মুখোমুখি রাশিয়া-তুরস্ক, সিরিয়ায় সমাধান দূর অস্ত
‘আমাদের সিরিয়ার সঙ্গে প্রায় ৯০০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে, রাশিয়া এখানে কী করেছে,’ প্রশ্ন তুলেছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। তিক্ততা শুরু হয়েছিল তখন থেকেই। শুরু হয়েছিল শঙ্কারও। মঙ্গলবার রাশিয়ার যুদ্ধবিমানকে তুরস্কের যুদ্ধবিমান গুলি করে নামানোর মধ্যে দিয়ে সেই শঙ্কাই সত্য প্রমাণিত হল। যাকে অত্যন্ত গুরুতর ঘটনা বলে মনে করছে রাশিয়া। অন্য দিকে ন্যাটো (তুরস্ক যে দলের সদস্য) ডাক দিয়েছে জরুরি বৈঠকের। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
সিরিয়ার যুদ্ধে রাশিয়ার অংশ নেওয়া মূলত স্বৈরশাসক বাসার আল-আসাদকে রক্ষা করতে। সঙ্গে আছে ইরানও। সেই কাজে আসাদ বিরোধীদের দিকে নিশানা করেছে রাশিয়া। অদ্ভূত ভাবে সেই কাজে সিরিয়ার পশ্চিম ও উত্তর দিকেই বেশি আক্রমণ হয়েছে। বেশি আক্রমণ শানিয়েছে রাশিয়া।
এই অঞ্চলে আসাদ বিরোধীরা আছে ঠিকই। কিন্তু তাদের পশ্চিমী বিশ্ব সমর্থন করছে। সমর্থন করছে তুরস্কও। মিশরের আকাশে রাশিয়ার যাত্রীবিমান ধ্বংস এবং প্যারিসে হামলার পরে রাশিয়ার বিমানহানার লক্ষ্য ইসলামিক স্টেটের (আইএস) ঘাঁটির দিকে (সিরিয়ার পশ্চিমে মূলত রাকাকে কেন্দ্র করে) কেন্দ্রীভূত হলেও মূল খটকা রয়েই গিয়েছে।
খটকাটি হল আসাদের ভবিষ্যত নিয়ে। নতুন সিরিয়ায় আসাদের অবস্থান কী হবে তা নিয়ে সর্বসম্মত কোনো অবস্থান তৈরি হয়নি। আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমী বিশ্ব এখনও আসাদকে নিয়ে ভাবতে রাজি নয়।
প্যারিস হামলার পরে আলোচনার কেন্দ্রে আইএস দমন এলেও এখন পশ্চিমী নজরে নিজেকে উপরে তুলতে পারেননি আসাদ। কিন্তু অন্য দিকে, আসাদকে নতুন সিরিয়ায় কোনো একটি ভূমিকায় রেখে দেওয়া নিয়ে অনড় রাশিয়া। তুরস্কের অভিযোগ, তাই এ দিনও উত্তর সিরিয়ার দিকে গিয়েছিল রাশিয়ার যুদ্ধবিমান।
এই গোলমালের আবহেই এ দিনের ঘটনা। তুরস্কের অভিযোগ, বেশ কয়েক দিন উত্তর সিরিয়ায় সীমান্ত ঘেঁষা অঞ্চলে বোমাবর্ষণ করছে রাশিয়া। এ নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে কথাও তুলেছে তুরস্ক। এই অঞ্চলে আসাদ বিরোধীদের ঘাঁটি আছে তা নিয়ে দ্বিমত নেই। কিন্তু এই বিরোধীদের তুরস্ক সমর্থন করে। তার উপরে এই অঞ্চলের বাসিন্দারা আসলে তুর্ক। মানে জাতিসূত্রে তুরস্কের অধিবাসীদের ঘনিষ্ঠ। ঠিক যেমনটি করে ইউক্রেনের বসবাসকারী রাশিয়ানদের রক্ষার জন্য অনড় রয়েছে রাশিয়া- যা ইউক্রেন সমস্যার সমাধানকে কঠিন করে তুলেছে।
মঙ্গলবারের ঘটনার পরে আইএস বিরোধী অভিযান নিয়েই সমস্যা তৈরির আশঙ্কা রয়েছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ যতই আজ ক্যামেরন, কাল ওবামা, পরশু পুতিনের সঙ্গে দেখা করুন না কেন আইএস বিরোধী সর্বসম্মত জোটের আশা কিন্তু বেশ কম গেল।
ওলাঁদের লক্ষ্য ছিল (প্রকারান্তরে আমেরিকারও), আক্রমণের মুখ আইএস-এর দিকেই ঘুরিয়ে দেওয়া। কিন্তু রাশিয়া যে এ বার বেঁকে বসবে তাতে সন্দেহ নেই। এমনকী তুরস্কের উপরে প্রত্যাঘাতের আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে এত দিন পিছনে থাকলেও (অস্ত্র ও আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করলেও) এ বার তুরস্ককে সম্মুখ সময়ে আসতে হবে। তুরস্কের সামরিক শক্তি নিয়ে শঙ্কার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সমাধানের পথ থেকে সিরিয়ার সমস্যা আরও জটিলতার দিকে সরে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এই আশঙ্কার বাতাবরণ অবশ্য আইএস-এর কাছে শাপে বরের মতো। কারণ বিশ্বশক্তি নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে মেতে থাকলে তাদের কিছুটা স্বস্তি মেলে। সময় মেলে নতুন পরিকল্পনা তৈরিতে। আরো আঘাত আররো নিরাপরাধের প্রাণনাশের পথও সুগম হয়। –আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