ব্রিটেনে বিক্ষোভ ও মিডিয়ার প্রশ্নবাণে জর্জরিত মোদি

Modiভারতে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঢেউ এবার আছড়ে পড়ল বিদেশের মাটি ব্রিটেনেও। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বৃহস্পতিবার তিন দিনের ব্রিটেন সফরে আছেন। ভারতে অসহিষ্ণুতা প্রসঙ্গে ব্রিটিশ গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা এদিন কার্যত মোদিকে ‘বেইজ্জতি’ করে ছেড়েছেন। লন্ডনের রাস্তায় মোদিবিরোধী প্রবল বিক্ষোভও গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য সৃষ্টি করেছে।
বৃহস্পতিবার ডাউনিং স্ট্রিট, ওয়েস্ট মিনস্টার এলাকায় প্রতিবাদকারীরা মোদিবিরোধী বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে বিক্ষোভে শামিল হন। প্ল্যাকার্ডে ‘খুনি মোদি এখানে স্বাগত নন’, ‘ভারতে হিন্দু সন্ত্রাস বন্ধ হোক’ প্রভৃতি স্লোগান লেখা ছিল। ব্রিটিশ রাজনীতিক জর্জ গ্যালোওয়ের নেতৃত্বে ‘আওয়াজ’ নামে এক সংগঠনের মাধ্যমে প্রতিবাদকারীরা সমবেত হন।
ভারতে অসহিষ্ণুতা নিয়ে মোদির কাছে প্রশ্ন তুলতে ‘পেন ইন্টারন্যাশনাল’ নামে এক সংগঠনের পক্ষ থেকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনকে চিঠি দিয়েছেন ২০০ জনের বেশি বিশিষ্ট লেখক।
‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন অক্সফোর্ড-কেমব্রিজের পাশাপাশি ব্রিটেনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট ১৩৯ জন অধ্যাপক এবং গবেষক। গবেষক এবং অধ্যাপকদের পক্ষ থেকে সংবাদপত্রে পাঠানো খোলা চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘ভারতে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মোদি সরকার এবং বিজেপি রাজনীতিকরা দেশে অসহিষ্ণুতা এবং ঘৃণা ছড়াতে মদদ দিয়েছেন। দলিত, মুসলিম, খ্রিস্টান সম্প্রদায় ও নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বেড়ে গেছে।’ উত্তর প্রদেশের দাদরিতে গরুর গোশত খাওয়ার গুজব রটিয়ে মুহাম্মদ আখলাক নামে এক মুসলিম বৃদ্ধকে পিটিয়ে হত্যা করা, এম এম কালবুর্গির মতো প্রতিবাদী লেখককে হত্যা, হিন্দু মৌলবাদীদের চাপে গবেষণামূলক বই নিষিদ্ধ করা ইত্যাদি প্রসঙ্গও তোলা হয়েছে। মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণের জন্য মোদিকে দায়ী করার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। ‘ব্রিটেনে মোদি স্বাগত নন’ বলেও সেদেশের গবেষক এবং অধ্যাপকদের ওই প্রতিবাদী অংশ সাফ জানিয়েছেন।
অন্যদিকে ব্রিটেনে বসবাসকারী নেপালিরাও বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখান। মোদির বিরুদ্ধে লন্ডনের রাস্তায় প্রকাশ্যে স্লোগান দেয়া হলেও যেভাবে ভারতের বিরুদ্ধে নেপালিরা বিরুদ্ধাচরণ করছেন তাতে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা চিন্তায় পড়েছেন। প্ল্যাকার্ড হাতে বিক্ষোভকারীরা ভারতের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ করে স্লোগান দেয়। তারা নেপালকে ভারত অবরোধ করে রেখেছে বলে অভিযোগ করে তা দ্রুত প্রত্যাহার করার দাবি জানান। নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করতে এবং নেপালের সংবিধান তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে উল্লেখ করে বিক্ষোভ দেখান তারা।
ক্যামেরনের সঙ্গে মোদির যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, ভারত অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে কেন? জবাবে মোদি অবশ্য অসহিষ্ণুতার বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘ভারত বুদ্ধ-গান্ধীর দেশ। আমাদের সমাজের মূল্যবোধের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো ঘটনা আমরা বরদাস্ত করি না, দেশের যে প্রান্তেই তা ঘটুক না কেন। ১২৫ কোটির দেশে কতজন এ ধরনের ঘটনার শিকার হচ্ছেন সেটা সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ ধরনের যে কোনো ঘটনাতেই কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ ভারতীয় সংবিধান একজন সাধারণ নাগরিকের দৃষ্টিভঙ্গিকেও রক্ষা করার কথা বলে। তার সরকার সেই সংবিধান মেনে চলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলেও আশ্বাস দেন মোদি।
