আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় নতুন ধারা ভাঙছে বড় বড় করপোরেশন
হাসান শরীফ
মিডিয়া মোগল খ্যাত নিউজ করপোরেশনের বিলিয়নিয়ার প্রতিষ্ঠাতা রুপার্ট মারডক সম্প্রতি তার তৃতীয় স্ত্রী ওয়েন্ডি ডেংয়ের সাথে বিবাহবিচ্ছেদ চেয়ে আদালতে আবেদন করেছেন।
১৯৯৯ সালে দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার ১৭ দিন পর ওই সময়ে ৬৮ বছর বয়স্ক মারডক বিয়ে করেছিলেন চীনা বংশোদ্ভূত ডেংকে (৩০)। ডেং তখন সদ্য ইয়েল গ্র্যাজুয়েট এবং কয়েক দিন আগে স্টার টিভির ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে বসেছিলেন। এই দম্পতি দুই সন্তানের মা-বাবা। তাদের বিবাহবিচ্ছেদের খবর সম্প্রতি প্রকাশিত হলেও জানা গেছে, ছয় মাস ধরেই তাদের মধ্যে কার্যত ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল।
তিনি কেবল এই একটি বিচ্ছেদই ঘটাতে যাচ্ছেন না, ২৮ জুন তার কোম্পানি দুই ভাগে বিভক্ত হচ্ছে। অবশ্য তার সাবেক প্রতিষ্ঠানের আকর্ষণীয় চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন সম্পদরাজি টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফক্স নামে নতুন একটি গ্র“পে একীভূত থাকছে। অন্য ভাগটির নাম হবে নিউজ করপ। এতে সংবাদপত্র এবং অন্যান্য স্বল্প প্রবৃদ্ধির ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো থাকবে।
এক সময় বিপুল বিস্তৃত যেসব মিডিয়া এখন তাদের ব্যাপ্তি ছোট করে নিয়ে আসছে, তাদের মধ্যে নিউজ করপ একমাত্র উদাহরণ নয়। মার্চে টাইম ওয়ার্নার জানিয়েছে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ তারা তাদের ম্যাগাজিন ইউনিট টাইম ইনককে আলাদা করে ফেলবে। আলোচিত ফরাসি গ্র“প ভিভেন্দির ছিল নানামুখী কার্যক্রম। এখন তারা কেবল বিনোদনে তাদের অবস্থান বিশেষভাবে সুসংহত করতে টেলিকম কোম্পানিগুলো ছেড়ে দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ব্রিটেনের প্রভাবশালী পত্রিকা ইকোনমিস্টের আংশিক মালিক পিয়ারসনও তাদের ব্যবসায় সঙ্কুচিত করতে যাচ্ছে। তারা এখন শিা খাতে বিশেষ নজর দিতে চাচ্ছে।
২০০৯ সালে জোনাথন নি ব্র“স গ্রিনওয়ার্ল্ড ও আভা সিভ তাদের গ্রন্থ কার্স অব দ্য মোগল-এ দেখিয়েছিলেন, একই কোম্পানির হাতে অনেক মিডিয়া থাকলে ক্রমাগতভাবে সেগুলোর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। এর কারণ হিসেবে তারা দেখিয়েছিলেন, এসব প্রতিষ্ঠানের বসেরা মতা ও খ্যাতি পাওয়ার লালসায় এগুলো সংগ্রহ করেছিলেন। এসব লালসা থেকে তারা বিপুল অর্থ ব্যয় করে মিডিয়া হাউজ কেনায় হাত দিয়েছিল।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো চমক দেখাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে সর্বোচ্চ অবস্থায় পৌঁছেছে। গত পাঁচ বছরে নিউজ করপ, ভায়াকম, ডিজনি ও টাইম ওয়ার্নার প্রতিটিই এস অ্যান্ড পি ৫০০-এর গড় মুনাফা ৬.১ শতাংশের দ্বিগুণ দিয়েছে। এই সুদিনের অন্যতম কারণ মিডিয়া মোগলদের আচরণে পরিবর্তন।
১৯৮০-এর দশকের পর বেশির ভাগ ব্যবসায়ই একীভূত হওয়ার বিষয়টি বাদ দেয়। কিন্তু মিডিয়া বসেরা ওই ধারাটি আরো কয়েক দশক অব্যাহত রাখে।
