এরদোগানের ফিরে আসা ও মুসলিম বিশ্বের প্রত্যাশা
জালাল উদ্দিন ওমর: গত ৭ জুন অনুষ্ঠিত তুরস্কের সংসদ নির্বাচনে এরদোগানের জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও এককভাবে সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ফলে তারা সরকার গঠন করতে পারেনি। এরদোগানের দল বিরোধী দলগুলোর সাথে কোয়ালিশান সরকার গঠনের চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়। ফলে তুরস্কে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয় এবং সংবিধান অনুযায়ী দ্বিতীয় দফা নির্বাচন অনিবার্য হয়ে ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ১ নভেম্বর দ্বিতীয় দফা ভোটের দিন ধার্য করেন। আর ১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এরদোগানের দল সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সংসদের ৫৫০ আসনের এ নির্বাচনে জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি এককভাবে ৩১৬টি আসনে বিজয়ী হয়। রিপাবলিকান পিপলস পার্টি পেয়েছে ১৩৪ আসন, ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টি পেয়েছে ৪১ আসন এবং পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি পেয়েছে ৫৯ আসন। শতকরা হারে জাস্টিজ এন্ড ডেভেলাপমেন্ট পার্টি ৪৯.৪%, রিপাবলিকান পিপলস পার্টি ২৫.৪%, ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টি ১১.৯% এবং পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ১০.৫% ভোট পায়।
নতুন নির্বাচনের ফলে তুরস্কের রাজনৈতিক সঙ্কট আপাতত কেটে গেল। মুসলিম বিশ্বে তুরস্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী দেশ। এশিয়া এবং ইউরোপের সংযোগ স্থাপনকারী ও ন্যাটোর সদস্য দেশ হিসাবে পশ্চিমা বিশ্বে তুরস্কের আলাদা পরিচয় ও প্রভাব রয়েছে। মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের প্রতিষ্ঠিত ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কের রাজনীতিতে প্রেসিডেন্ট এরদোগান এবং তার দল জাস্টিস এন্ড ডেভেলাপমেন্ট পার্টি অতি আলোচিত একটি নাম। পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে প্রভাবিত ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কে জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামপন্থী এই দলের উত্থান এবং ক্ষমতায় আরোহণ ছিল বিশ্ব জুড়ে একটি আলোচিত বিষয়। অনেক চড়াই, উৎরাই পেরিয়ে দলটি তুরস্কের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। দলটির নেতৃত্বে তুরস্কে ইসলামী সংস্কৃতি, রীতিনীতি এবং মূল্যবোধের বিকাশ শুরু হয়। বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোগানের নেতৃত্বে দলটি ২০০২ সাল থেকে একটানা তুরস্কের ক্ষমতায়। ২০১৪ সালে এরদোগান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বর্তমানে তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এরদোগান তার দল এবং দেশের অবিসংবাদিত নেতা। এ অবস্থায় গত ৭ জুন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে এরদোগান ও তার দল নিরঙ্কুুস সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়।
মূলত চারটি কারণে এরদোগান ও তার দল জনসমর্থন হারায়, যা নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়। প্রথমত সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদ বিরোধী যুদ্ধে পশ্চিমাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা, দ্বিতীয়ত লিবিয়ার ক্ষমতা থেকে মুয়াম্মার গাদ্দাফীকে উৎখাতে সার্বিক সহযোগিতা, তৃতীয়ত প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পর সংবিধান সংশোধন করে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা, চতুর্থত দলটির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুলের সাথে বিভিন্ন ইস্যুতে এরদোগানের মতবিরোধ এবং এর ফলে আবদল্লাহ গুলের নিষ্ক্রিয়তা।
