আল্লাহর পথে আহ্বানে নারী সমাজ
আমাতে জুলজালাল: মহান রব্বুল আলামীনের সীমাহীন শোকরিয়া আজ পৃথিবীর দেশে দেশে ইসলামী জাগরণে নারী সমাজ বেশ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলছে। আমাদের বাংলা দেশের নারী সমাজে অধুনা এ ব্যাপারে বেশ তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু তার পরেও এদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে নারীদের ইসলামী দাওয়াত ও সংগঠনের কাজ করার ব্যাপারে কোন কোন মহল থেকে কিছু রক্ষণীল মনোভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেক সময় দাওয়াতী কাজে নানা জায়গায় মহিলাদের যেতে হয়। অনেকে প্রশ্ন করেন বর্তমান সময় মহিলারা যেভাবে আল্লাহর পথে আহ্বানের কাজে বিভিন্ন পাড়ায় মহল্লায় ঘুরে বেড়ান এমন কর্ম পদ্ধতি কি রসুল (স.)-এর কালে বর্তমান ছিল এবং এমন ব্যবস্থা কতটা শরীয়ত সম্মত?
এ ধরনের পত্র-পত্রিকাতে বিভিন্ন সময় দেখা যায়। এসব প্রশ্নের উত্তরও যথাসময় দেয়া হয়েছে। তার পরেও সহজ উপলব্ধির জন্য একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর সংক্ষেপে নিম্নে দেয়া হল।
প্রশ্ন : মহিলাদের জামাতবদ্ধ হয়ে তা’লীমি জলসা অনুষ্ঠান করা জায়েয কি না? ইসলামী বিষয়ে অভিজ্ঞ কোন মহিলার বাড়িতে পর্দাপুশিদা মত অনেক মহিলা বিভিন্ন মাসয়ালা মাসায়েল জানার জন্য সমবেত হয় এবং কোন অভিজ্ঞ মহিলাকে ও মাঝে মাঝে দাওয়াত দিয়ে ভক্তদের বাড়িতে তা’লীমি জলসা করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। এরূপ তা’লীমি জলসা করা বেদায়াত কি না?
উত্তর : মহিলাদের জন্য তা’লীমি জলসা করা মোটেই বেদায়াত নয় বরং মছনুন। হযরত নবী করীম (স.) মেয়েদের জন্য পৃথক সময় নির্ধারণ করতেন। সেই সময় মহিলাগণ একত্রিত হয়ে দ্বীনি বিষয়াদি শিক্ষা করতেন।
উম্মত জননীগণের নিকটও পবিত্র কোরআনসহ শিক্ষা দ্বীনের বিভিন্ন বিষয় শিক্ষাগ্রহণ করার উদ্দেশ্যে স্ত্রী লোকগণ সমবেত হতেন। তার পর থেকে মুরুব্বী শ্রেণীর মেয়েদের নিকট গ্রাম মহল্লার মেয়েরা সমবেত হয়ে পবিত্র কোরআনসহ মাছয়ালা মাছায়েল শিক্ষা করার রেওয়াজ দুনিয়ার সকল অঞ্চলের মুসলিম সমাজে প্রচলিত আছে। সুতরাং তা’লীমের এই ছেলছেলাকে বেদায়াত বলার কোন কোনই অবকাশ নাই। (মাসিক মদীনা -মে ২০০০)
রসুলুল্লাহ (স.)-এর সময় মহিলারা জামাতবদ্ধভাবে বিশেষ দিনে তাঁর কাছে ইসলামের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানার জন্য আগমন করতেন। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, “মেয়েরা নবী (স.)কে বলল: আপনার কাছ সব সময় পুরুষদের ভিড় লেগে থাকে । তাই আমরা আপনার মূল্যবান উপদেশ থেকে বঞ্চিত থেকে যাই। আপনি আমাদের জন্য আলাদা একটি দিন ধার্য করে দিন। সুতরাং নবী (স.) একটি দিন নির্র্দিষ্ট করে তাদের কাছে গেলেন, তাদেরকে বিভিন্ন বিষয় বুঝিয়ে বললেন এবং সৎকাজের আদেশ দিলেন। (বোখারী)
