সমাজের প্রতিটি সেক্টর হোক আলেমদের কর্মক্ষেত্র
তানজিল আমির: প্রতিবছর দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলো থেকে প্রায় বিশ হাজার তরুণ আলেম বের হচ্ছেন। কিন্তু সে হিসাবে সমাজে আলেমদের নেতৃত্যের প্রভাব খুবই ক্ষীণ। মাদ্রাসার সিলেবাসে আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়হীনতাকেই এর মূল কারণ হিসেবে মনে করেন অনেকে। মাদ্রাসার ছাত্ররা জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে কতটুকু মনোনিবেশ করবে এর কোনো রূপরেখা তাদের সামনে নেই। এ ব্যাপারে অনেকটা ধোঁয়াশার মাঝে রয়েছে এ প্রজন্মের কওমি ছাত্ররা। কওমি মাদ্রাসার সূতিকাগার দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা কাসেম নানুতুবী (রহ.) লিখেছেন, ‘এই মাদ্রাসাগুলোতে পড়ার পর বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পড়া বা কোনো ডিগ্রি অর্জন করা একজন ছাত্রের বাড়তি যোগ্যতা বলে বিবেচিত হবে।’
মানুষের মানবতাবোধ জাগ্রত করা, সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা এবং রাসূল (সা.)-এর প্রতি পরিপূর্ণ আদর্শ অনুযায়ী নিজে চলা ও সমাজকে পরিচালনার শিক্ষাই দেয়া হয় মাদ্রাসাগুলোতে। সে হিসেবে সমাজের প্রতিটি সেক্টরই আলেমদের কর্মক্ষেত্র। মসজিদ বা মাদ্রাসার চার দেয়ালই শেষ গন্তব্য নয়। সম্প্রতি কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের মাঝেও বিষিয়টি আলোচিত হচ্ছে। মাদ্রাসার পাশাপাশি নিজ উদ্যোগে অনেকেই এখন পড়াশোনা করছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। পড়াশোনা শেষে নিজ কর্মপ্রতিভা ছড়িয়ে দিচ্ছে সমাজে। এমনই মেধাবী এক আলেম মাওলানা হুসাইনুল বান্না, কওমির পাশাপাশি আধুনিক জ্ঞানের জগতেও বিচরণ করেছেন। এখন অধ্যাপনা করছেন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাওলানা হুসাইনুল বান্নার সঙ্গে কথা বলেছি কওমি ছাত্রদের বাইরে পড়াশোনা ও কাজকর্ম নিয়ে। তার কাছে জানতে চেয়েছি, বাইরে পড়াশোনা ও কাজকর্মে কওমি ছাত্রদের অনাগ্রহের মূল কারণ কী? তিনি বললেন, প্রথমত কওমি মাদ্রাসার ছাত্ররা বাইরে পড়বে কিনা এবং পড়লে এর সীমা পরিধি কতটুকু হবে, এমন কোনো নির্দেশনা ছাত্ররা পায় না। এটা প্রথম কারণ। তবে মূল কারণ হিসেবে আমি মনে করি, আমাদের দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোতে দেওবন্দি চেতনার অনুপস্থিতি। সামগ্রিকভাবে চেতনার চর্চা না হওয়াতে ছাত্রদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সঠিকভাবে নির্ধারণ হয় না। আমি ভালো আলেম হব, এমন লক্ষ্য সবারই থাকে, কিন্তু আলেম হয়ে সমাজ, দেশ ও জাতির কল্যাণে কোনো কাজে যুক্ত হব, এ লক্ষ্যটি তারা স্থির করতে পারে না। কিন্তু আপনার মতো অনেকেই তো এখন বিভিন্ন কাজ করছে, এ প্রশ্নের উত্তরে মাওলানা হুসাইনুল বান্না বলেন, আমিসহ যারাই আজকে বাইরে কাজ করছি তারা ছাত্রজীবনের শুরুতেই একটি লক্ষ্য স্থির করেছি। আমরা যখন চৌধুরী পাড়া ও মালিবাগ মাদ্রাসায় পড়েছি, তখন মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদের নেতৃত্বে লাজনা নামে একটি বুদ্ধিভিত্তিক সংগঠনের কাজ চলছিল। কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের বুদ্ধিভিত্তিক বিভিন্ন কাজে উদ্বুদ্ধ করা হতো এ সংগঠনের মাধ্যমে। আজকে জাতীয় পর্যায়ে যেসব আলেম সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত আছে, এরা সবাই লাজনার সদস্য ছিল। এখনও যদি যোগ্য কোনো