২০০৮ সালের ধসে মিডিয়া কোম্পানিগুলো বিশেষভাবে তিগ্রস্ত হয়। এ সময় দরকার ছিল সুশৃঙ্খল নেতৃত্ব। রুপার্ট মারডকসহ মিডিয়া মোগলেরা এই ধস রুখতে এগিয়ে আসবেন বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু তারা সামান্যই আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। এমন এক অবস্থায় নতুন ধরনের মিডিয়া বসের আগমন ঘটে। পূর্ববর্তীদের তুলনায় তাদের জৌলুশ কম ছিল। তবে তারা মতা বা প্রভাব-প্রতিপত্তির চেয়ে অর্থ বানানোর ধান্ধার দিকেই বেশি জোর দিয়েছিলেন। বিনিয়োগকারীরা তাদের গ্রহণ করে। মিডিয়া জগতের বাইরে খুব কম লোকই টাইম ওয়ার্নারের বস জেফ বেউকেস বা সিবিএস-এর লেস মুনভেসের নাম শুনেছিল। তবে তারা শেয়ারহোল্ডারদের কাছে ছিলেন জনপ্রিয়। তারা দুই হাতে অর্থ ছিটানোর কাজটি করতে অপছন্দ করতেন।
নতুন ধারায় ক্যাবল-টিভি নেটওয়ার্ককে মুনাফাজনক হিসেবে দেখতে পায়। টাইম ইনককে বাদ দেয়ার পর টাইম ওয়ার্নার তার নেটওয়ার্ক (এইচবিওসহ) থেকে ৮০ ভাগ মুনাফা পাবে বলে ধরে নিয়েছে, যা ২০০৮ সালে ছিল ৩২ ভাগ। ২০১২ সালে ভায়াকমের মুনাফার ৯০ ভাগই ছিল নেটওয়ার্কগুলো থেকে। গত কয়েক বছরে সর্বোত্তম মিডিয়া স্টকগুলোর অন্যতম বিবেচিত ডিসকভারি কমিউনিকেশন্স, ডিসকভারি চ্যানেল ও অ্যানিমেল প্লানেটের মতো সম্প্রসারণশীল টেলিভিশন নেটওয়ার্কের দিকে মনোনিবেশন করেছে।
অবশ্য অবয়ব ছোট করাই বর্তমানের একমাত্র পন্থা বিবেচিত হচ্ছে, বিষয়টি তা নয়। বর্তমান সময়েও দু-একটি প্রতিষ্ঠান নতুন নতুন কোম্পানি কিনে তাদের পরিসর বাড়াচ্ছে। এর একটি উদাহরণ হলো এনবিসি ইউনিভার্সাল। এই চলচ্চিত্র ও টিভি প্রতিষ্ঠানটি এখন ডিজনির পর বৃহত্তম মিডিয়া গ্র“প, পুঁজির পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ডিজনিও তাদের পরিধি বাড়াচ্ছে। তারা স্টার ওয়ার্স নির্মাণকারী লুকাসফিল্ম কিনেছে। তারা মুম্বাইয়ের বলিউড-টু-কম্পিউটার-গেমস ব্যবসায় পরিচালনাকারী ইউটিভির নিয়ন্ত্রণও গ্রহণ করেছে।
২০০৫ থেকে যেসব প্রতিষ্ঠান বিভক্ত হয়েছে সেগুলোর কয়েকটি হচ্ছে
মূল প্রতিষ্ঠান বিভক্তির পর সৃষ্ট কোম্পানি
ক্যাবলভিশন ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন (ক্রীড়া ক্ষেত্রে; আইপিও, ২০১০); এএমসি (টিভি; আইপিও, ২০১১)
লিবার্টি গ্লোবাল লিবার্টি ইন্টারঅ্যাকটিভ (অনলাইন মিডিয়া; আইপিও, ২০০৬); লিবার্টি মিডিয়া (আইপিও, ২০১৩); স্ট্যার্জ (টিভি; আইপিও, ২০১৩)
ম্যাকগ্রো-হিল বিজনেস উইক (ম্যাগাজিন; বিক্রি ২০০৯); ম্যাকগ্রো-হিল এডুকেশন (বিক্রি, ২০১২)
নিউজ করপ টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফক্স (চলচ্চিত্র ও টিভি, বিভক্তি, ২০১৩)
পিয়ারসন ইন্টারঅ্যাকটিভ ডাটা (বিক্রি, ২০১০); এফটিএসই (বিক্রি, ২০১১); পেঙ্গুইন বুকস (একীভূত, ২০১২); বিডিএফএম (দণি আফ্রিকান পত্রিকাগুলো, বিক্রি, ২০১৩)
টমসন রয়টার্স এডুকেশন ব্যবসা (বিক্রি, ২০০৭); স্বাস্থ্য পরিচর্যা ইউনিট (বিক্রি, ২০১২)
টাইম ওয়ার্নার বুক গ্র“প (বিক্রি, ২০০৬; আটলান্টা ব্র্যাভস (বেসবল কাব; বিক্রি, ২০০৭); টাইম ওয়ার্নার ক্যাবল (আইপিও, ২০০৭); ওয়ার্নার মিউজিক (বিক্রি, ২০১১); এওএল (অনলাইন মিডিয়া; আইপিও, ২০১৩); টাইম ইনক (ম্যাগাজিনগুলো; আইপিও, ২০১৩)
ভায়াকম সিবিএস (টিভি; বিভক্তি, ২০০৬); আউটডোর (বিজ্ঞাপনী সংস্থা; সিএসবির বিক্রি, ২০১৩) হ
(ইকোনমিস্ট অবলম্বনে)