ইসলামিক সংস্কৃতি ও গণতন্ত্র এক সাথে চলতে পারে : এরদোগান

Erduganতিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, হয়ে গেলেন প্রেসিডেন্ট। গত রোববারের নির্বাচনে রজব তৈয়ব এরদোয়ান প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তুরস্কে ক্ষমতার রাশ নিজের হাতেই রাখতে সমর্থ হলেন। তবে বিতর্ক তাঁর পিছন ছাড়ছে না।
তুরস্কের সমাজের একটা বড় অংশে এর্দোগানের জনপ্রিয়তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।এমনকি এই প্রথম বিদেশে বসবাসরত তুর্কি নাগরিকরা ভোটদানের ক্ষমতা পেয়ে তাঁর প্রতি বিপুল আস্থা দেখিয়েছেন। শুধু জার্মানিতেই তাঁর পক্ষে ভোট পড়েছে ৮০ শতাংশের বেশি। দেশের মধ্যে ৫২ শতাংশ ভোটই তাঁর ঝুলিতে পড়েছে, যদিও তিনি আরও বেশি সমর্থন প্রত্যাশা করেছিলেন। ২০০৩ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসার পর তিনি দেশের উন্নতির জন্য যে কাজ করেছেন এবং সাফল্য দেখিয়েছেন, তার স্বীকৃতি হিসেবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আস্থা অর্জন করতে পেরেছেন তিনি। তুরস্ককে বিশ্বমঞ্চে আরও শক্তিশালীভাবে প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার করে এসেছেন তিনি।
এই সময়কালে অর্থনৈতিক উন্নতি ও কৌশলগত গুরুত্বের মূল্যও দিতে হয়েছে তুরস্ককে।
সমালোচকরা এরদোগানের অনেক পদক্ষেপের মধ্যে স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা দেখছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, সংবাদমাধ্যম ও বিরোধীদের পদে পদে বাধা সৃষ্টি করে সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশও শেষ করে দিয়েছেন তিনি। তাছাড়া ক্ষমতার রাশ নিজের হাতে রেখে দিতে তিনি প্রেসিডেন্ট পদের গুরুত্বও আচমকা বাড়িয়ে দিচ্ছেন। সংবিধান অনুযায়ী আগামী ২৮শে আগস্ট শপথ নেবার পর তিনি পর পর দু’বার পাঁচ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে আগামী ২০২৪ সাল পর্যন্ত তুরস্কের একচ্ছত্র নেতা থাকতে পারেন এরদোগান।
ধর্মপরায়ণ তবে ক্যারিশমেটিক এরদোগান দেশটির প্রতিষ্ঠাতা মুস্তফা কামাল আতাতুর্কের পর সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী শাসক।
‘সুলতান’ হিসেবে খ্যাত এরদোগান এক দশকে তুরস্কের নজিরবিহীন প্রবৃদ্ধির জন্য বিশ্বব্যাপী নন্দিত। সমালোচকদের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘আমি একনায়ক নই, এটা আমার রক্তে নেই।’ তুরস্কের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এবং ধর্মপরায়ণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে তার সুদৃঢ় সমর্থন রয়েছে, যারা তার শাসনে উন্নতি লাভ করেছেন।
তুরস্কে কয়েক দশকের ঘনঘন সামরিক অভ্যুত্থান এবং দুর্বল জোট সরকারের পর স্থিতিশীল সরকার উপহার দেয়ার জন্য এরদোগানের প্রশংসা করা হয়।
তিনি শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর লাগাম টেনে ধরেছেন। নতুন ব্রিজ, বিমানবন্দর অন্যান্য বৃহৎ প্রকল্পের মাধ্যমে  তিনি এক সময়ের তলাবিহীন তুরস্ককে শক্তিশালী বাজারে পরিণত করেছেন। তার শাসনামলে সাধারণ তুর্কিদের আয় তিনগুণ বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরেছেন তিনি। বসফরাস প্রণালীর নীচ দিয়ে সুড়ঙ্গ পথ এবং নতুন হাইস্পিড রেল নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন এরদোগান। ৬১ কোটি ডলারের বেশি ব্যয়ে বিশ্বের বৃহত্তম প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ তৈরি করেছেন তিনি।
কয়েদি থেকে ক্ষমতায়
ইস্তাম্বুলের পার্শ্ববর্তী কাসিমপাশায় জন্ম নেয়া এরদোগানের বাবা ছিলেন একজন কোস্টগার্ড কর্মকর্তা। কিশোর বয়সে রাস্তায় রুটি এবং লেবু বিক্রি করতেন এরদোগান।
তরুণ বয়সে ইসলামিক ইয়ুথ সংগঠনে যোগদান করেন তিনি। এ সংগঠনটি তুরস্কের কট্টর সেক্যুলার নীতির বিরোধিতা করে। তুরস্কের ক্ষমতাধর জেনারেলরা মসজিদ ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিশাল ব্যবধান তৈরি করেন।
