মাদকাসক্তির ভয়াল থাবা : দায়িত্ব ও মূল্যবোধ কোথায় ?

Madokমুফতি এনায়েতুল্লাহ:
খবরটি শুনেই চমকে উঠেছে গোটা দেশবাসী। কি নিদারুণ সময় আর সমাজে বাস করছি আমরা? স্নেহ ভালোবাসা কোমলতা কি ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে নির্মমতার অতলে? তা না হলে কিশোরী মেয়ে ঐশীর হাতে এমন নৃশংসভাবে খুন হতে পারেন মা-বাবা! যে বয়সে মা-বাবার স্নেহ ভালোবাসার কোলে মুখ গুঁজে যার আদর নেওয়ার কথা, সে কি করে এমন নিষ্ঠুর হন্তারক হতে পারে? এরপরও কি আমাদের মেনে নিতে হবে- মানুষের সমাজে বসবাস করছি আমরা?
বহুল আলোচিত এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড আমাদের অস্থির পরিবার ও ঘুণেধরা সমাজের এক ভয়াবহ পরিণতির চিত্র তুলে ধরলো। ভোগ আর অপরিমিতির জীবনাচারে ডুবে থাকা এবং সবকিছুকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা যে ক্রমশ অভিশপ্ত জীবনে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের- এই হত্যাকাণ্ড তারই এক নিদারুণ চিত্র। কী ভাবে মেয়েটি এত অল্প বয়সে মাদকাসক্ত হলো? খুব সহজ উত্তর। মা-বাবার ব্যস্ততা, নিজেকে নিয়ে এক ধরনের স্বার্থচিন্তা, নাগরিক জীবনের উল্লাস, উন্মত্ততা সন্তানদের বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে মা-বাবার কাছ থেকে। ফলশ্র“তিতে সেই সন্তান আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব ও সামাজিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকছে। সামাজিক অনুশাসন, পারিবারিক ঐতিহ্য, রীতিনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে তারা পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। এ কারণে বখে যাচ্ছে তারা।
এমন খারাপ সংস্কৃতি চলতে থাকলে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত সম্ভব নয়। আসলে যার যা কাজ, তা না করার কারণেই আজ আমাদের এই হাল হয়েছে। নয় তো পরিবারের লোকদের ফাঁকি দিয়ে, প্রশাসনের নাকের ডগায় মাদক ব্যবসা এতটা ব্যাপক আকার ধারণ করে কিভাবে? সহযোগী এক দৈনিকের অনুসন্ধানে জানা যায়, মাত্র এক বছরের মধ্যে নেশাখোর সন্তানের হাতে অন্তত ২৭ জন পিতা-মাতা নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। একই সময়ে মাদকসেবী স্বামীর হাতে প্রাণ গেছে ১৬ জন নারীর। রাজধানী ও বড় বড় শহর থেকে গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত মাদক আজ সহজলভ্য। নগরের অভিজাত এলাকা, ক্লাব, উচ্চবিত্তদের নিবাস থেকে শুরু করে বস্তির ঘিঞ্জি এলাকা- সর্বত্র মাদকের ভয়াল থাবা যৌবন ও তারুণ্যকে জাপটে ধরেছে। কারা এসব মাদক আনছে? মাদকাসক্ত হয়ে শত শত কিশোর-কিশোরীর জীবন এখন বিপর্যয়ের মুখে। খুন-খারাবির ঘটনাও ঘটে চলেছে এই মাদককে কেন্দ্র করে। ঐশী যার বড় প্রমাণ। ঐশীর ঘটনা আমাদের সমাজের জন্য এখন এক বড় প্রশ্ন।
বাবা-মাকে খুনের দায়ে ঐশীর বিরুদ্ধে সবাই এখন ঘৃণা প্রকাশ করছে। কিন্তু প্রাণ চঞ্চল এই কিশোরীর এমন অধঃপতনের দায় কি শুধু তার একার? সে তো কোনো অন্ধকার সমাজে বাস করতো না। আলো ঝলমলে এ রাজধানীর অভিজাত বিদ্যাপীঠে পড়তো। সে বসবাস করতো একটি শিক্ষিত পরিবারে। তারপরও এ কিশোরী বয়সে সে কি করে নেশার জগতে প্রবেশ করলো? কোনো অশিক্ষিত মূর্খ তাকে এ পথে নিয়ে যায়নি। ঐশীকে এ পথে নিয়ে গেছে তার কথিত আধুনিক বয়ফ্রেন্ডরা। রাজধানীর অভিজাত পল্লীর ডিসকো বার ও ডিজে পার্টি তাকে উন্মাতাল করতে বিশেষভাবে প্রণোদনা দিয়েছে। শুধু এক ঐশী নয়, উচ্ছৃঙ্খল এ পথে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনছে আরও বহু কিশোর-কিশোরী ও যুবক-যুবতী। কিন্তু প্রশ্ন হলো, অভিজাত পল্লীর এসব ডিসকো বার ও ডিজে পার্টি সম্পর্কে আমাদের প্রশাসন ও সমাজপতিরা কি অবহিত নন?
