রাশিয়ার জন্য আরেক আফগানিস্তান হচ্ছে সিরিয়া ?
অ্যালবাম ঘেঁটে একটি সাদাকালো ছবি বের করলেন আলেক্সান্ডার সোকোলভ। কাবুল সামরিক ঘাঁটির সামনে তোলা ছবিটি। ছবিটি ঝাপসা হয়ে গেলেও আফগানিস্তানে সোভিয়েত রাশিয়ার পরিণতি এখনো চকচকে সোকোলভের মনে।
রুশ বাহিনীর কমিউনিকেশন কর্মকর্তা হিসেবে আফগানিস্তানে দায়িত্ব পালন করা এই সাবেক সেনা কর্মকর্তা তাই নতুন করে সিরিয়ায় রুশ অভিযানের বিষয়ে উদ্বিগ্ন।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনই মূলত রাশিয়ার মুসলিম বিশ্বের ওপর ছড়ি ঘোরানোর স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দেয়। তবে রাশিয়ার বর্তমান প্রজন্মের ওপর সেই হস্তক্ষেপের প্রভাব নিয়ে যখনই আলোচনা হয় সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেন।
আফগানিস্তানে রুশ হস্তক্ষেপে ১৫,০০০ রুশ সেনা নিহত হয়েছে, যাদের অধিকাংশই বাধ্যতামূলকভাবে নিয়োগ দেয়া তরুণ। আরো কয়েক লাখ সেনা আহত ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে ফিরে এসেছে।
সোকোলভ আলজাজিরাকে বলেন, ‘তারা আমাদের ভুলে গেছে। ওই যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আছে এমন বেশিরভাগ সেনাই কষ্টে আছে। কেউ মদ পান করে, কেউ অসুস্থ কিংবা অচল হয়ে আছে; কিন্তু তাদের প্রতি সরকারের কোনো মনোযোগ নেই। এটি ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক’।
আরেক মৃত্যুকূপ
আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনাদের চলে যাওয়ার দুই যুগেরও বেশি সময় পার হয়েছে। রাশিয়ার পাঁচ ভাগের চার ভাগ (৮০%) লোকই মনে করেন সিরিয়ায় রুশ সেনাদের জন্য আরেকটি আফগান পরিণতি অপেক্ষা করছে।
অক্টোবরের শুরুতে একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপে দেখা যায় সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরোধীদের ওপর রুশ বিমান বোমা হামলা শুরুর পর রাশিয়ার শতকরা ৭৮ ভাগ মানুষ সিরিয়াকে তাদের জন্য ‘দ্বিতীয় আফগানিস্তান’ হবে বলে মনে করতে শুরু করেন।
একজন অবসরপ্রাপ্ত রাশিয়ান নারী জানান, ১৯৮২ সালে হেলিকপ্টার ক্রাশের পর তার এক আত্মীয়কে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়।
ব্যালেন্তিনা জর্জিয়েভনা নামের ওই নারী আলজাজিরাকে বলেন, ‘তাকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়। আমাদের জন্য সেটি অত্যন্ত দুঃখজনক একটি ঘটনা এবং এ কারণেই আমি আরেকবার অন্য কোনো দেশে সেনা মোতায়েনের বিপক্ষে।’
যুদ্ধবিরোধী সমাবেশ পুলিশের ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার প্রতি ইঙ্গিত করেন তিনি বলেন, ‘আমি অবশ্যই এর প্রতিবাদ করতাম, কিন্তু মানুষের কিডনি অকেজো করে দেয়া হয়েছে।’
প্রকাশিত ওই জরিপে দেখা গেছে, শতকরা ৭২ ভাগ লোক বিমান হামলার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করছে, অবশ্য ক্রেমলিন নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় বিমান হামলার ঘটনার সফলতার কথা বেশি বেশি প্রচারের একটা প্রভাব এখানে থাকতে পারে।
যদিও প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও তার মন্ত্রীরা বারবার বলছেন, কোনো রাশিয়ান সেনা সিরিয়ার মাটিতে পদাপর্ণ করবে না, তথাপি অনেক পর্যবেক্ষক নিশ্চিত যে, মস্কো অবশ্যম্ভাবীরূপে আরেকটি মৃত্যুকূপে পতিত হতে যাচ্ছে এবং সেখান থেকে অক্ষত অবস্থায় বের হয়ে আসতে পারবে না।
সামরিক বিশ্লেষক ও চেচেন যুদ্ধের রুশ কর্মকর্তা আরকাদি বাবচেনকো ওপেন রাশিয়া ওয়েবসাইটকে বলেন, ‘আমরা আমাদের জন্য একটি নতুন আফগানিস্তান পাবো। পাবো হাজার হাজার সেনা হারানোর আরো একটি দশক’।
সিরিয়ায় স্থল অভিযানের বিষয়ে রাশিয়ার শীর্ষ ইসলাম ও মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশ্লেষক অ্যালেস্কি মালাশেঙ্কো আলজাজিরাকে বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না যে ক্রেমলিন এমন বোকামি করবে’।
মার্কিন স্টাইলে যুদ্ধ
সিরিয়ায় রাশিয়ার বিমান হামলা শুরুর দুই সপ্তাহ আগে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে গাজিতা ডট আরইউ নামের একটি রাশিয়ান অনলাইন সংবাদপত্র অভিযোগ করেছে, অনেক রুশ সামরিক কর্মকর্তা সিরিয়ায় সেনা মোতায়েন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। কারণ তাদের কমান্ডাররা মোতায়েনকৃত সেনাদের মৃত্যু ও আহতদের ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতির আনুষ্ঠানিক ও লিখিত আদেশ দিতে অস্বীকার করেছেন।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে, তবে ওই কর্মকর্তাদের কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে বিচার করা হয়েছে বলে পত্রিকাটি বলেছে।
অক্টোবরের মাঝামাঝিতে মার্কিন কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকরা বলেছেন, সিরিয়ার লাতাকিয়া অঞ্চলের বিমান ঘাঁটিতে কয়েক শ’ রুশ পাইলট, উপদেষ্টা ও টেকনিশিয়ান মোতায়েন করা হয়েছে। তাদের নিরাপত্তার জন্য ৫০০ নৌ-সেনাকেও পাঠানো হয়েছে।
যদিও তাদের কেউ স্থল অভিযানে অংশ নেয়নি এবং সিরিয়ার ১৫০০ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থানকারী কাস্পিয়ান সাগরে মোতায়েনকৃত রুশ যুদ্ধজাহাজ বিমান হামলায় সহায়তা করছে।
থিঙ্ক ট্যাঙ্ক মস্কো কার্নেগি সেন্টারের কর্মকর্তা দিমিত্রি ত্রেনিনের মতে, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণ রাশিয়ার প্রথম ‘মার্কিন স্টাইলে যুদ্ধ’।
আফগানিস্তানে মস্কোর হস্তক্ষেপ থেকে সিরিয়ার হস্তক্ষেপের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন। আফগানিস্তানে হাজার হাজার স্থল সেনা সরাসরি সোভিয়েত সীমান্ত অতিক্রম করে প্রবেশ করেছে।
আবার উদ্দেশ্যগত পার্থক্যও রয়েছে। যেমন আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের উদ্দেশ্য ছিল একটি কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষণশীল আফগান সমাজের জীবনযাত্রা পাল্টে দেয়া। অন্য দিকে সিরিয়ায় রাশিয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে বাশার আল আসাদ সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা অথবা ইসলামিক স্টেটের হাত থেকে সিরিয়াকে মুক্ত রাখা। -আলজাজিরা