এক সময়ে আধা পেশাদার হিসেবে ফুটবল খেলোয়াড় এবং ব্যবসায় শিক্ষায় স্নাতক ডিগ্রিধারী এরদোগান ১৯৯৪ সালে ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি দেড় কোটি লোকের এ শহরটির ট্রাফিক জাম এবং বায়ু দূষণ রোধে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
যখন তার ইসলামঘেঁষা দলকে নিষিদ্ধ করা হয় তখন বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি এ সময় একটি ইসলামী কবিতা পাঠ করেন।
সেই কবিতাটি ছিল এরকম- ‘মসজিদ আমাদের ব্যারাক, গম্বুজ আমাদের হেলমেট, মিনার আমাদের বেয়নেট এবং ঈমানদাররা আমাদের সৈনিক।’ এই কবিতার মধ্যে ধর্মীয় উসকানির গন্ধ পায় সেক্যুলার শাসকরা। তবে এরদোগান বারবারই এ কবিতা আবৃত্তি করেন।
২০০১ সালে এরদোগান এবং তার সহযোগী সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল ইসলামঘেঁষা জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) গঠন করেন। পরের বছরের নির্বাচনে দলটি ভূমিধস বিজয় অর্জন করে। এরপর  থেকে প্রতিটি নির্বাচনেই জয় পেয়েছে একেপি। দুই ছেলে আর দুই মেয়ের বাবা ৬১ বছর বয়সী এরদোগান বলেছেন, ‘একেপি আমার পঞ্চম সন্তান।’
সাম্প্রতিক দুটি নির্বাচনে দেশবাপী বিশাল বিশাল নির্বাচনী প্রচারাভিযানে তিনি বিরামহীন অংশ নেন। অসুস্থতাও তাকে থামাতে পারে না। নির্বাচনী প্রচারণার মাঝেই হয়তো স্থানীয় কোনো ফুটবল খেলায় মেতে ওঠেন তিনি। তুরস্ককে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য করতে দেশে ব্যাপক সংস্কার করা হয়েছে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন মুসলিম রাষ্ট্র তুরস্ককে সদস্যপদ দিতে গড়িমসি করায় ক্ষুব্ধ এরদোগান বলেছেন, ইইউর  সদস্যপদের জন্য তুরস্ক অনাদিকাল অপেক্ষা করবে না।
সাম্প্রতিক সময়ে এরদোগান তুরস্কে সেক্যুলারদের আরোপিত হিজাবের ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করেছেন। মদ বিক্রিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছেন তিনি। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছেলেমেয়েদের সহ-অবস্থান নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। এরদোগান বলেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না যে ইসলামিক সংস্কৃতি এবং গণতন্ত্র একত্রে চলতে পারে না।’
এই প্রথম সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করিয়ে পদের মর্যাদাও বাড়িয়ে নিয়েছেন তিনি। আগামী ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর সংবিধানে পরিবর্তন এনে প্রেসিডেন্টের হাতে আরও ক্ষমতা তুলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে এরদোগানের ইসলামপন্থি আক পার্টির মধ্যে। আপাতত প্রধানমন্ত্রী পদে নিজের অনুগত কাউকে বসিয়ে আরও এক দশক ধরে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন এরদোগান।
সমালোচনা দূরে রাখতে এর্দোয়ান নিজেকে সব নাগরিকের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সব বিভেদ ভুলে তিনি মানুষের উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, আতাতুর্কের আদর্শে অনুপ্রাণিত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি এর্দোগানের তুমুল বিরোধিতা করে চলেছে। তাঁর আমলে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে। মানবাধিকার, সব সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতা থেকে শুরু করে অনেক প্রশ্নে তুরস্কের বিরুদ্ধে সমালোচনার মাত্রা বাড়ছে।
এরদোগানের জয়ের পর জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলসহ ইউরোপীয় নেতারা তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। সিরিয়া, ইরাক ও মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সংকটের প্রেক্ষাপটে তুরস্কের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button