২০১১ সালে মুসলিম দেশে দেশে যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু হয় তাকে কাজে লাগিয়ে পশ্চিমারা তাদের বিরোধী শাসকদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পশ্চিমা বিরোধী সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চার বছরেরও বেশি সময় ধরে বিদ্রোহীরা যুদ্ধ করছে। এসব বিদ্রোহীদেরকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিকভাবে সাহায্য করছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব, সাথে রয়েছে তুরস্ক, সৌদি আরব এবং কাতারসহ বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশ। পিছন থেকে ইসরাইল কলকাঠি নাড়ছে। অপরদিকে আসাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে ইরান, রাশিয়া, চীন ও লেবানের হিজবুল্লাহ। এই যুদ্ধে ইতোমধ্যে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ নিহত হয়েছে এবং প্রায় চল্লিশ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে হাজার হাজার ঘরবাড়ি, মসজিদ-মাদরাসা, স্কুল, কলেজসহ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। প্রতিদিনই প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য নিরপরাধ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। নিজ ঘরবাড়ি ছেড়ে প্রতিদিনই অসহায় মানুষেরা বাঁচার তাগিদে উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছে। ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে তো চলছেই। আসাদ বিরোধী বিদ্রোহীদের সকল তৎপরতার হেড কোয়ার্টার তুরস্কে অবস্থিত। বিদ্রোহীদের অফিস, সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং রাজনৈতিক তৎপরতা সবই তুরস্কের মাটিতে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে তুরস্কের মাটি থেকে আসাদ বিরোধী কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। তুরস্কের সাথে সিরিয়ার দীর্ঘ সীমান্তের সুযোগে বিরোধীরা অবাধেই তুরস্ক হয়ে অস্ত্র পাচ্ছে। এরদোগানের এই নীতি সে দেশের সাধারণ মুসলমানরা সমর্থন করেনি। এরদোগান শুধু শুধু একটি সঙ্কট সৃষ্টি করছেন, যার কারণে মুসলমানদের কেবল ক্ষতিই হয়েছে। একইভাবে পশ্চিমারা তাদের দীর্ঘদিনের আরেক শত্রু লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফীকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। গণতন্ত্র এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার শ্লোগান দিয়ে তারা লিবিয়ায় হামলার জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব পাস করে। এর পর পশ্চিমা বিশ্ব লিবিয়ায় সামরিক হামলা শুরু করে। লিবিয়ার অবিসংবাদিত নেতা গাদ্দাফী তার বাহিনী নিয়ে পশ্চিমাদের সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে যুদ্ধ করেন। তিনি তিন সন্তানসহ জীবন দেন। এভাবে পশ্চিমারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে লিবিয়ার শাসক গাদ্দাফীকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং নির্মমভাবে হত্যা করেন। আর দেশটিকে ধ্বংস করেন। গাদ্দাফী পরবর্তী লিবিয়া আজ এক ধ্বংসের জনপদ। লিবিয়ার জনগণ আজ গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার কিছুই পায়নি। এখানেও পশ্চিমাদের আগ্রাসনের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন তুরস্কের এরদোগান, সাথে ছিল কাতার এবং সৌদি আরব।
লিবিয়াকে ধ্বংস করার পর যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল মিশরের ক্ষমতা থেকে ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট ড. মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পশ্চিমারা পাশ্চাত্য বিরোধী ড. মুরসিকে কৌশলে আরেক পাশ্চাত্য বিরোধী আসাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। এক্ষেত্রেও পশ্চিমাদের ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এরদোগান। তিনি আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আসাদ বিরোধী পদক্ষেপ নিতে মুরসিকে উদ্বুদ্ধ করেন যা ছিল পশ্চিমাদেরই পরিকল্পনা। একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল বিরোধী মিশরের প্রেসিডেন্ট ড. মুরসি, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের আরেক প্রধান শত্রু আসাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দেন। এটা ছিল মুরসির ঐতিহাসিক ভুল। পশ্চিমা বিশ্ব এটাই চেয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের দুই শত্রু ড. মুরসি এবং আসাদ যখন নিজেরাই নিজেদের শত্রু হয়ে গেছে তখনই পশ্চিমারা ড. মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার কাজটি সম্পন্ন করে। আসাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্নের দুই মাসের মধ্যেই ড. মুরসি ক্ষমতাচ্যুত হন। গণতন্ত্র হত্যাকারী মিশরের সেনাবাহিনীকে নীরবে সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব। মিশরের সেনাবাহিনী গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামরত কয়েক হাজার মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করলেও এক্ষেত্রে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের সোল এজেন্ট যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর পক্ষেই অবস্থান নেয়। এরদোগান এখানেও পশ্চিমাদের পক্ষে অবস্থান নেন।
