ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছেন

Trampমুসলিমদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্যের মাধ্যমে রিপাবলিকান দলের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছেন- এ মন্তব্য নিয়ে বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠেছে। নিউইয়র্ক শহরে ট্রাম্পের মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে গতকাল বুধবার গণমিছিল অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। এছাড়া সমালোচনার ঝড় ওঠায় ট্রাম্প এখন রিপাবলিকান দল ত্যাগের ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে দ্য টেলিগ্রাফ জানিয়েছে।
মুসলমানদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছেন দেশটির রিপাবলিকান দলের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার ওই মন্তব্যে বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠেছে। সারা বিশ্বের মুসলমানরা এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।
সেই নিন্দায় সামিল হয়েছে হোয়াইট হাউস, পেন্টাগন, ব্রিটিশ ও ফরাসী নেতা এবং জাতিসংঘ উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির অঙ্গন হয়ে উঠেছে সমালোচনার ঢেউয়ে উত্তাল। ফেসবুক, টুইটারে চলছে তুমুল আলোড়ন। কেউ কেউ এমনও বলেছেন যে, ট্রাম্পের মুখে হিটলারের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বিপুল সমালোচনার মুখে ট্রাম্প রিপাবলিকান দল ছেড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করতে পারেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টের খবরে বলা হয়, বিশ্বের নাগরিকবৃন্দ, রাজনীতিক এবং উদ্বাস্তুবিষয়ক কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থীতার দৌড়ে এগিয়ে থাকা ট্রম্পের মন্তব্যকে ঘৃণা সৃষ্টিকারী মন্তব্য বলে অভিহিত করেন এবং এটি সাম্প্রতিক কয়েক সপ্তাহে দেশটিতে বিরাজমান ইসলামভীতি জনিত পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তোলার ইঙ্গিতবহ বলে মন্তব্য করেন।
মিসরের সরকারী ধর্মীয় সংস্থা দার আল-ইফতা ট্রাম্পের মন্তব্যকে ‘ঘৃণাপ্রসূত বক্তৃতাবাজি’ বলে মন্তব্য করেছে। এদিকে জাতিসংঘ উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থার একজন মহিলা মুখপাত্র ট্রাম্পের মন্তব্যে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ওই মন্তব্য উদ্বাস্তুদর পুনর্বাসনের চলমান প্রক্রিয়াকে ভণ্ডুল করতে পারে। ট্রাম্প গত সোমবার এক বিবৃতিতে মুসলমানদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়ার আহ্বান জানান। ওইদিনই তিনি দক্ষিণ ক্যারোলাইনাই এক সমাবেশে একই আহ্বান জানান। সেখানে সমবেত জনতা তার নামে ধ্বনি দিয়ে তার মন্তব্যকে স্বাগত জানায়।
গত মঙ্গলবার এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারেও একই মন্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেন ট্রাম্প। ট্রাম্পের ওই মন্তব্যের পর হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মুসলিমদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্যের মাধ্যমে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছেন। হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, রিপাবলিকান দলের অন্য সব প্রার্থীর এখনই বলা উচিৎ যে তারা ট্রাম্পকে সমর্থন করেন না। চলমান রাজনীতি প্রসঙ্গে মন্তব্য করা থেকে সচরাচর বিরত থাকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগন। কিন্তু ট্রাম্পের মন্তব্যে বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে পেন্টাগনও।
পেন্টাগনের মুখপাত্র বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইসলামের বিরুদ্ধে ক্রুসেড চালিয়ে যাচ্ছে মর্মে আইএস যে প্রচারণা চালাচ্ছে ট্রাম্পের মন্তব্য আইএসের সেই প্রচারণাকেই সমর্থন যোগাবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার বক্তৃতায় আরও মন্তব্য করেন যে, লন্ডনের একটি অংশে চরমপন্থার এতটাই বিস্তার ঘটেছে যে, শহরটির পুলিশ বাহিনী এখন নিজেদের জীবন নিয়ে শঙ্কিত। প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফের খবরে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ওই মন্তব্যের জন ডোনাল্ড ট্রাম্পের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ট্রাম্পের মন্তব্য বিভেদ সৃষ্টিকারী এবং তা একেবারেই ভুল। ব্রিটেনের বিরোধীদলীয় নেতা জেরেমি করবিন ট্রাম্পের নিন্দা জানিয়ে বলেন, তার মন্তব্য গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর হামলা এবং সাধারণভাবে মানবতার বিরুদ্ধে। করবিন জাতিগত বিদ্বেষের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী জেহ জনসন বলেছেন, ট্রাম্পের মন্তব্য কেবল যে আক্রমণাত্মক তাই নয়, এটি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এনবিসি টেলিভিশনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জনসন ট্রাম্পের মন্তব্যকে ‘দায়িত্বহীন’ বলে এর নিন্দা জানান এবং তা প্রত্যাখ্যান করেন। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে ট্রাম্পের মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে গণমিছিল বের করার কথা গতকাল বুধবার। আর ফ্লোরিডার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরের মেয়র রিক ক্রিসম্যান তার শহরে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছেন। এই নিষেধাজ্ঞার কথাটি টুইটারে জানিয়ে হঠাৎ করেই বিপুলভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন রিক ক্রিসম্যান।
অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠায় ট্রাম্প এখন রিপাবলিকান দল ত্যাগের ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে জানিয়েছে দ্য টেলিগ্রাফ। পত্রিকাটি বলেছে, এক টুইট বার্তায় ট্রাম্প বলেছেন, নতুন এক জরিপে দেখা গেছে, আমি যদি রিপাবলিকান দল ছেড়ে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করি তাহলে ৬৮ শতাংশ সমর্থক আমাকে ভোট দেবেন। উল্লেখ্য, রিপাবলিকান দলের অন্য একজন মনোনয়ন প্রত্যাশী বেন কারসন ট্রাম্পের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেছেন, এটা করা ঠিক হবে না।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়নপ্রত্যাশী ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা দুর্বল করে দিচ্ছে বলে সতর্ক করেছে পেন্টাগন। মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগনের মুখপাত্র পিটার কুক বলেছেন, এ ধরনের কথাবার্তা ইসলামিক স্টেটের কর্মকা-কে আরও জোরদার করতে পারে। এদিকে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ তীব্র সমালোচনার মুখেও দেশটিতে মুসলমানদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাবে অটল রয়েছেন ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট জাপানি-আমেরিকান নাগরিকদের নির্দিষ্ট স্থানে আবদ্ধ করার যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তার সাথে এই পরিকল্পনার কোন পার্থক্য নেই। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বলেছেন, আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এ ধরনের বক্তব্য কোনোভাবেই গঠনমূলক নয়।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের আবাসন খাতের এই ব্যবসায়ীর বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন দেশটির রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, শিক্ষক ও অন্যান্য ধর্মের প্রতিনিধিরা। জাতিসংঘের পাশাপাশি যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রীরাও তার বক্তব্য নাকচ করেছেন। ওই বক্তব্যকে ‘তিরস্কারযোগ্য, ক্ষতিকর ও উস্কানিমূলক’ আখ্যায়িত করে বিবৃতি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট পদে ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়নপ্রত্যাশী হিলারি ক্লিনটন।
‘আমরা কখনোই আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতাদের অঙ্গীকারের কথা ভুলতে পারি না, যার অন্যতম হলো- বসতি স্থাপনকারীদের সঙ্গে কোনো ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ করা হবে না’, বলেন তিনি। ফ্লোরিডার সাবেক গভর্নর জেব বুশ তাকে (ট্রাম্পকে) ‘ভারসাম্যহীন’ অ্যাখ্যা দিয়েছেন। অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী ফ্লোরিডার সিনেটর মারকো রোবিয়ো বলেছেন, ‘ট্রাম্পের প্রস্তাব অবশ্যই আক্রমণাত্মক।’ ‘ধর্মীয় বিদ্বেষপ্রসূত এ মন্তব্য’র সমালোচনা করেছেন ইন্টারফেইথ অ্যালায়েন্সের নির্বাহী পরিচালক রাবাই জ্যাক মলিন।
এক বিবৃতিতে ইহুদীদের এ ধর্মীয় নেতা বলেন, ‘এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতিমালা উপড়ে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ধরনের বৈষম্য আমেরিকাকে কখনোই মহান করতে পারবে না।’
ট্রাম্পের বক্তব্যকে ‘যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস-ঐতিহ্যের পরিপন্থী’ বলে মন্তব্য করেছেন নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ল’র অধ্যাপক ন্যান্সি মরাওয়েটজ। তিনি বলেন, ‘এটি একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয় যে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের পূর্বশর্ত হতে হবে ধর্মীয় বিশ্বাস। এর আগে ধর্মীয় কারণে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি, এমন দৃষ্টান্ত নেই।’
নিউইয়র্কের সিটি পাবলিক এডভোকেট লেটিসা জেমস এক বিবৃতিতে ট্রাম্পের বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেন, ‘এমন ব্যক্তি কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে চায়? তার জানা উচিত, উগ্রপন্থীরা কখনোই আমেরিকানদের সমর্থন পায়নি, ভবিষ্যতেও পাবে না।’ ‘যুক্তরাষ্ট্র গড়ে উঠেছে বহু ভাষা-ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষের কঠোর শ্রমের মধ্য দিয়ে, পারস্পরিক সহমর্মিতা, স্বাধীনতা ও পরমতসহিষ্ণুতার কারণে। এমন অবস্থায় ট্রাম্পের বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যবোধের পরিপূরক নয়’, বলেন তিনি।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button