রোজা ইসলামের চালিকা শক্তি

আ ন ম ফজলুর রহমান
ইসলামের মূল ভিত্তি পাঁচটি। এর মধ্যে রোজা ইসলামের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি, যা অন্যান্য ভিত্তির চালিকা শক্তি। বলা যায় রোজা ইসলামের মূল ভিত্তির অন্যতম। সব নবীর শরিয়তে রোজা ফরজ ছিল। উম্মতে মোহাম্মাদীর ওপর রমজানের রোজা ফরজ হয় দ্বিতীয় হিজরিতে। রোজা ফারসি শব্দ। এর আরবি রূপ সাওম, বহুবচনে সিয়াম। এর আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা, পরিত্যাগ করা। নিয়তসহকারে আল্লাহর নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে সুবহে সাদেকের প্রারম্ভ থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার ও যৌনক্রিয়া থেকে বিরত থাকাই শরিয়তের পরিভাষায় সওম বা রোজা বলে। প্রত্যেক মুসলমান বিবেকসম্পন্ন সুস্থ নর-নারীর ওপর রমজানের রোজা ফরজ। আল্লাহ তায়ালার অসীম দয়ার মাস মাহে রমজান। বিশ্বাসীদের মুত্তাকি বা আল্লাহভিরু করে তৈরির জন্যই আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক সুস্থ সাবালক নর-নারীর জন্য রোজা ফরজ করেছেন। রাসূল সা: রমজান মাসকে শাহরুল আজিম এবং শাহরুম মুবারক নামে আখ্যায়িত করেছেন। মানবজাতির জন্য আল্লাহ তায়ালার প থেকে দেয়া রহমতের নেয়ামতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উত্তম নেয়ামত হচ্ছে হেদায়েতের পথনির্দেশিকা একটি সম্পূর্ণ জীবন বিধান আল কুরআন। আর এ পবিত্র কুরআন এ মাসেই নাজিল হয়েছিল। রোজা সম্পর্কে কুরআনের নির্দেশ : ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হলো। যেভাবে উহা ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমারা সংযমী হও’ (সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)। ‘রমজান মাস, এতে কুরআন নাজিল হয়েছে যা গোটা মানবজাতির জন্য জীবনযাপনের বিধান এবং তা এমন সুস্পষ্ট উপদেশাবলিতে পরিপূর্ণ যা সঠিক ও সত্য পথপ্রদর্শন করে এবং হক ও বাতিলের পার্থক্য পরিষ্কাররূপে তুলে ধরে’ (সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৫)। ‘রোজার সময় রাত্রি বেলা স্ত্রীদের সাথে সঙ্গম করা তোমাদের জন্য হালাল করে দেয়া হয়েছে। তারা তোমাদের পে পোশাক আর তোমরাও তাদের জন্য পোশাকস্বরূপ’ (সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৭)। ‘আর রাত্রি বেলা খানা-পিনা করো যতণ পর্যন্ত না তোমাদের সম্মুখে রাত্রির শুরু হতে প্রভাতের শেষ আভা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে তখন এসব কাজ পরিত্যাগ করে রাত্রি পর্যন্ত তোমরা রোজা পূর্ণ করে নাও’ (সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৭)। ‘আজ হতে যে ব্যক্তি এ মাসের (রমজান) সম্মুখীন হবে তার পে পূর্ণ মাসের রোজা একান্ত কর্তব্য। আর যদি কেউ অসুস্থ হয় কিংবা ভ্রমণ কাজে ব্যস্ত থাকে তবে সে যেন অন্যান্য দিনে এ রোজা পূর্ণ করে দেয়’ (সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৫)। রোজা ফরজ বা অবশ্য করণীয় এবং এটা ইসলামের একটি অন্যতম স্তম্ভ। যা কুরআন, হাদিস, ইজমা ও যুক্তি দ্বারা প্রমাণিত। রোজা সম্পর্কে হাদিসের নির্দেশ : হজরত ইবনে ওমর রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের ওপর নির্মিত। ১. এই স্যা দেয়া আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ সা: আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল ২. নামাজ কায়েম করা ৩. জাকাত দেয়া ৪. হজ করা এবং ৫. রমজানের রোজা রাখা’ (বুখারি ও মুসলিম)। হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা: বলেন, ‘আমি একবার রাসূলুল্লাহ সা:’কে বললাম, হুজুর আমাকে এমন একটি আমলের কথা বলে দিন যা আমাকে বেহেশতে নিয়ে যাবে এবং দোজখ হতে দূরে রাখবে। রাসূল সা: বললেন, আল্লাহর ইবাদত করবে তাঁর সাথে কাউকে শরিক করবে না। নামাজ কায়েম করবে, জাকাত আদায় করবে, রমজানের রোজা রাখবে, বায়তুল্লাহর হজ করবে। অতঃপর হুজুর সা: বললেন, মুয়াজ আমি কি তোমাকে মঙ্গলের দ্বারগুলো কী তা বলে দেবো না? জেনে রেখ রোজা হচ্ছে (কুপ্রবৃত্তির মোকাবেলা) ঢালস্বরূপ’ (আহমদ তিরমিজি ও ইবনে মাযাহ)। হজরত আবু হুরায়রা রা: বর্ণনা করেন, নবী করিম সা: বলেছেন, ‘তোমাদের কাছে রমজান মাস সমুস্থিত। যা এক অত্যন্ত বরকতময় মাস। আল্লাহ এ মাসে তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করেছেন, এ মাসে আসমানের দরজা উন্মুক্ত হয়ে যায়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় এবং মারদুদ শয়তানকে আটক করে রাখা হয়। আল্লাহর জন্য এ মাসে একটি রাত আছে যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে লোক এ রাত্রির মহাকল্যাণ লাভ হতে বঞ্চিত থাকল সে সত্যই বঞ্চিত ব্যক্তি’ (নাসায়ি, মুসনাদে আহমদ, বায়হাকি)। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: ঘোষণা করেছেন, ‘যে লোক ঈমান ও চেতনাসহকারে রমজান মাসের রোজা রাখবে তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গুনাহ মাফ করা হবে’ (বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ, নাসায়ি, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমদ)। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত রাসূল সা: বলেছেন, ‘রোজা ঢালস্বরূপ’ তোমাদের কেউ কোনো দিন রোজা রাখলে তার মুখ থেকে যেন খারাপ কথা বের না হয়, শোরগোল না করে। কেউ যদি তাকে গালমন্দ করে বা ঝগড়ায় প্ররোচিত করতে চায় সে যেন বলে, আমি রোজাদার’ (বুখারি, মুসলিম)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর বর্ণনা করেন রাসূল সা: বলেছেন, ‘রোজা ও কুরআন রোজাদারদের জন্য শাফায়াত করবে, রোজা বলবে, হে আল্লাহ, আমি এ ব্যক্তিকে দিনে খাবার ও অন্যান্য কামনা-বাসনা থেকে ফিরিয়ে রেখেছি অতঃপর তুমি আমার সুপারিশ গ্রহণ করো। কুরআন বলবে, হে আল্লাহ আমি এ ব্যক্তিকে রাতের নিদ্রা থেকে ফিরিয়ে রেখেছি। তুমি আমার সুপারিশ গ্রহণ করো। আল্লাহ তাদের উভয়ের সুপারিশ গ্রহণ করবে’ (বায়হাকি শুয়াবুল ঈমান)। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: ফরমায়েছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা এবং তদানুযায়ী আমল পরিত্যাগ করতে পারল না এমন ব্যক্তির পানাহার পরিত্যাগ করার কোনো প্রয়োজন নেই’ (বুখারি )। হজরত আবু সাঈদ খুদরী রা: হতে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহর সা:’কে বলতে শুনেছি, যে লোক এক দিন আল্লাহর পথে রোজা রাখবে আল্লাহ তার মুখমণ্ডল জাহান্নাম থেকে সত্তর বছর দূরে সরিয়ে রাখবেন’ (বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, নাসায়ি)। হজরত আবু হুরায়রা রা: বর্ণনায় বলেছেন, নবী করিম সা: বলেছেন, ‘আদম সন্তানের প্রতিটি নেক আমলের সওয়াব দশ গুণ থেকে সাত শ’ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু আল্লাহ বলেছেন, রোজা এর ব্যতিক্রম কেননা তা একান্তভাবে আমারই জন্য অতঃপর আমিই এর প্রতিফল দিব। রোজা পালনে আমার