্লাহ।’
‘মহররম’ কবিতায় নজরুল উচ্চারণ করেন-
১. ‘ফিরে এলো আজ সেই মহররম মাহিনা,
ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।’
২. ‘লাল শিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া,
আম্মা লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া।’
পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার প্রতি প্রত্যয়ী হওয়াই নজরুলের ইসলামী গানের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহর প্রকৃতি সম্পর্কে নজরুল তাই উচ্চারণ করেন-
সকল রঙের খেলার ঊর্ধ্বে পরম জ্যোতি আল্লাহর
দেখেনি যেজন, বুঝিবে না এই আল্লাহর খেলা সংসারে;
নজরুলের কাব্যজীবন স্বভাব ও সচেতনতায় অসাধারণ স্বচ্ছ। কোনো অবস্থাতেই তিনি স্বজাতি ও স্বধর্মকে ভুলে যাননি। বরং রেনেসাঁসী মানুষ হিসেবে নজরুল মুসলিম রেনেসাঁর জন্য অকৃপণভাবে কবিতা ও গান রচনা করেছেন। নজরুল তাই উচ্চারণ করেন-
১. ‘আবুবকর উসমান উমর আলী হায়দার
দাঁড়ি যে এ তরণীর নাই ওরে নাই ডর।
কাণ্ডারী এ তরীর পাকা মাঝি-মাল্লা,
দাড়ি মুখে সারি গান- ‘লা-শরিক আল্লাহ।’
নজরুল হামদ ও নাত অসংখ্য রচনা করেছেন। আল্লাহর নৈকট্য লাভের ইচ্ছা, প্রার্থনা ও ক্ষমা ভিক্ষাই হচ্ছে হামদের শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য। ক্ষমা ভিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি যে বিচিত্র কৌশল প্রয়োগ করেছেন, তা আমাদের দৃষ্টি এড়ায় না। হামদে নজরুল নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেছেন পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার কাছে। এ ক্ষেত্রে তার মনে বিন্দুমাত্র দ্বিধা ও সংশয় ছিল না। কায়মনোবাক্যে নজরুল আল্লাহতায়ালার কাছে আত্মসমর্পণ করে উচ্চারণ করেন-
১. ‘করিও ক্ষমা হে খোদা আমি গোনাহগার অসহায়।’
২. ‘ইয়া আল্লাহ, তোমার দয়া কত, তাই দেখাবে বলে
রোজ-হাশরে দেখা দেবে বিচার করার স্থলে।’
৩. ‘দীন-ভিখারী বলে আমি
ভিক্ষা যখন চাইবো স্বামী,
শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিতে পারবে নাকো আর।’
মুসলমানদের সামাজিক তামুদ্দুনিক মননের ঐতিহ্যভিত্তিক রূপায়ণে অনির্বাণ প্রেরণার মশাল জ্বালিয়েছেন নজরুল। মুমূর্ষু সমাজের নিপীড়িত মানুষের আলেখ্য রচনার পাশাপাশি সমকালীন যুগসমস্যা ও ইসলামের আদর্শকে সমুন্নত করেছেন তিনি কবিতায়। কালের করালস্রোতে যা কোনো দিনই ভেসে যাওয়া তো দূরে থাক, ম্লানও হবে না। নজরুল তার ঈমান রক্ষা ও সুদৃঢ় করার জন্য সমর্পিতচিত্তে ও আন্তরিক উচ্চারণে ইসলামী গান রচনা করেছেন-
১. ‘দিকে দিকে পুনঃ জ্বালিয়ে উঠিছে দীন ই ইসলামী লাল মশাল
ওরে বে খবর, তুইও ওঠ জেগে তুইও তোর প্রাণ প্রদীপ জ্বাল
গাজী মুস্তাফা কামালের সাথে জেগেছে তুর্কী সূর্য-তাজ,
রেজা পহলবী সাথে জাগিয়াছে বিরানমুলুক ইরানও আজ;
গোলামি বিসরি জেগেছে মিসরী জগলুল সাথে প্রাণ মাতাল।’
২. ‘বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা
শির উঁচু মুসলমান।
দাওয়াত এসেছে নয়া জমানার
ভাঙা কিল্লায় ওড়ে নিশান।
মুখেতে কলেমা হাতে তলোয়ার
বুকে ইসলামী জোশ দুর্বার
হৃদয়ে লইয়া এশক আল্লাহর
চল আগে চল বাজে বিষাণ।’
মদিনা নজরুলের কাছে কল্পনার প্রতীক নয়, আকাঙ্খা ও স্বপ্নের প্রতীক। তিনি আল্লাহকে নৌকা ভেবে সেই নৌকায় চড়ে মদিনায় যাবার আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছেন-
‘আল্লাহ নামের নায়ে চড়ি যাব মদিনায়
মোহাম্মদের নাম হবে মোর
ও ভাই নদী পথে পূবাল বায়।।
চার ইয়ারের নাম হবে- মোর সেই তরণীর দাঁড়
কলমা শাহাদাতের বাণী হাল ধরিবে তাঁর।
খোদার শত নামের গুণ টানিব
ও ভাই নাও যদি না যেতে চায়।’
মদিনাকে নিয়ে নজরুলের গুণগানের শেষ নেই। দ্বীনের দাওয়াত, দ্বীন প্রতিষ্ঠায় মদিনার রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। আমাদের প্রিয় নবী সে দেশে হিজরত করছিলেন। নবী দৌহিত্র হজরত হাসান-হোসেন ও নবী কন্যা হজরত ফাতেমাসহ অসংখ্য সাহাবির (রা.) পুণ্যস্মৃতিময় এই মদিনায় ভেসে বেড়ায় তৌহিদের বাণী। নজরুল তার কবিতায় এভাবেই ইসলামকে লালন ও ধারণ করেছেন। এর উল্টোটা মনে করা এবং নজরুলকে ভিন্নরূপে চিত্রিত করা- নজরুলের প্রতি অন্যায় আচরণ বিশেষ। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই।