লন্ডনে একই মঞ্চে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান
দেশ রক্ষায় জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, গণতন্ত্রের জন্য অনেক সংগ্রাম করেছি। এবারো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারই আমার জীবনের প্রধান লক্ষ্য। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত লড়াই অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করেন তিনি।
রবিবার রাতে লন্ডনের পার্ক প্লাজার অডিটোরিয়ামে সুধী সমাবেশে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এসব কথা বলেন । যুক্তরাজ্য ও ইউরোপ প্রবাসীদের নিয়ে এ সভার আয়োজন করে যুক্তরাজ্য বিএনপি।
সুধী সমাবেশে প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন (বক্তব্য ইউটিউবে রয়েছে) বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এটাই মা-ছেলের আনুষ্ঠানিক কোনো বড় জমায়েতে একসাথে প্রথম বক্তৃতা। সভায় তারেক রহমানের সহধর্মীনি ডা. জোবায়দা রহমান উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘লেডি হিটলার’ অভিহিত করে বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, এক ব্যক্তি ক্ষমতার লোভে বাংলাদেশে ‘রাজতন্ত্র’ কায়েম করেছে। তার দুঃশাসনে দেশের মানুষ ভাল নেই। দেশে যা কিছু ঘটছে, সবকিছুর জন্য লেডি হিটলার শেখ হাসিনা ও তার বাহিনী জড়িত। এই অপশক্তিকে সরাতে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
প্রবাসীদের উদ্দেশ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, চিকিৎসা এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য লন্ডনে এসেছিলাম। এখন আমি সুস্থ্য। দীর্ঘ দিন পর একসঙ্গে কিছু সময় কাটিয়েছে। পরিবারের সদস্যরা আরো কিছুদিন থাকার আবদার করছে। কিন্তু দেশের মানুষ ভাল নেই। আমাকে দেশে ফিরে যেতে হবে। দেশে গিয়ে দল গোছানোর কাজকে গুরুত্বের সঙ্গে এগিয়ে নেবেন বলে জানান তিনি।
‘গণতন্ত্রহীন বলেই দেশে বিশৃঙ্খলা হচ্ছে’ উল্লেখ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেন, গণতন্ত্র নেই বলেই একের পর দুর্ঘটনা ঘটছে। আর এজন্য বিএনপিকে দোষারোপ করা হচ্ছে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সরকারই দায়ী। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। গণতন্ত্রে ফিরতে হবে।
দেশ রক্ষায় জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, গণতন্ত্রের জন্য অনেক সংগ্রাম করেছি। এবারো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারই আমার জীবনের প্রধান লক্ষ্য। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত লড়াই অব্যাহত রাখার অঙ্গীকারের কথা বলেন খালেদা জিয়া।
ভবিষ্যতে প্রতিহিংসা নয়, ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ চালানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বলেন, বিভক্তি নয়-আমরা একতায় বিশ্বাস করি। প্রবাসীদের মেধা ও অভিজ্ঞতাকে দেশ গঠনের কাজে লাগানোর পরিকল্পনার কথা জানান তিনি।
খালেদা জিয়া বলেন, বাংলাদেশের মানুষ আজকে মোটেও ভালো নেই, মোটেও শান্তিতে নেই। প্রতিনিয়ত জুলুম-অত্যাচার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এক রাজতন্ত্র বাংলাদেশে কায়েম হয়েছে এখন। রাজতন্ত্রের জন্য আছেন একজন লেডি হিটলার। কারণ তিনি যা হুকুম দিচ্ছেন, নির্দেশ দিচ্ছেন; তার সৈন্য-সামন্তরা যারা আছে, অর্থাৎ প্রশাসন, তারা সেভাবে কাজ করছেন। সবকিছু এই এক ব্যক্তির কথামতো চলে।
শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের পর বিবিসিকে দেওয়া শেখ হাসিনার এক সাক্ষাৎকার তুলে ধরে খালেদা জিয়া বলেন, “হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমি বাংলাদেশে যাব রাজনীতি করার জন্য নয়, প্রতিশোধ নিতে’। তিনি দেশ গড়তে আসেননি। তিনি এসেছেন দেশ ধ্বংস করতে।”
জঙ্গিবাদের উত্থানের জন্য আওয়ামী লীগ সরকারকেই দায়ী করেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, জঙ্গি জঙ্গি হাসিনাই বলেছে, কিসের জন্য? বিদেশিদের ভয় দেখানোর জন্য। বোঝাতে চাইছে আমরা যদি চলে যাই, বিএনপি এলে জঙ্গিদের উত্থান হবে। …কিন্তু দেখেন, জঙ্গিদের উত্থান কিন্তু আওয়ামী লীগের সময় হয়েছে। তারা একটা জঙ্গিকে ধরেনি। আমরা এসে সব জঙ্গিকে ধরেছি। বিচার করেছি।
সরকারকে হটাতে ব্যর্থতার জন্য ঢাকা শহরে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারার কথা উল্লেখ করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, আন্দোলন ঢাকায় সেভাবে করা সম্ভব হয়নি। ঢাকা শহরে বের হলেই গুলি করে দেয়। তবে সারা দেশে যে কী আন্দোলন হয়েছে, স্বাধীনতার সময়, মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তা হয়নি।
তিনি গণমাধ্যমে দেয়া পুলিশের ভাষ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, আন্দোলন দমাতে পুলিশ গাড়ি পুড়িয়ে সেই দায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের উপর চাপিয়েছে। একথা পুলিশ অফিসাররাই প্রকাশ্যে স্বীকার করছে। হুমকি দিয়ে তারা এও বলেছে, ‘আমরাই তো সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছি।’
শেখ হাসিনা আজীবন ক্ষমতায় থাকতে বিএনপির নেতাকর্মীদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে। বিএনপি ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র করেছে। এসবে কোনো ফল হবে না। বিএনপিকে কেউ ভাঙ্গতে পারেনি। বহু চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি। বিএনপিকে ভাঙ্গা যাবে না। সত্যি কথাই বলি, এরশাদ তেমন করেনি। ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দীনও কম করেনি। পারেনি। শেখ হাসিনাও পারেনি। পারবে না।
তিনি বলেন, গত সাত বছরে বিএনপির তিন হাজার নেতাকর্মীকে খুন, এক হাজার ২০০ জনকে গুম, এক হাজার ১২ জনকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে। র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদকে নিয়ে তিনি বলেন, “কতো মানুষকে বেনজীর মেরেছে তার হিসাব নেই।
বর্তমান সংসদকে অবৈধ অভিহিত করে সাবেক খালেদা জিয়া বলেন, এমপি হওয়ার যোগ্যতা নেই এমন অনেককে মন্ত্রী করা হয়েছে। আর বর্তমানে সংসদে কোনো কাজ হয় না, শুধু খালেদা জিয়া, তারেক রহমান আর জিয়াউর রহমানকে গালিগালাজ করা হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশে বেসামরিক প্রশাসনকে পুরোপুরি দলীয়করণ করে অনেক যোগ্য, মেধাবী কর্মকর্তাকে দায়িত্বের বাইরে রাখা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
দেশে দল গঠনের অসামপ্ত কাজ শেষ করতে যাওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, আমার যাওয়াটা অত্যন্ত প্রয়োজন। গিয়ে আমাকে বাকি কাজগুলো করতে হবে। এরা (পরিবার) আমাকে যেতে দিতে দেয় না। কিন্তু আমাকে যেতে হবে।
খালেদা জিয়া বলেন, স্থায়ী কমিটির নেতাদের তিনি অনেক কিছু দেখিয়ে এসেছেন। কিন্তু কিছু হলে ওরা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সেজন্য আমার যাওয়াটা প্রয়োজন। তাই আমাকে যেতেই হবে। দেশের মানুষের পাশে দাড়াতে হবে।
খালেদা জিয়া বলেন, ক্ষমতায় গেলে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, বিচারের বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় করবেন।
বক্তব্যের শুরুতেই যুক্তরাজ্যে অবস্থানের সুবাদে দেখা ইউরোপের দেশটির আইন-শৃঙ্খলার উচ্চ প্রশংসা করে খালেদা জিয়া বলেন, দেড় মাসে অনেক কিছু দেখেছি, খুব ভালো লেগেছে। তাদের যে আইনশৃঙ্খলা এবং সুন্দও যে সব আইন আছে সেগুলো আমার মনে হয়, অনেক ভালো জিনিস শেখার আছে। শুধু শেখার নয়, এসব আইন-কানুন বাংলাদেশে বাস্তবায়নের সুযোগ রয়েছে।
যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালেকের সভাপতিত্বে সভা পরিচালনা করেন সাধারণ সম্পাদক কয়সর এম আহমেদ। সভায় আরো বক্তৃতা রাখেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. কেএমএ মালিক, প্রফেসর ড. আবুল হাসনাত, কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব ব্যারিস্টার নাজির আহমেদ, কাউন্সিলর অলিউর রহমান, যুক্তরাজ্য বিএনপির সাবেক সভাপতি শায়েস্তা চৌধুরী কুদ্দুস, সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম এ সালাম, বর্তমান সিনিয়র সহ-সভাপতি আবদুল হামিদ চৌধুরী, আবুল কালাম আজাদ, আখতার হোসাইন, যুগ্ম সম্পাদক শহিদুল ইসলাম মামুন, যুক্তরাজ্য জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের আহ্বায়ক ব্যারিস্টার তারিক বিন আজিজ, যুবদলের আহ্বায়ক দেওয়ান মোকাদ্দিম চৌধুরী নিয়াজ, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি নাসির আহমেদ শাহীন ও জাসাসের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসাইন।
এছাড়া অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আ,ন,ম এহছানুল হক মিলন, মাহিদুর রহমান, মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীম, বিএনপি চেয়ারপারসনের আন্তজাতিক উপদেষ্টা কমিটির সদস্য সচিব মুশফিকুল ফজল আনসারী, তারেক রহমানের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার আবু সায়েম, হুমায়ুন কবির, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের গত নির্বাচনে বিএনপি দলীয় মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল, সাংবাদিক সালেহ শিবলি, সাবেক ছাত্রনেতা নসরুল্লাহ খান জুনায়েদ, পারভেজ মল্লিক, নাজমুল হাসান জাহিদ, মালয়েশিয়া বিএনপির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার বাদল রহমান, সুইডেন বিএনপির প্রধান উপদেষ্টা জিন্টু, ডেনমার্ক বিএনপির সভাপতি গাজী মনির হোসেন, ফিনল্যান্ড বিএনপির জনি, বার্নিল বিএনপির মোস্তাক প্রমুখ।
উল্লেখ্য, গত ১৬ সেপ্টেম্বর চোখের চিকিৎসা করাতে লন্ডন আসেন খালেদা জিয়া। তার দেশে ফেরার ব্যাপারে দলের নেতারা সুনির্দিষ্ট করে কিছুই বলছিলেন না। এরই মধ্যে শিগগিরই দেশে ফেরার ইঙ্গিত দিলেন খালেদা জিয়া নিজেই। বললেন, এক-এগারো সরকার আমাকে বিদেশে পাঠানোর ষড়যন্ত্র করেছিল। আমি বলেছিলাম, বিদেশে আমরা কোনো ঠিকানা নেই। দেশ ও দেশের মাটিই আমার ঠিকানা। দেশের মানুষই আমার একমাত্র ভরসা। আমি বিদেশে যাইনি। দেশকে অবৈধ সরকারের হাত থেকে সেদিন রক্ষা করা গেলেও বাকশালী স্বৈরতন্ত্র এখনও অব্যাহত আছে।