আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ২০১৫সালের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা

Year end২০১৫ সালকে জাতিসংঘের ৬৮তম সাধারণ অধিবেশনে আন্তর্জাতিক আলো ও মৃত্তিকা বছর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। বিশ্ব সংস্থা ঘোষিত ‘আলো’ ও ‘মৃক্তিকা’র এই বছরটি এখন শেষ প্রান্তে। মহাকালের পথে ব্যয়িত বছরটির আশা-নিরাশায় ভরা আন্তর্জাতিক ঘটনাগুলোর মধ্যে আলোচিত কিছু ঘটনা তুলে ধরা হলো—
আইএস: বছর জুড়েই আলোচনায় ছিল সিরিয়া ও ইরাকভিত্তিক ইসলামিক স্টেট (আইএস)। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় গোষ্ঠীটির মদদে সংঘটিত বিভিন্ন হামলার ঘটনাও গোষ্ঠীটিকে আলোচনার কেন্দ্রে রেখেছিল।
ইউরোপের শরণার্থী সংকট: বছর জুড়ে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ এবং লিবিয়া ও অন্যান্য দেশের অস্থিতিশীলতার ঢেউ ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপে গিয়েও পৌঁছেছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের বিভীষিকা থেকে ও অন্যান্য অঞ্চলের সহিংসতা থেকে বাঁচতে লাখ লাখ বেপরোয়া শরণার্থী বিপদসংকুল সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপে গিয়ে হাজির হয়। ভালো চাকরি ও উন্নত জীবনমানের আশায় অন্যান্য দেশ থেকে আসা শরণার্থীরাও এদের সঙ্গে যুক্ত হন। সারাবছর ধরে চলা শরণার্থীর স্রোত বছরের শেষদিকে ১০ লাখের কোটা অতিক্রম করে।
ইরানের পরমাণু চুক্তি: প্রায় দু’বছর ধরে আলোচনার পর চলতি বছরের পূর্ব নির্ধারিত সময়ে (৩০ জুনের মধ্যে) ব্যর্থ হলেও জুলাইয়ে পি৫+১ দেশ হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি এবং ইরানের মধ্যে বহুল আলোচিত পরমাণু চুক্তি সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী, আগামী অন্ততপক্ষে দশ বছরের জন্য ইরান তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কাজ কমিয়ে আনবে। বিনিময়ে ধীরে ধীরে দেশটির উপর থেকে পরমাণু সংশ্লিষ্ট সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা, আটকে থাকা দেশটির তেল বাণিজ্যের শত শত কোটি ডলার ছাড় ও নিষেধাজ্ঞার কারণে জব্দ হয়ে থাকা অন্যান্য সম্পদ মুক্ত করার কথা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা কূটনৈতিক সম্পর্ক: চলতি বছরের ২০ জুলাই দুই দেশে থাকা পরস্পরের কূটনৈতিক মিশনগুলোকে পূর্ণ দূতাবাসের মর্যাদা দিয়ে ৫৪ বছর পর যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবা নিজেদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। ১৯৫৯ সালে ফিদেল ক্যাস্ত্রোর নেতৃত্বে কিউবার বিপ্লব হওয়ার পর দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নাজুক হয়ে পড়ে। ১৯৬১ সালে কিউবার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে যুক্তরাষ্ট্র।
মিয়ানমারের নির্বাচন: মিয়ানমারের নির্বাচনে অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) জয়ী হয়েছে। দেশটিতে কয়েক দশকের সেনাশাসন শেষে ২৫ বছরের মধ্যে এই নির্বাচনকেই সবচে’ গণতান্ত্রিক বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। কঠোর নির্বাচনী নিয়মে দেশটির এই ঐতিহাসিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
প্রথমবারের মতো ভোট দিলেন সৌদি নারীরা: চলতি বছরের ডিসেম্বরে সৌদি আরবে পৌর নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন দেশটির নারীরা। এই প্রথম সৌদি নারীরা কোনো নির্বাচনে ভোট দিলেন। ভোট দেয়া ছাড়াও এই প্রথম সৌদি আরবে নারী প্রার্থীরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছেন। যদিও কঠোর শরিয়া আইনে পরিচালিত দেশটিতে নারীদের গাড়ি চালনার অধিকার নেই; কিন্তু এরপরও এই নির্বাচনে ৫,৯৩৮ জন পুরুষের পাশাপাশি ৯৭৮ জন নারীও বিভিন্ন পদে প্রার্থী হয়েছেন।
কানাডার নির্বাচন: কানাডার পার্লামেন্ট নির্বাচনে জাস্টিন ক্রদোর নেতৃত্বাধীন লিবারেল পার্টি জয়লাভ করেছে। পার্লামেন্টে তৃতীয় অবস্থানে থেকে প্রচারণা শুরু করে দলটি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায়। এর মধ্যদিয়ে দেশটিতে কনজারভেটিভদের প্রায় এক দশকের শাসনের অবসান হয়।
আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন: আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন রক্ষণশীল প্রার্থী মৌরিশিও মাক্রি। তিনি প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দেশটির ক্ষমতাসীন বামপন্থি দলের প্রার্থী ড্যানিয়েল স্কিওলিকে পরাজিত করেন। আর্জেন্টিনার অন্যতম ধনী ব্যক্তির সন্তান মাক্রির রাজনীতিতে আসার আগে ব্যবসায় দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
