বিদায় আড়াই হাজার বছরের হাতে লেখা পাসপোর্ট যুগের
তোফাজ্জল হোসেন কামাল: খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ সালে পারশিয়ার প্রথম রাজা পৃথিবীর সর্বপ্রথম হাতে লেখা পাসপোর্টটি ইস্যু করেছিলেন। এরপর ১৮৬৬ সালে জাপানে, ১৮৯৮ সালে চীনে এবং ১৯০০ সালে রাশিয়ায় ইস্যু করার মাধ্যমে শুরু হয় হাতে লেখা পাসপোর্টের যুগ।
ধাবমান প্রযুক্তির গতির যুগে ‘টরে-টক্কা’র দিন ফুরিয়েছে সেই অতীতে, ডাক হরকরাও আছেন কোনমতে। এবার হাতে লেখা পাসপোর্টের যবনিকা। যন্ত্রে পাঠযোগ্য পাসপোর্ট অধিকার করলো গোটা দুনিয়া।
বিদায়ের এই ২০১৫ সালে প্রায় আড়াই হাজার বছর পর ইতি ঘটলো আদিম যুগের পাসপোর্টের। কেবল বাংলাদেশে নয়, এ বছরের ২৪ নবেম্বর গোটা পৃথিবী থেকে বিদায় ঘটেছে তার। এসেছে মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের (এমআরপি) ডিজিটাল যুগ।
এখন আর মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) ছাড়া কোনো দেশে ভ্রমণ করা যাবে না। সনাতন পাসপোর্টে বিদেশে ভ্রমণের ছাড়পত্র বা ভিসা মিলবে না আর। কোনো বিমানবন্দরে হাতে লেখা পাসপোর্ট গ্রহণ করবে না। বাঙালীর ৫৩ বছরের ইতিহাস জড়িয়ে আছে হাতে লেখা পাসপোর্টের সঙ্গে।
মূলত:ইন্টারন্যাশনাল সিভিল অ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইসিএও) সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পৃথিবীর সকল দেশকে পাসপোর্ট বদলের জন্য ১০ বছর সময় ধার্য করে দেয়া হয়। সেই সময়কাল শেষ হয়েছে গত ২৪ নবেম্বর মঙ্গলবার। আইসিএও ২০০৫ সালে এক সভায় সন্ত্রাসীদের অবাধ বিচরণ ঠেকাতে ও বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এমআরপি বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ঐ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১০ সালের ১ এপ্রিল বহির্গমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর মেশিন রিডেবল বা এমআরপি তৈরি ও বিতরণ শুরু করে। বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের হিসেব অনুযায়ী, এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ১ কোটি ২২ লাখ নাগরিক এমআরপি নিয়েছেন।
পুরনো পাসপোর্টের মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ায় সমস্যার আবর্তে পড়বে প্রবাসী বাংলাদেশীরা। এখনও ১১ লাখের বেশি প্রবাসীকে এমআরপি দেয়া সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী। তিনি জানান, ২০১০ সালে প্রকল্প শুরুর পর প্রায় ৩৫ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশীকে এমআরপি দিতে একই সময়ে বাংলাদেশ দূতাবাস ও মালয়েশিয়ান আউটসোর্সিং কোম্পানি আইআরআইএসের মাধ্যমে বিদেশে কার্যক্রম শুরু হয়। ৯ নবেম্বর পর্যন্ত দূতাবাসগুলোয় ২১ লাখ ১৫ হাজার ৯০১টি এমআরপি ইস্যু হয়েছে। আউটসোর্সিং কোম্পানি ইস্যু করেছে এক লাখ ৯৭ হাজার ২২২টি। এছাড়া মিশনগুলোর প্রায় ৫৪ হাজার ৫৪০টি পাসপোর্ট বহির্গমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরে মুদ্রণের অপেক্ষায় রয়েছে। ফলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে এখনও ১১ লাখ ৩২ হাজার ৩৩৭টি এমআরপি দিতে হবে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ বিদেশে অবস্থানরত সব নাগরিককে এমআরপি দিতে না পারায়, আইসিএও এর কাছে সময় বাড়ানোর আবেদন করবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী।
বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) এন এম জিয়াউল আলম জানান, দেশে বসবাসরত এক থেকে দেড় লাখ নাগরিকের হাতে লেখা পাসপোর্ট বাতিল হয়েছে গত ২৪ নবেম্বর। বাকিরা ইতিমধ্যে এমআরপি প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।