প্রধানমন্ত্রী মোদি যখন বিলেতি সাংবাদিকদের প্রশ্নবাণ সামলাচ্ছেন, বাইরে তখন মোদিবিরোধী প্রবল বিক্ষোভে শামিল হয় ক্ষুব্ধ মানুষজন। লন্ডন পুলিশকে এজন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়, যাতে কোনো অঘটন না ঘটে। বিক্ষোভকারীদের ভিড় বাড়তে থাকায় সাধারণ মানুষের জন্য গোটা পার্লামেন্ট স্কোয়ার বন্ধ করে দেয়া হয়। পরিস্থিতি এতটাই মোড় নেয় যে, এজন্য স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে বলতে হয় ক্যামেরন সরকারকে।
বৃহস্পতিবার মোদি-ক্যামেরন যৌথ সংবাদ সম্মেলনের মধ্যেই ক্যামেরনকে এক ব্রিটিশ সাংবাদিক গুজরাট দাঙ্গার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, মোদির ব্রিটেনে আসার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। তাকে এখান আমন্ত্রণ জানানো হলো কেন? ক্যামেরুন বলেন, তিনি বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন, তাই আমন্ত্রণ জানানোর মধ্যে কোনো ভুল নেই।
ক্যামেরনের সামনে এভাবে আন্তর্জাতিক একটি মঞ্চে অস্বস্তিতে পড়ে মোদি অবশ্য ওই সাংবাদিকের উদ্দেশে বলেন, ব্রিটেনে আসা নিয়ে তার বিরুদ্ধে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। ২০০৩ সালেও তিনি ব্রিটেনে এসে সাদর অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন। মোদি অবশ্য এভাবে সাফাই দেয়ার চেষ্টা করলেও এক ব্রিটিশ সাংবাদিক প্রশ্ন তোলেন, ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের নেতা সাধারণত যে সম্মান পান তা মোদির পাওয়া কি উচিত?’ ব্রিটিশ সাংবাদিকদের এভাবে কঠোর প্রশ্নের মুখে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে মোদিকে। ব্রিটিশ গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে এর আগে এভাবে কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করা হয়নি। ভারতীয় কোনো প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও এভাবে ব্রিটেনের রাজপথে নেমে বিক্ষোভ দেখানোরও কোনো নজির নেই। দেশীয় সমস্যাকে কেন্দ্র করে বিদেশের মাটিতে প্রধানমন্ত্রী মোদি বেইজ্জতি হয়েছেন বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
প্রধানমন্ত্রী মোদি এরই মধ্যে ৩০টি দেশ সফর করে ফেললেও এই প্রথম ব্রিটেনে এসে বড় ধাক্কা খেলেন, যদিও অন্যান্য দেশে তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছে। কয়েকদিন আগেই অবশ্য মোদি সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী এবং বিজেপি নেতা অরুণ জেটলি দাবি করেছেন, দেশে কোথাও অসহিষ্ণুতা নেই। যারা এ নিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, এসব তাদের সাজানো প্রতিবাদ বলেও জানিয়েছিলেন বিজেপির শীর্ষ নেতারা। যদিও সেই অসহিষ্ণুতা প্রশ্নই এখন প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে বিদেশের মাটিতেও, যা মোকাবিলা করতে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে মহাত্মা গান্ধী ও গৌতম বুদ্ধকে স্মরণ করার পাশাপাশি সাংবিধানিক অধিকারের কথা বলেও সবাইকে আশ্বস্ত করতে হচ্ছে।কংগ্রেস নেতা আনন্দ শর্মা অবশ্য মোদির এই দুঃসময়েও তাকে আক্রমণ করতে ছাড়েননি। তিনি কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘দেশে থাকার সময় মোদি ভুলে যান যে, এটা বুদ্ধ এবং গান্ধীর দেশ। বিদেশের শিক্ষিত সমাজের একটা বড় অংশ এবং গণমাধ্যমও বিজেপির সাম্প্রদায়িক মুখের কথা জেনে ফেলেছে।’পররাষ্ট্র দফতর থেকে অবশ্য ভারতের সঙ্গে ৯০ হাজার কোটি টাকার দ্বিপক্ষীয় চুক্তি, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানো ইত্যাদিকে সাফল্য বলে তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। যদিও এসব সাফল্যের মধ্যেও ব্রিটেনে যে অস্বস্তিকর বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছে তা চাপা পড়ছে না বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button