নেপালে প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প: চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল শনিবার ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্পে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় হিমালয় কন্যা নেপাল। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপের (ইউএসজিএস) তথ্য অনুযায়ী নেপালের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর পোখারা থেকে ৫০ মাইল পূর্বে ভূপৃষ্ঠের মাত্র ২ কিলোমিটার গভীরে ছিল এই ভূমিকম্পের কেন্দ্র। ভূমিকম্পে নেপালে ৮ হাজার ৮৫৭ জন, প্রতিবেশী ভারতে ১৩০ জন, চীনে ২৭ জন এবং বাংলাদেশে ৪ জনসহ মোট ৯ হাজার ১৮ জনের মৃত্যু হয়।
হজে ভয়াবহ পদদলন, ক্রেন দুর্ঘটনা: চলতি বছরের হজ মওসুম শুরুর পর ১২ সেপ্টেম্বর মক্কার মসজিদ আল হারামের সম্প্রসারণ কাজে থাকা একটি ক্রেন ঝড়ে উল্টে পড়লে ১১৭ জনের মৃত্যু হয়। এরপর ২৪ সেপ্টেম্বর শুক্রবার মিনা থেকে জামারায় ‘শয়তানের স্তম্ভে’ পাথর ছুঁড়তে যাওয়ার পথে পদদলনের ঘটনায় সৌদি আরবের সরকারি হিসাব অনুযায়ী ৭৭৯ জন নিহত হন ও অন্ততপক্ষে ৮৬৩ জন আহত হন। সৌদি সরকারের ঐ ভাষ্য সত্ত্বেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে জানানো হয়, এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা অন্ততপক্ষে ২ হাজার ২০০ জন, আহত ৯০০ জনেরও বেশি এবং নিখোঁজ ৬৫০ জন।
চীনের জাহাজডুবি: জুনে চীনের ইয়াংজি নদীতে টর্নেডোর আঘাতে একটি যাত্রীবাহী জাহাজ ডুবে প্রায় সাড়ে চারশ’ মানুষের মৃত্যু হয়। জাহাজের যাত্রীদের অধিকাংশই ছিলেন পর্যটক। তারা ১১ দিনের এক প্রমোদ ভ্রমণে পূর্বাঞ্চলীয় জিয়াংসু প্রদেশের নানজিং থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর চোংকিংয়ে যাচ্ছিলেন। ক্যাপ্টেনসহ জাহাজটির মাত্র ১৪ জন আরোহীকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়। ৭০ বছরে চীনের ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে বিপর্যয়কর জাহাজডুবির ঘটনা।
জার্মানির বিমান দুর্ঘটনা: চলতি বছরের ২৪ মার্চ স্পেনের বার্সেলোনা থেকে জার্মানির ডুসেলডর্ফ যাওয়ার পথে ফ্রান্সের আল্পস পর্বতমালায় জার্মানির রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা লুফথানসার মালিকানাধীন সাশ্রয়ী বিমান পরিবহন নেটওয়ার্ক জার্মান উয়িংসের একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়। এতে বিমানের ১৫০ জন আরোহীর সবাই নিহত হন।
ইন্দোনেশিয়ায় সামরিক বিমান বিধ্বস্ত: চলতি বছরের ৩০ জুন ইন্দোনেশিয়ায় সুমাত্রায় একটি আবাসিক এলাকায় সামরিক পরিবহন বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ১৪১ জনের মৃত্যু হয়। বিমানটিতে মোট ১২২ জন আরোহী ছিল, যাদের সবাই মারা গেছে। বিমানটি আবাসিক এলাকার উপর বিধ্বস্ত হওয়ায় বাকিরা নিহত হয়।
জলবায়ু চুক্তি: জুলাইয়ে বৈশ্বিক তাপমাত্রা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে প্যারিস সম্মেলনে সই হওয়া চুক্তিটিকে সর্বসম্মতিতে করা একটি ঐতিহাসিক চুক্তি হিসেবে দেখছেন বিশ্বনেতারা। চুক্তিটি আগামী কয়েক দশকের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি-নির্ভর বিশ্ব অর্থনীতিকে রূপান্তরিত করে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি রুখে দেবে বলেও ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। ফ্রান্সের রাজধানীতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে (২১তম কনফারেন্স অব পার্টিজ বা কপ২১) প্রায় দু’শ’ দেশের প্রতিনিধিরা দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে একটি চুক্তিতে পৌঁছতে আলোচনা করেন। অবশেষে সব দেশের সম্মতিক্রমে প্রথমবারের মতো কার্বন নিঃসরণ কমানোর ক্ষেত্রে একটি চুক্তিতে পৌঁছানো সম্ভব হয়।
কানাডায় স্বেচ্ছামৃত্যুতে বৈধতা: চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কানাডার সুপ্রিম কোর্ট স্বেচ্ছা বৈধ বলে আদেশ জারি করে। ঐ আদেশ অনুযায়ী দেশটিতে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা এখন থেকে চাইলে চিকিত্সকের সাহায্য নিয়ে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করতে পারবেন। ইউরোপের কয়েকটি দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি রাজ্যে স্বেচ্ছামৃত্যু বৈধ।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button