এটা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, সামাজিক অবক্ষয়, অসৎ সঙ্গ, ধর্মীয় অনুশাসনের ঘাটতি ও নৈতিক মূল্যবোধের অভাবের পাশাপাশি সচেতনতার সঙ্কটের প্রেক্ষিতে সমাজে এসব ঘটনা ঘটছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব ঘটনার জন্য বাবা-মা দায়ী। শুরু থেকে নজরদারি থাকলে এ ধরনের ঘটনা ঘটত না। বস্তুত পারিবারিক কাঠামোর একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে পিতামাতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক। পিতা-মাতার অতিরিক্ত প্রত্যাশা, অতিরিক্ত নিয়ম-কানুন কিংবা খোঁজখবর না রাখার প্রবণতা এবং দ্বন্দ্বমূলনক নির্দেশনা সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে আচরণ ও আবেগীয় সমস্যা তৈরি করে। এ সমস্যা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
আমাদের কিশোর-কিশোরী ও যুব সমাজকে অসৎ সঙ্গ ও অসৎ পরিবেশ থেকে রক্ষার ব্যাপারে অভিভাবকদের বাইরেও সমাজ ও প্রশাসনের ব্যাপক দায়িত্ব রয়েছে। তাই বখে যাওয়ার জন্য শুধু ঐশী একা দায়ী নয়। নিজ নিজ জায়গায় আরও অনেকেই এর দায় এড়াতে পারেন না। ঐশী তো একদিনে এ পথে আসেনি। হেরোইন, ইয়াবা ও ডিজে পার্টি পর্যন্ত পৌঁছতে তার অনেক সময় লেগেছে। এই সময়টায় পরিবার, স্কুল, সমাজ ও রাষ্ট্র তার প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করলে ঐশীকে আজ হয়তো ‘খুনি’ মেয়ে হিসেবে পরিচিত হতে হতো না।
আরেকটি কথা, অসৎ সঙ্গ ও অসৎ পরিবেশ থেকে রক্ষার জন্য যে নৈতিক শিক্ষা প্রয়োজন, দেশের শিক্ষা কারিকুলাম কি আমাদের শিশু-কিশোরদের তা দিতে সমর্থ হয়েছে? শিশু-কিশোরদের বিনোদন চাহিদা মেটাতে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো ব্যর্থ হওয়ায় তারা এখন গভীর রাত পর্যন্ত জেগে দেখে হিন্দি ও ইংরেজি চ্যানেল। ওইসব চ্যানেলে তো অশ্লীল ও ক্রাইম ছবি কিংবা সিরিয়ালের কোনো অভাব নেই। আর মোবাইল ফোন, ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমও এখন এতটাই অবারিত হয়ে গেছে যে, তার মন্দ ব্যবহার আমাদের কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীর জীবনে বিষফল বয়ে আনছে। তাই আজ ‘খুনি’ মেয়ে হিসেবে শুধু ঐশীকে নিন্দাবাদ করলে চলবে না, আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজেদের দায়িত্বও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে অভিভাবক, স্কুল, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে। সংশ্লিষ্ট সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করলে হয়তো বখে যাওয়ার হাত থেকে আমরা ভবিষ্যতে রক্ষা করতে পারবো বহু ঐশীকে। আমাদের সন্তানরা আজ সর্বনাশের শেষ সীমানায় দাঁড়িয়ে, আমরা কি তাদের টেনে তুলবো না? রাষ্ট্র, সমাজ, অভিভাবক এখনও কি সচেতন হবে না?

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button