এদিকে হাতে লেখা পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য ২৪ নবেম্বরের আগেই আইসিএও-এর কাছে আবেদন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বেসরকারি বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব জিয়াউল হক। তিনি বলেন, যে কটি দেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক পাঠায় বাংলাদেশ তার অন্যতম। তাই আমরা এই দিকটি বিবেচনায় নিতে তাদের কাছে আবেদন করেছি। পাসপোর্ট অধিদপ্তর বলছে, বিদেশে অবস্থানরত বেশিরভাগ বাংলাদেশী মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট হাতে পেয়েছেন। সময় যেহেতু শেষ তাই দ্রুত বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশী দূতাবাস থেকে এমআরপি পেতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে প্রবাসীদের অনুরোধ করেছে পাসপোর্ট অধিদপ্তর। তবে তাৎক্ষণিকভাবে চাইলে দূতাবাস বা হাই কমিশন থেকে ‘ট্রাভেল পাসপোর্ট’ নিয়ে দেশে ফিরতে পারবেন প্রবাসীরা।
পাসপোর্ট পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে নবেম্বর মাসের শুরু থেকেই রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পাসপোর্ট অধিদফতরে আবেদনকারীদের ভিড় বেড়ে যায়। শেষ মুহূর্তে পাসপোর্ট পরিবর্তন ও গ্রহণের চাপে নির্দিষ্ট সময়ে পাসপোর্ট প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছিল অধিদফতর। ৭ কার্যদিবসের জরুরি পাসপোর্ট ১৫ দিনে এবং ১৫ কার্যদিবসের সাধারণ পাসপোর্ট ৩০ দিনের বেশি সময়ে পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে অনেকের।
এদিকে গত ২৫ নবেম্বর আইকাও-এর কাছে বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্য হাতে লেখা পাসপোর্টের মেয়াদ ২০১৮ সালের ২৪ নবেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর যে আবেদন করা হয়েছিল সেই আবেদন নাকচ করেছে আইকাও।
এ বিষয়ে পাসপোর্ট অধিদফতরের মহাপরিচালক এন এম জিয়াউল আলম বলেন, বিদেশে অবস্থানরত বেশিরভাগ বাংলাদেশী মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট হাতে পেয়েছেন। সময় যেহেতু শেষ তাই বাকিদের দ্রুত বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশী দূতাবাস থেকে এমআরপি পেতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে প্রবাসীদের ইতোমধ্যে অনুরোধ করেছে পাসপোর্ট অধিদফতর। তবে তাৎক্ষণিকভাবে প্রবাসীরা দূতাবাস বা হাইকমিশন থেকে ‘ট্রাভেল পাসপোর্ট’ নিয়ে দেশে ফিরতে পারবেন প্রবাসীরা।
অকার্যকর দুই লাখ পাসপোর্ট
হাতে লেখা প্রায় দুই লাখ পাসপোর্ট নবেম্বর থেকে অকার্যকর হয়েছে। ফলে এ পাসপোর্টে বিশ্বের কোনো দেশেই ভ্রমণ করা যাবে না। ২৪ নবেম্বর থেকে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) ছাড়া দেশের বাইরে যাওয়া কিংবা প্রবেশ করা যাচ্ছে না। অথচ সক্ষমতা ঘাটতি আর ব্যবহারকারীর অনাগ্রহে বিপুল সংখ্যক পাসপোর্ট এমআরপি করা যাচ্ছে না।
বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিনই হাজার হাজার এমআরপি প্রদানের কাজ করা হচ্ছে। এরপরেও ২৪ নবেম্বরের পর বাংলাদেশে বসবাসরত প্রায় দু’লাখ হাতে লেখার পাসপোর্টধারীরা এ পরিবর্তন সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন।
অধিদফতর সূত্রে থেকে জানা গেছে, দেশের ৬৪ পাসপোর্ট অফিসে এমআরপি কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এর মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার পাসপোর্টের আবেদন জমা পড়ে। দেশের বাইরে ৪২টি অফিসে প্রতিদিনই প্রায় দুই হাজারের মতো বিদেশী ও অনাবাসী বাংলাদেশী পাসপোর্ট পেতে আবেদন করেন। সব মিলিয়ে বছরে ২৫ লাখ বাংলাদেশী ও ৫ লাখ প্রবাসীকে এমআরপি ইস্যু করা হচ্ছে। তবে এরপরেও দুলাখ পাসপোর্টধারী বাদ পড়েছেন। ২০১০ সালের এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত মোট এক কোটি ২২ লাখ এমআরপি প্রদান করেছেন বলে সুত্রটি জানায়।
আইকাও’র নির্দেশনা অনুযায়ী ২৪ নবেম্বরের পর শুধু বিমানবন্দরগুলো নয়, হাতে লেখা পাসপোর্টে দূতাবাসগুলো ভিসার সিল কিংবা স্টিকার লাগাতে পারবে না।