যেখানে উট ছাড়া ভ্রমণ আজও অকল্পনীয়
অ্যাটলান্টিক মহাসাগরের কোল ঘেঁষে আফ্রিকার সবচেয়ে পশ্চিমের দেশ ‘মরক্কো’। ইউরোপের এত কাছে হলেও কিছুতেই ইউরোপীয় নয় দেশটি।
রাজধানী রাবাত যেখানে ছেয়ে গেছে বিদেশী গাড়িতে, সেখানেই আবার উট ছাডা মরক্কো ভ্রমণ আজও অকল্পনীয়। জেনে নিন প্রাচীন এ দেশটির সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য:
উত্তরে কয়েক কিলোমিটারের জিব্রাল্টার প্রণালী পেরুলেই ইউরোপ আর ঐতিহাসিক কারণে ফ্রান্স ও স্পেনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক এ বাস্তবতাই হয়তো মরক্কোকে দিয়েছে এক অনন্যতা। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মারাক্কেশের পুরনো এই কেল্লার প্রতিটি ইট যেন সে কথাই বলছে।
অর্থনৈতিক প্রগতি ও আধুনিকতার কারণে প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছে মরক্কো একটি মডেল।
অথচ দেশটি কিন্তু আজও চলছে রাজা ষষ্ঠ মোহাম্মদের শাসনে। তবে নিজের ক্ষমতা কমিয়ে দেশে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি বেশ কয়েক বছর হলো।
সমুদ্রের নীল ঢেউয়ে ভাসমান সুউচ্চ মিনারসহ এই মসজিদটি তৈরি করেন রাজা ষষ্ঠ মোহাম্মদের বাবা দ্বিতীয় হাসান। কাসাব্লাঙ্কা শহরের অন্যান্য ইমারতগুলি ধবধবে সাদা হলেও, এই ‘হাসান মস্ক’ কিন্তু লাল বেলেপাথরের তৈরি। এর নকশা তৈরি করেছিলেন ফরাসি স্থপতি মিশেল প্যাঁসো।
‘কাসা ব্লাঙ্কা’ এই নামের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাসাব্লাঙ্কা শহরের বাড়িগুলো যেমন সাদা, তেমনই মারাক্কেশ শহরের বাড়িগুলো লাল রঙের। অনেকটা ভারতের ‘পিঙ্ক সিটি’ জয়পুরের মতো। এ শহরের অলি-গলিতে ছড়িয়ে আছে হাজারো বাজার, হামাম, ফেরিওয়ালা আর নাম না জানা সব শিল্পী।
একে হযরত মুসা বা হযরত হারুনের বোন মারইয়ামের হাত বলুন অথবা ফাতেমার হাত, পাঁচ আঙুল বিশিষ্ট এই হাতটি বাড়ির কোথাও টাঙিয়ে রাখলে কিংবা গয়না হিসেবে গলায় ঝুলিয়ে রাখলে নাকি শয়তানের কুদৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ইহুদিদের মতো মরক্কোর সাধারণ মানুষও বিশ্বাস করে এর শক্তি।
কথাটি ‘জাগলিং’ থেকে এসেছে। মানে যে জায়গায় ভোজবাজি বা ম্যাজিক দেখানো হয়। দেখানো হয় বল, থাকা, বাতি, এমনকি সাপ-খোপ নিয়ে খেলাও। তবে এ সব ছাডাও এখানে নানা ধরনের হাতের কাজ আর সুস্বাদু ‘তাজিন’ তৈরির বাসন-পত্রও পাওয়া যায়।
সন্ধ্যে নামার পর পরই পাল্টে যায় ‘জেমা এল-ফেনা’-র পরিবেশ। চারদিক সেজে ওঠে রং-বেরঙের আলোয়, বসে যায় খাওয়া-দাওয়ার রকমারি ‘স্টল’। আর তারপর শুরু হয় গান-বাজনা। এই আলোর হাট দিয়ে হেঁটে যান একেবারে ‘সহস্য এক আরব্য রজনী’-র সময়ে পৌঁছে যাবেন।