আলেমের নেতৃত্বে কমমি মাদ্রাসাগুলোতে এমন কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়, তাহলে নতুন কিছু আশা করা যায়। মাওলানা হুসাইনুল বান্নার মতো উদ্যমী অনেক তরুণ সমাজের মূল ধারায় যুক্ত হচ্ছেন নিজ উদ্যোগে। কিন্তু তাদের এ পথচলাটা খুব মসৃণ নয়। সামাজিক ও বিভিন্নভাবে অনেক প্রতিকূল পরিবেশ মাড়িয়েই জয় করতে হয় তাদের কাক্সিক্ষত স্বপ্নকে। এ প্রতিকূলতার ভয়েও অনেকেই ভিন্ন কিছু করতে আগ্রহী হয় না। মাওলানা বান্না বলেন, অপ্রিয় হলেও সত্য, আমাদের দেশে সাধারণ শিক্ষিত ও মাদ্রাসা পড়ুয়াদের মাঝে একটি দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এ দূরত্বের ফলে নবীন ছাত্ররা এক ধরনের হীনমন্যতায় ভোগে। কোনো আলেম যদি মাদ্রাসা-মসজিদের বাইরে ভিন্ন কিছু করতে চায়, তাহলে সামাজিকভাবে তাকে নিরুৎসাহিত করা হয়। এজন্য সবাইকে বলব, দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করে আলেমদের কাজের সুযোগ দিন। আর আলেমদেরও বলব, আমরা যদি আমাদের যোগ্যতার পাশাপাশি মেধাবী ও সুন্দর আচরণ করতে পারি, তাহলে যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি আমাদের অনুকূল হয়ে যাবে। আসলে সবার বোঝা উচিত, মাদ্রাসা পড়ুয়ারা জীবন ও সমাজের বাইরের কেউ নন। এ কথাগুলো শুধু হুসাইনুল বান্নার নয়। এ প্রজন্মের কওমি মাদ্রাসার ছাত্ররা এগিয়ে যেতে চায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতিটি ধারায়। কিন্তু সঠিক দিকনির্দেশনা ও সামাজিক অবস্থার কারণে ফুটিয়ে তুলতে পারছে না সুপ্তপ্রতিভাগুলো। এ কারণে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক ও যোগাযোগ বাড়াতে হবে প্রতিটি মাদ্রাসার। মাওলানা হুসাইনুল বান্নার কাছে জানতে চেয়েছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার কর্মজীবনের শুরুর দিককার কথা। উদ্যমী এ আলেম বললেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আমি জয়েন করি, সহকর্মীরা সম্মানের সঙ্গেই আমাকে গ্রহণ করেছিল। প্রথমদিকে দুই-একজন এমনভাব করত যে, হুজুর মানুষ আর কি পড়াবে। কিন্তু আমি তো কারও দয়া বা সুপারিশে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পাইনি। আমি ধৈর্য ধারণ করে কাজ করেছি, আমার যোগ্যতা ও আচরণই তাদের আমার প্রতি মুগ্ধ করেছে। প্রচলিত নির্দিষ্ট বৃত্তের বাইরে কাজ করে, নিজ শেকড় কওমি মাদ্রাসাকে ভুলে যাননি মাওলানা হুসাইনুল বান্না। মুহাদ্দিস হিসেবে আছেন বিখ্যাত মাদ্রাসা জামিয়া ইকরা বাংলাদেশে। ফজরের পর হাদিস শাস্ত্রের উচ্চগ্রন্থ তিরমিজি দরস দেন। তারপর চলে যান কর্মক্ষেত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সন্ধ্যার পর আবার সময় দেন মাদ্রাসাতে। শুক্রবারে জুমা পড়ান রাজারবাগ পুলিশ লাইনস মসজিদে। সব মিলিয়ে কর্মব্যস্তময় সুন্দর এক জীবনের অধিকারী তরুণ ও আলেম। নিজে স্বপ্ন দেখেন স্বপ্ন দেখাতেও শেখান। কওমির তরুণ ছাত্রদের তিনি স্বপ্ন দেখান, আগামীর উজ্জ্বল এক সোনালি বাংলাদেশের। যেখানে আলেম সমাজ নিজস্ব স্বকীয়তায় মুখরিত করবে প্রতিটি কর্মক্ষেত্রকে। ধর্ম ও কর্মের মাঝে সমন্বয় করে চলবে প্রতিটি মুসলমান। শান্তি, সম্প্রীতি ও উদারতার এক মডেল হবে বাংলাদেশ। এ জন্য প্রয়োজন মাদ্রাসা শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানেও বুৎপত্তি অর্জন। তখন কওমি মাদ্রাসা ছাত্রদের প্রতিভা শুধু মাদ্রাসা-মসজিদেই নয়, ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র।