অবশ্য এরদোগান পরবর্তীতে তার ভুল বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু ততক্ষণে সবই শেষ। তুরস্কের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা না পেলে লিবিয়ার ক্ষমতা থেকে গাদ্দাফীকে উৎখাত করতে পশ্চিমা বিশ্ব কখনোই সফল হতো না। একইভাবে তুরস্কের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা না পেলে সিরিয়ার আসাদ বিরোধী যুদ্ধ কখনোই এতটুকু অগ্রসর হতো না এবং পশ্চিমা বিশ্ব আসাদের বিরুদ্ধে এত যুদ্ধ প্রস্তুতি নিতে পারত না। একইভাবে এরদোগানের প্রত্যক্ষ প্ররোচনায় মুরসি যদি আসাদের বিরুদ্ধে অবস্থান না নিতেন তাহলে মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পশ্চিমা পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতো না। এরদোগানের ভুল পররাষ্ট্রনীতি মুসলিম বিশ্বের অনেক সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করেছে এবং মুসলিম বিশ্বকে শত বছরের জন্য পিছনে ঠেলে দিয়েছে।
বিজ্ঞানের মতই রাজনীতি ও বেসিক কিছু নিয়ম মেনে চলে। সেটা হচ্ছে শত্রুর শত্রু বন্ধু, শত্রুর বন্ধু শত্রু। বন্ধুর বন্ধু বন্ধু আর বন্ধুর শত্রু শত্রু। এই নিয়মেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এখানে আদর্শ কোনো ফ্যাক্টর নয়। যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু বলেই চীন, রাশিয়া, ভেনিজুয়েলা, উত্তর কোরিয়ার সাথে ইরানের ভালো সম্পর্ক। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু বলেই সিরিয়ার সাথে চীন, রাশিয়া এবং ইরানের ভালো সম্পর্ক। একই সাথে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলে প্রধান শত্রু বলেই হামাস এবং হিজবুল্লাহর সাথে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদের ভালো সম্পর্ক। এই সমীকরণ রাজনীতিবিদদেরকে বুঝতে হবে এবং এই সমীকরণ ভুল করলে বিপর্যয় অনিবার্য।
যুদ্ধের ময়দানে একটি ভুল যেমন দেশকে পরাধীন করে, ঠিক তেমনি রাজনীতিতে ভুল নিয়ে আসে বিপর্যয়, যা যুগ যুগ ধরে বহন করতে হয়। এরদোগানের উচিত ছিল পশ্চিমা বিরোধী শক্তি যেমন আসাদের নেতৃত্বাধীন সিরিয়া, মুয়াম্মার গাদ্দাফীর নেতৃত্বাধীন লিবিয়া, মুহাম্মদ মুরসির নেতৃত্বাধীন মিসর এবং ইরান, হিজবুল্লাহ, হামাসের সমন্বয়ে একটি জোট গঠন করা এবং তাকে সংহত করা। এ জোটের সাথে থাকত, সুদান, মালয়েশিয়া, রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া, ভেনিজুয়েলাসহ পশ্চিমা বিরোধী শক্তিসমূহ। ফলে পৃথিবীতে শক্তির একটি ভারসাম্য তৈরি হতে পারত, যা মুসলিম বিশ্বের উত্থানে সহায়ক ভূমিকা পালন করত। কিন্তু তা না করে পশ্চিমা বিরোধী এরদোগান, পশ্চিমা বিরোধী আসাদ এবং গাদ্দাফীকে উৎখাতের জন্যই পরিচালিত যুদ্ধে পশ্চিমাদের প্রধান সহযোগির ভূমিকা পালন করল। এতে মুসলিম বিশ্বের অপার সম্ভাবনা অঙ্কুরেই ধ্বংস হলো এবং নিজেও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন।
তুরস্কে দীর্ঘদিন থেকে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান। অথচ প্রেসিডেন্ট হবার পর এরদোগান চেয়েছেন সংবিধান সংশোধন করে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা কায়েম করতে, যার ফলে এরদোগানের ক্ষমতালিপ্সা প্রকাশ পেয়েছে। এসব ইস্যুতে দলটির সহ প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুলের সাথে এরদোগানের বিরোধ এবং রাজনীতিতে গুলের নীরবতা এরদোগান ও দলকে দুর্বল করেছে। ফলে এরদোগানের দলের জনপ্রিয়তা কমে যায়, যা ৭ জুনের ভোটে প্রতিফলিত হয়। তবে আশার কথা হচ্ছে এরদোগান ও তার দল শেষ পর্যন্ত বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠতে সক্ষম হয়েছেন। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এরদোগান ও তার দলের হাতে থাকার কারণে তিনি শক্ত হাতে প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করতে পেরেছেন। এ অবস্থায় ১ নভেম্বর তুরস্কে দ্বিতীয় দফা সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর এতে এরদোগানের দল জাস্টিস এন্ড ডেভেলাপমেন্ট পার্টি আবারো একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এর মাধ্যমে এরদোগানের দল আবারো তুরস্কের ক্ষমতায় ফিরে এল এবং এর মাধ্যমে তুরস্কের রাজনৈতিক সঙ্কট আপাতত কেটে গেল। এরদোগানের দলের এই বিজয়ে বিশ্বব্যাপী ইসলামপন্থীরা খুশি হয়েছে এবং এর দ্বারা তারা অনুপ্রাণিত হবে।