৪৪ বছরের ফরাসি দখলদারিত্বের অবসান ঘটিয়ে ১৯৫৬ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে মরক্কো। অথচ আজও সেখানকার মানুষ ঝরঝর করে ফরাসি বলে, বলে আরবি, আবার কেউ কেউ কথা বলে একেবারে স্থানীয় ভাষায়। শামুক আর গুগলি বিক্রি করতে করতে ঠিক যেমন বলছেন এই দোকানি।
আচ্ছা, বলুন তো বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম কী? হ্যাঁ, মরক্কোর ফেস শহরের আল-কারাউইন ইউনিভার্সিটিই হলো পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়, যার প্রতিষ্ঠা হয় ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে। আর সেই ফেস শহরেই রয়েছে অসামান্য সুন্দর এই রাজপ্রাসাদটি। ফেস শহরের আদি অংশ বা ‘মেদিনা’র অংশ এটি।
ফেসের মেদিনায় একবার ঢুকে পড়লে বের হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। এত অলিগলি, বাজারহাট, উঁচু উঁচু বাড়িঘর, বিরাট বিরাট সিংহদরজা, যে দেখতে দেখতে কখন যে পথ হারিয়ে ফেলবেন, বুঝতেই পারবেন না। তারপরও মেদিনার কাঁচা বাজারটি কিন্তু দেখার মতো
বলা বাহুল্য, মরক্কোর সবচেয়ে প্রাচীন শহরগুলোর মধ্যে ফেস অন্যতম। এর ‘মেদিনা’ ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় পড়ে। এ শহরের কেন্দ্রভাগে শুধুমাত্র গাধা আর ঘোড়ার গাড়ি ঢুকতে পারে। সেভাবেই মাংস-মাছ সব আসে-যায় বাজারে। আসলে রাস্তাগুলো এত ছোট যে, এখানে কোনো গাড়িই চলতে পারে না।
কাঁচা বাজারে শুধু মাছ-মাংস, কিশমিশ, খেজুর, বাদাম, চাল-ডাল আর মশলাই নয়, বিক্রি নয় নানারকম সবজিও। এর বেশিরভাগই আমাদের চেনা। টমেটো, বেগুন, ফুলকপি, রাঙা আলু, এমনকি লঙ্কাও দেখা যায়। তবে তার সঙ্গে আর্টিশকের মতো কিছু ইউরোপীয় সবজিও পাওয়া যায় এখানে।
মরক্কোর অন্যতম খাবার হলো ‘তাজিন’। এটা সাধারণত প্লাম (একরকম ফল) আর মাংস দিয়ে তৈরি হয়। তাজিন দেখতে যেমন চমৎকার, তেমনি ঘ্রাণে ও স্বাদেও অসাধারণ। মরক্কোর মানুষ তাজিন খেয়ে থাকে ডালিয়া অথবা এমন গোল গোল রুটি দিয়ে। এই রুটি তৈরির কাজ অবশ্য যার তার কাজ নয় ।
ফেস থেকে অনেক দূরে, রাজধানী রাবাতের দিকে যেতে পড়ে মেকনেস শহর। তারপরও যদি বেশ কিছুটা পথ না থেকে যাওয়া যায়, তবেই আস্তে আস্তে পালটে যেতে থাকে আশেপাশের ছবি। লোকালয় থেকে দূরে চোখের সামনে ধীরে ধীরে ভেসে ওঠে একটা ধ্বংসাবশেষ।
প্রাচীন রোমান শহর ভোলুবিলিসের ধ্বংসাবশেষ এটি। বলা বাহুল্য, এটিও ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। প্রতি বছর হাজারো দর্শনার্থী এখানে ভিড় করে নিজের চোখে একটিবার রোমান সাম্রাজ্যের এই অসামান্য নিদর্শনটিকে প্রত্যক্ষ করতে। –ডয়েচে ভেলে