বান্দা একান্তভাবে আমারই সন্তোষ বিধানের জন্য দু’টি আনন্দ একটি ইফতারের সময় এবং অন্যটি তার মালিক আল্লাহর সাথে সাাৎ লাভের সময়। নিশ্চয় জেনে রেখো রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের সুগন্ধি হতেও অনেক উত্তম’ (বুখারি, মুসলিম)। হজরত সাহল ইবনে সা’দ বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা: বলেছেন, ‘বেহেশতের একটি দুয়ার আছে যার নাম রাইয়ান, এই দুয়ার দিয়ে কিয়ামতের দিন এক মাত্র রোজাদারই বেহেশতে প্রবেশ করবে। তাদের ছাড়া আর কেউ প্রবেশ করবে না। পরে দুয়ার বন্ধ করে দেয়া হবে’ (বুখারি মুসলিম)। রোজা ইসলামের একটি বড় রুকন। যে রোজা রাখবে না সে বড় গোনহগার হবে এবং তার দ্বীন দুর্বল হয়ে যাবে। ইজমা : ইসলামের প্রথম যুগ হতে এ যুগ পর্যন্ত দলমত নির্বিশেষে সব মুসলমানই রমজানের রোজা ফরজ বলে বিশ্বাস ও পালন করে আসছেন। যুক্তি : (ক) রোজা দ্বারা আল্লাহর নির্দেশ পালন করা হয় আর যাঁকে স্রষ্টা বলে স্বীকার করা হয়েছে তাঁর নির্দেশ পালন করা যুক্তিযুক্ত। (খ) রোজা দ্বারা সংযম শিা করা হয় আর সংযম হলো একটি বাঞ্ছনীয় ও প্রশংসনীয় বিষয় (গ) আল্লাহ তায়ালা যে মানুষকে পানাহার করার ও যৌনুধা মিটাবার সামগ্রী দান করেছেন, তাঁর কৃতজ্ঞতা আদায় করার জন্য তাঁর নির্দেশে এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তা থেকে বিরত থাকাও যুক্তিসঙ্গত কথা। রোজার উদ্দেশ্য : বিষপানে যেরূপ বাহ্যিক জীবনের অবসান হয়, পাপানুষ্ঠানেও তদ্রƒপ মানবতার মৃত্যু ঘটে। সারা বছর পর এক মাস কাল আল্লাহর সন্তুষ্টি পানাহার ও স্ত্রী সহবাস হতে বিরত থেকে যৌন উন্মাদনামূলক সব বিষয় থেকে অন্যায়, অশ্লীল ও সব ধরনের পাপ কাজ থেকে বিরত হয়ে পৈশাচিক মনোভাব দূর করে প্রকৃত খোদাভীতি অর্জন করাই রোজার উদ্দেশ্য। রোজার উপকারিতা : রোজা মানুষের দেহ ও আত্মার নানাবিধ উপকার সাধন করে থাকে। রোজা দ্বারা মানুষের আত্মার পবিত্রতা ও চিন্তা শক্তির প্রখরতা বৃদ্ধি পায়। এ কারণেই জাতি ধর্ম নির্বিশেষে আবহমান কাল হতেই মনি ঋষিগণকে উপবাস করতে এবং সুফি সাধকদেরকে রোজা রাখতে দেখা যায়। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানেও এর বিশেষ উপকারিতা স্বীকৃত হয়েছে। ডা: সালমান তার গার্হস্থ স্বাস্থ্য বিধিতে মানব দেহ ইঞ্জিনের সাথে তুলনা করে বলেন, ইঞ্জিন রাকল্পে মাঝে মাঝে তাকে নিয়ে চুল্লি হতে ছাই ও অঙ্গার সম্পূর্ণরূপে নিষ্কাশিত করা যেমনটা আবশ্যক উপবাস দ্বারা মাঝে মাঝে পাকস্থলী হতে অজীর্ণ খাদ্যটি নিষ্কাশিত করাও তেমনটা দরকার। এ ছাড়া রোজা সফরে মুসাফিরকে এবং যুদ্ধের ময়দানে সেনাকে পানাহার কষ্ট করতে অভ্যস্ত করে তোলে এবং নাযনিয়ামতে ডোবা বড় লোকদিগকে অনাহারকিষ্ট দ্বীন দরিদ্রের ুৎ পিপাসার কষ্ট উপলব্ধি করতে সহায়তা করে। যে রোজায় বিশ্বাস করে কিন্তু তা পালন করে না সে ফাসেক, পূর্ণ মুসলমান নয়। ইসলামের গোটা একটি স্তম্ভকে বাদ দিয়ে মুসলমান বলে দাবি করার অধিকার তার নেই। রোজা আল্লাহর প্রতি দৃঢ় ঈমান আনতে কালেমায় স্যা দেয়ায় মজবুতি আনে, নামাজ পড়ায় অভ্যস্ত করে তোলে, জাকাত দেয়ার প্রবণতা বাড়ায়, হজের মানসিকতা সৃষ্টি করে। এ ছাড়া রোজা মানুষের সব ভেদাভেদ দূর করে, সাম্য-মৈত্রীর বন্ধন অটুট রাখে। ইসলামের মৌলিক বিষয়ের পাশাপাশি অন্য সব ইবাদতে উদ্বুদ্ধ করে। এজন্য বলা যায় রোজা ইসলামের মূল চালিকা শক্তি।
লেখক : প্রবন্ধকার

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button