এখানে গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে একটি বিষয় প্রমাণিত হবে, আর সেটা হচ্ছে এরদোগান এবং তার দলের জনপ্রিয়তা কিন্তু বাড়েনি। তারা তাদের হারানো জনপ্রিয়তাকে পুনরুদ্ধার করেছেন মাত্র। মূলত তুরস্কের জনগণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে গ্রহণ করেছে। তারা চেয়েছে তাদের দেশ শান্তিতে থাকুক। তুরস্কের অবস্থা ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়ার মতো হোক তা তুরস্কের জনগণ চায়নি। তুরস্কের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন এবং শান্তির জন্য জাস্টিস এন্ড ডেভেলাপমেন্ট পার্টির যে কোন বিকল্প নেই তা এরদোগান এবং তার দলের নেতারা জনগণকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছেন। আর জনগণ ও বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। এখানে আরো একটি বিষয় পরিষ্কার; সেটা হচ্ছে বরাবরই দ্বিতীয় স্থানে থাকা ধর্মনিরপেক্ষ রিপাবলিকান পিপলস পার্টির আসন সংখ্যা এবং ভোটের হার তেমন পরিবর্তন হয়নি। দলটি ৭ জুনের নির্বাচনে পেয়েছিল ২৫% ভোট এবং আসন পেয়েছিল ১৩২টি। আর ১ নভেম্বরের নির্বাচনে পেয়েছে ২৫.৪% ভোট এবং আসন পেয়েছে ১৩৪টি। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেনি। অপরদিকে ৭ জুনের তুলনায় ১ নভেম্বরের নির্বাচনে ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টি এবং পিপলস ডেমোক্রাটিক পার্টি ভোট এবং আসন দুটোই কমেছে। মূলত এই দুটি দলের ডানপন্থী জনগণ আবারো এরদোগানের দলকে সমর্থন দিয়েছে।
যাইহোক এরদোগান একজন বিচক্ষণ এবং দক্ষ রাজনীতিবিদ। তার অনেক অর্জন। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কে ইসলামী মূল্যবোধের বিকাশ ঘটিয়েছেন। যেই তুরস্কে মহিলাদের হিজাব পরিধান নিষিদ্ধ ছিল, সেই তুরস্কে এখন লাখো মহিলা হিজাব পরিধান করেন। তিনি তুরস্কের জনগণের জীবনমানকে অনেক উন্নত করেছেন এবং তুরস্ককে সামগ্রিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বিশ্ববাসীর কাছে একজন ইসলামপন্থী রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত। স্বাভাবিকভাবেই তার কাছে বিশ্বমুসলিমের অনেক প্রত্যাশা। কিন্তু তিনি অতীতে পররাষ্ট্রনীতিতে অনেক ভুল করেছেন। যার কারণে মুসলিম বিশ্ব অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা আশা করব, তিনি এবার ভুল করবেন না এবং মুসলমানদের কল্যাণে নিজেকে আরো বেশি নিবেদিত করবেন। একটি বিষয় সবাইকে বুঝতে হবে, আর তা হচ্ছে রাজনৈতিক উপায়েই সিরিয়ার সঙ্কটের সমাধান করতে হবে। কারণ আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করাও যেমন সম্ভব নয়, ঠিক তেমনিভাবে পুরো দেশের ওপর আসাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাও সম্ভব নয়। একইভাবে বিদ্রোহীদের পক্ষে সিরিয়ার ক্ষমতা দখলও যেমন সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি বিদ্রোহীদেরকে নির্মূল করাটাও সম্ভব নয়। মূলত এখানে সাম্রাজ্যবাদীরা উভয়পক্ষকে নিয়ে খেলছে, যাতে কেবল মুসলমানেরাই ধ্বংস হচ্ছে। সুতরাং রাজনৈতিক উপায়েই সিরিয়া সঙ্কটের সমাধান করতে হবে। তুরস্ক যেহেতু সিরিয়ার নিকটতম প্রতিবেশী এবং সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সকল তৎপরতার কেন্দ্র যেহেতু তুরস্কেই অবস্থিত, সেহেতু সিরিয়া সঙ্কট নিরসনে এরদোগান ও তার দলের বিরাট ভূমিকা রাখা সম্ভব। একইভাবে গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত লিবিয়ায় রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনেও এরদোগানকে এগিয়ে আসতে হবে। একইভাবে ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন এবং ইয়েমেন সঙ্কটেও এরদোগানের পক্ষে ভূমিকা রাখা সম্ভব। আমরা আশা করব, তুরস্কের পাশাপাশি পুরো মুসলিম বিশ্বের সমস্যা সমাধানে এরদোগান যথাযথ দায়িত্ব পালন করবেন। মুসলিম দেশগুলোর মাঝে বিদ্যমান অনৈক্য, বিভেদ, হানাহানি বন্ধ করে ঐক্য এবং সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করবেন। মুসলমানদের নিয়ে পশ্চিমাদের দাবা খেলা বন্ধে কাজ করবেন। এভাবেই এরদোগান হতে পারেন মুসলিম বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতা।
লেখক : প্রকৌশলী ও কলামিস্ট