রসুলুল্লাহ (স.)-এর যুগে ইলমে দ্বীন শেখার তাগিদে মহিলাগণ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করতেন, যা মুহায়রা বিনতে হুদায়েবের একটি বর্ণনা থেকে জানা যায়। তিনি বলেন: “হজ্জ আদায় করার পর আমরা কয়েকজন মহিলা মদীনায় গিয়ে হযরত সাফিয়্যা (রা.) -এর খেদমতে হাজির হলাম। সেখানে পৌঁছে আমরা দেখতে পেলাম কুফার কিছু সংখ্যক মহিলা পূর্বেই তাঁর খেদমতে বসে আছেন। আমরা তাঁকে দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয় এবং হায়েজ ও নাবীযের বিধান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম।” (মসনদে আহমদ)
সাহাবায়ে কেরাম (রা.) সমাজ সংস্কারে যে চেষ্টা সাধনা করতেন তাতে পুরুষদের সাথে নারীরাও অন্তর্ভুক্ত থাকতেন। আয়েশা নাম্নী এক মহিলা আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের বক্তৃতা উল্লেখ করে বলেন: “আমি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদকে নারী ও পুরুষদের উদ্দেশ্যে এই বলে নসীহত করতে দেখেছি যে নারী পুরুষ নির্বিশেষে তোমাদের মধ্য থেকে যেই ফেতনার যুগে মুখোমুখি হবে সে যেন নবী (স.) এর সাহাবাদের কর্মপন্থা দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করে।”
সাহাবীদের যুগে নারীগণ এই হুকুম মেনে চলতে গিয়ে দায়ী ইলাল্লাহর ভূমিকায় যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছেন। দায়ী ইলাল্লাহর ভূমিকায় মহিলা সাহাবীগণ ছিলেন অত্যন্ত তৎপর। তার অন্যতম নমুনা আরওয়া বিনতে আব্দুল মোত্তালিব। আসুলুল্লাহ স.-এর ফুফু আরওয়া বিনতে আব্দুল মোত্তালিব সম্পর্কে ইবনে আব্দুল বার লিখেছেন, “ ঈমান আনার পর তিনি নবী (স.)কে সাহায্য – সহযোগিতা করতেন এবং তাঁকে সাহায্য করা এবং তাঁর লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করার জন্য নিজের ছেলেকে উৎসাহিত করতেন। (আল ইসতিয়াব ফী আসমাইল আসহাব)
শুধু তাই নয়,শরীয়ত ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে মতামত প্রদান করতেন যা সাদরে গৃহীত হত। হযরত হাসান বসরী (র.) নবী (স.)-এর একটি সাধারণ কর্ম পদ্ধতি ও আদর্শ সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “নবী (স.) মেয়েদের সাথেও পরামর্শ করতেন। কোন সময় মেয়েরা এমন মতামত পেশ করতেন যা তিনি গ্রহণ করতেন। (উয়ুনুল আখবার)
বর্তমানে যে পদ্ধতিতে জানাযা পড়া হয় ইসলামের প্রথম দিকে তা মুসলমানদের মধ্যে চালু ছিল না। হযরত আসমা বিনতে উমায়েস হাবশায় খ্রিষ্টানদের মধ্যে এ নিয়ম দেখছিলেন । তিনি এর পরামর্শ দিলে তা গৃহীত হয়। (তাবাকাতে ইবনে সাদ)
ইবনে সিরীন হযরত উমর (রা.) সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন:
উপস্থিত সমস্যা সম্পর্কে উমর (জ্ঞানী লোকদের সাথে) পরামর্শ করতেন এমনকি (সে সব বিষয়ে জ্ঞানের অধিকারিণী) মেয়েদের সাথেও পরামর্শ করতেন। তাদের মতামতে কল্যাণকর কোন দিক থাকলে বা কোন উত্তম বিষয় দেখলে তিনি তা গ্রহণ করতেন। (আল সুনানুল কোবরা)
সাহাবীদের যুগের পরেও নারীগণ দাওয়াতী কাজ থেকে বিরত থাকেননি। এ জন্য এমনকি তারা মাতৃভূমি ত্যাগ করতেও রাজি হয়েছেন। এমন একজন মহিলা দায়ী রওশন আরা। চব্বিশ পরগণা ও খুলনা অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের সাথে জড়িত ছিলেন মুজাহিদ সাইয়েদ আব্বাস আলী মক্কী ও তার বোন রওশন আরা। মক্কা নগরে রওশন আরা জন্মগ্রহণ করেন। ১৩২১ খ্রিষ্টাব্দে সাইয়েদ আব্বাস আলী মক্কী ও বোন রওশন আরা দিল্লীতে আগমন করেন।
সাইয়েদ আব্বাস আলী মক্কীর বোন রওশন আরা একজন বিদূষী মহিলা ছিলেন। মক্কা নগরীতে ১২৭৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর জন্ম হয়। তিনি ভাই আব্বাস আলীর সাথে প্রথমে দিল্লীতে পরে বাংলায় আগমন করেন। চব্বিশ পরগণার তারাবুনিয়া গ্রামে অবস্থান করে তিনি ইসলাম প্রচারের কাজে আত্ম নিয়োগ করেন বলে জানা যায়। ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দে ৬৪ বছর বয়সে তিনি ইন্তিকাল করেন। (বাংলাদেশে ইসলাম- আ. মান্নান তালিব)
আল্লাহর পথে আহ্বান এমন একটি গুরুত্বপুর্ণ কাজ যা করা প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ফরজ, চাই সে পুরুষ হোক বা নারী হোক। আল্লাহর পথে আহ্বানের অন্যতম মূল অর্থ হল উত্তম মুসলমান তৈরি করা এবং একটি উত্তম সমাজ তৈরি করা। (To prepare the good muslim and to establish the good society) কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয়: প্রকৃত ইসলামী শিক্ষার অভাবে আমাদের সমাজের মহিলারা ইসলামবিরোধী আদর্শের প্রতিষ্ঠায় তারা যেন মনে হয় পুরুষের চেয়েও সক্রিয়। বর্তমান সমাজে ইসলাম বিরোধী নারী পুরুষেরা জোট বেঁধে খোদাদ্রোহী মতাদর্শ প্রতিষ্ঠায় এক অপরকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করে চলছে। জাতির এমন সংকট মুহূর্তে দ্বীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ঈমানদার নারী-পুরুষ বিচ্ছিন্নভাবে থাকতে পারে না। এমতাবস্থায় ইসলামপ্রিয় মা বোনেরা কিছুতেই নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকতে পারে না।
সত্যিকার নিষ্ঠাবান মুমিন পুরুষ ও নারী এক স্বতন্ত্র গোষ্ঠী তাদের মধ্যে কতগুলো বৈশিষ্ট্য সমানভাবে বিদ্যমান। যেমন আল্লাহর পথে আহ্বানের দায়িত্ব শুধুমাত্র পুরুষদেরই নয়, বরং নারী পুরুষ সকল বান্দা-বান্দী এর আওতাভুক্ত। আল্লাহ বলেন, “মুমিন পুরুষ ও মুমিনা স্ত্রীলোক পরস্পর বন্ধু সাথী। তারা যাবতীয় ভাল কাজের নির্দেশ দেয় ও পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। নামাজ কায়েম করে , যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রসুলের আনুগত্য করে। এরা এমন লোক যাদের উপর আল্লাহর রহমত অবশ্যই নাযিল হবে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সর্বজয়ী, অভিজ্ঞ ও জ্ঞানী। ( তওবা- ৭১)
এ আয়াতখানাতে বর্ণিত ‘একামতে সালাত, আমর বিল মারুফ, ওনেহি আনেল মুনকার’-এর কথা ও গুরুত্ব সমানভাবে পাশাপাশি তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু আমাদের সমাজে মহিলাদের নামায আদায়ের ব্যাপারে যতটুকু উৎসাহ প্রদান করা হয় তার চাইতে বেশি নিরুৎসাহিত করা হয় ‘আমর বিল মারুফ ও নেহী আনেল মুনকারের ’দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে। এ ব্যাপারে পর্দাকে অবাঞ্ছিতভাবে টেনে এনে তাদের দাওয়াতী কাজের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু তারা এটা খেয়াল রাখার প্রয়োজন বোধ করে না যে কোন সমাজে যখন দাওয়াত ইলাল্লাহসহ আমর বিল মারুফ ও নেহী আনেল মুনকারের কাজ থাকে না তখন সে সমাজ থেকে পর্দা বিলীন হতে বাধ্য; যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ কামাল আতা তুর্কের তুরস্ক। আবার ইসলামী শরীয়াহ সমাজে প্রবর্তিত হলে পর্দা স্বাভাবিকভাবেই সমাজের প্রতিটি স্তরে এসে যায়, যেমন ইরানে হয়েছে।
অন্য একখানা আয়াতে বর্ণিত হয়েছে: “আমি তোমাদের মধ্যে কারো কোন কাজকে নষ্ট করে দেব না। পুরুষ হোক কি স্ত্রী- তোমরা সবাই সমজাতের লোক। কাজেই যারা একমাত্র আমার জন্য নিজেদের জন্মভূমি ত্যাগ করেছে ,আমারই পথে নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে বের হয়েছে ও নির্যাতিত হয়েছে এবং আমারই জন্য লড়াই করেছে ও নিহত হয়েছে তাদের সকল অপরাধ আমরা মাফ করে দেব এবং তাদের আমি এমন বাগিচায় স্থান দেব যার নিচ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হবে। আল্লাহর নিকট এটাই তাদের প্রতিফল; আর উত্তম প্রতিফল একমাত্র আল্লাহর কাছেই পাওয়া যেতে পারে। (আলে ইমরান-১৯৫)
এ আয়াত থেকে সুস্পষ্ট যে হিজরত ও আল্লাহর পথে জেহাদের মর্যাদা শুধু পুরুষদের জন্যই নির্ধারিত নয়, নারীদের জন্য সমানভাবে নির্ধারিত।
তাই দায়ী ইলাল্লাহর কাজে মহিলাদের অংশ নেবার প্রয়োজন নেই এমন চিন্তা ঠিক নয়।
তাই তাকওয়ার ভুল ব্যাখ্যা ও পর্দার নামে নিজকে আড়াল করা নয়, বরং মহিলা সাহাবী হযরত উম্মে সালেম, হযরত উম্মে আম্মারার আদর্শকে সামনে রেখে আমাদের নারী সমাজকে ইকামতে দীনের কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে।
ইবনে মাসউদের বক্তৃতার মর্মানুযায়ী যে দেশে ইসলাম ফেৎনার মুখোমুখি হয়েছে সে দেশের নারী সমাজ পুরুষের পাশাপাশি থেকে দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে গেছেন। উদাহরণ স্বরূপ মিসরের দিকে তাকান যায়।
মিসরে ১৯৫৪ সালের ৯ তারিখে ইখওয়ানের ৬ জন শীর্ষ নেতাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে শহীদ করা হলো আর হাজার হাজার ইখওয়ান কর্মীকে কারাগারের দুর্বিষহ জীবনযাপনে বাধ্য করা হল। ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ইখওয়ানের চল্লিশ হাজারেরও অধিক কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিল আটশ’র কাছাকাছি মহিলা। সে সময় জয়নব আল গাজ্জালীকে দশ বছর কারাদ- দেয়া হয়। তা ছাড়াও সাইয়েদ কুতুবের বোন আমিনা কুতুব জেলের অভ্যন্তরে নির্মম অত্যাচারে শহীদ হন। হামিদা কুতুবসহ হাসান আল হোদাইবীর স্ত্রী, তাঁর কন্যা সাইয়েদা খালেদা, ইসমাইল হোদাইবীর স্ত্রী, অধ্যাপক আবদুল হালিম ওশাহীর স্ত্রী ও উস্তাদ আবদুল হালিম সিপাহির স্ত্রীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। তাদেরকে জেলে আটক করেই জুলুমের শেষ হল না, যে সব হৃদয় ব্যক্তিরা এসব আটক ব্যক্তিদের বাড়িতে গিয়ে তাদের পরিবারবর্গের খোঁজ খবর নিতে ছিল তাদেরকেও ষড়যন্ত্রকারী বলে আটক করা হয়েছিল।
১৯৬৬ সালে ২৯ আগস্ট সাইয়েদ কুতুবকে ফাঁসি দেয়া হয়। আর তার বোন হামিদা কুতুবকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। দ্বীন প্রতিষ্ঠার এক অগ্রসেনা ইখওয়ানের জয়নব আল গাজ্জালী। জল্লাদরা এই মহান মহিলাকেও ক্ষমা করেনি। তাঁকে উল্টাভাবে লটকিয়ে তাঁর পায়ে মারা হয় চামড়ার চাবুক। মহিলাটি কষ্ট, যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে এমন চিৎকার করতেন যে তা শুনে শ্রোতার প্রাণ ফেটে যেত। এসব চিৎকারের মাঝেও তিনি কলেমা তাইয়েবা পাঠ করতেন। মাঝে মাঝে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন। সম্বিত ফিরে এলে বলতেন: “জয়নব! তুমি সুমাইয়্যা রাযিআল্লাহ আনহার চেয়ে শ্রেষ্ঠ নও।”
সে সময় থেকে প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরে আজ আবার মুসলিম নর- নারীদের উপরে যে ফেরাউনি নির্যাতন নেমে এসেছে তা সব দেশ-কালের অতীত রেকর্ড ভঙ্গ করে মানবতাকে অপমানিত করেছে। এ সময় ঈমানী চেতনায় ভাস্বর মুসলিম নারীরা বাতাবরণ ছিন্ন করে পুরুষদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রাবেয়া স্কয়ার, আল নাহদা স্কয়ার ও রামসিস স্কয়ারে শাহাদাত বরণ করে বিশ্বমুসলিম নারী জাতির হৃদয়ে শাহাদাতের জজবা জাগ্রত করে এক অমর ইতিহাস রচনা করলেন।
মৌন আগ্নেয়গিরির গর্ভে লুকায়িত প্রজ্জ্বলিত লাভা না দেখা পর্যন্ত যেমন অনুমান করা চলে না আগ্নেয়গিরি কত ভয়াবহ, তেমনি হিজাবের অন্তরালে লুকায়িত সুহাসিনী নারীর রক্ত রাজপথে না দেখা পর্যন্ত অনুমান করা চলে না নারী কত সাহসিনী হতে পারে। বিংশ শতাব্দীর সুমাইয়া, সাফিয়্যা ও আম্মারা মিসরের আসমা বেততাগী, হালাহ ও হাবিবাসহ শত শত মুজাহিদা নারী তাদের প্রাণ আল্লাহর রাহে কোরবানি করে বিশ্ব মুসলিম নারী সমাজকে আবার জাগিয়ে দিল আল্লাহর রাহে জান কোরবানি করতে। ওরা আল্লাহর রাহে শহীদ হয়ে গোটা নারী জাতিকে জানিয়ে দিয়ে গেল কী ভাবে জালেমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়, জান কোরবান করতে হয়।
ইখওয়ানুল মুসলিমুন ও জামায়াতে ইসলামীর দাওয়াত ও সাহিত্যের মাধ্যমে পশ্চিমা নারী সমাজ ইসলাম সম্পর্কে জানতে সক্ষম হয়েছেন, আর তাদের অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেছেন। ১৯৬১ সালের মে মাসে ইসলামের মহান সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন ইহুদী যুবতী মিস মার্গারেট মারকিউস। মওলানা মওদূদীকে লেখা ২৯ শে মে, ১৯৬১ সালের এক চিঠিতে তিনি লেখেন, “পাঁচ দিন আগে ঈদুল আজহার নামাযের পর আমি দু’জন মুসলমান বন্ধুকে সাক্ষী রেখে আনুষ্ঠানিকভাবে কলেমা শাহাদাত উচারণ করে পূর্ণ মুসলমান হয়েছি। এর পর Brooklyn-এর মার্কিন ইসলামী মিশনের শেখ দাউদ আহমদ ফয়সলের কাছ থেকে আমি মুসলমান হওয়ার সনদ নিয়েছি। আমার মুসলমানী নাম মরিয়ম জামিলা। .. ।”
তিনি ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার মানসে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তিনি রচনা করেছেন ‘ইসলাম বনাম পাশ্চাত্য,’ ‘ইসলাম ও আধুনিকতা’, ‘ইসলাম তত্ত্বে ও বাস্তবে’ ‘ইসলাম বনাম আহলে কিতাব অতীত ও বর্তমান’, ‘আহমদ খলিল : একজন ফিলিস্তিনী আরব উদ্বাস্তুর জীবনী’ ইত্যাদি।
অস্ট্রেলিয়ার কুমারী হালিমা শোয়ার্ট নবদীক্ষিত মুসলিম মহিলা-যিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করেন, নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করেন। একজন নিষ্ঠাবতী মুসলিম হিসেবেই তিনি জীবনযাপনে সচেষ্ট। দ্বীন ইসলাম সমগ্র বিশ্বে প্রসার লাভ করুক, এটাই তাঁর ঐকান্তিক কামনা।
বৃটিশ সাংবাদিক ইভোন রিডলে (yvon Ridley) আফগানিস্তানে তালেবানদের হাতে বন্দী হয়ে তাদের ব্যবহারে ইসলামের বাস্তব পরিচয় পেয়ে ২০০৩ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি বিশ্বব্যাপী মুসলিম স্বার্থ সংরক্ষণের প্রচেষ্টায় ইসলামী চ্যানেলে পলিটিক্যাল এডিটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি স্কুল অব ল’ এর মেধাবী ছাত্রী আসমা গুল হাসান ‘Why I am muslim’ পুস্তক রচনা করে গোটা বিশ্বে ইসলামের সৌন্দর্যকে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন।
এভাবে দেশে দেশে বিদূষী নারী সমাজ বিভিন্নভাবে মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের মা বোনদের বসে থাকার অবসর নেই। তাইতো দেখি দিকে ছুটে চলেছেন হাফেজা আসমা খাতুন, জাহনারা আজহারী, শামসুন্নাহার নিজামী, রোকেয়া আনসার, নুরুন্নেসা সিদ্দিকা, আয়েশা খাতুন, ফজিলা তাহেরসহ অসংখ্য নারী। তাঁরা তরুণীদের একদল সাহসিনী আল্লাহর বান্দী নিয়ে মাঠ ময়দানে অবিশ্রান্ত সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে তাদের অনেককে নানা যন্ত্রণা মোকাবিলা করতে হয়েছে, জেলের যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে। আমাদের নারী সমাজকে অলস হয়ে বসে থাকা চলবে না। নারী ও পুরুষ সত্তাকে আলাদা আলাদা চিন্তা করা ঠিক নয়। আদম হাওয়াকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন,
“My own in thee, for what thou art is mine;
Our state cannot be severed; we are one ,
One flesh; to lose thee were to lose myself.”
নারী-পুরুষ সবাইকে সংঘবদ্ধভাবে সমাজে ইসলামের প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এটাই বর্তমান সময় ও সমাজের দাবি।