পৃথিবী কাঁপিয়ে হাইড্রোজেন বোমা ফাটাল উত্তর কোরিয়া
বিশ্ব জনমতকে থোড়াই কেয়ার করে, মূলত আমেরিকাকে লক্ষ্য করেই ফের ক্ষমতার আস্ফালন দেখাল উত্তর কোরিয়া। ভুগর্ভে ফাটাল হাইড্রোজেন বোমা। যার জেরে তৈরি হলো ভূমিকম্পও। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫.১।
ইউএস জিওলজিক্যাল সাভের্র বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, বুধবার নতুন এই ভূ-কম্পন পুঙ্গি-রি পারমাণবিক চুল্লি থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে এবং ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে অনুভূত হয়।
পরীক্ষামূলকভাবে বুধবার সকালে হাইড্রোজেন পরমাণু ডিভাইসের (হাইড্রোজেন বোমা) এই সফল পরীক্ষাটি চালানো হয়।
বিবিসি বলছে, ২০০৬ সাল থেকে উত্তর কোরিয়া ভূগর্ভে তিন দফা পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়। এসব পরীক্ষার সবগুলোই পুংগাই-রি নামের একটি স্থাপনায় চালানো হয়।
উত্তর কোরিয়ার প্রতিবেশী দেশ চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াও ভূকম্পন শনাক্তের কথা জানিয়ে এটি যে মানব-সৃষ্ট, এমন ইঙ্গিত পাওয়া কথা জানিয়েছিল। এতে উত্তর কোরিয়া নতুন একটি পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছিল।
ভূকম্পন শনাক্ত হওয়ার পর দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম অল্প সময়ের মধ্যেই ‘বিশেষ, তাৎপর্যপূর্ণ’ ঘোষণা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছিল।
প্রতিবেশীদের সেই ধারণাকে সত্যি প্রমাণ করে উত্তর কোরিয়া হাইড্রোজেন বোমার একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ পরীক্ষার ঘোষণা দিল।
এর আগেও তিনবার ভূগর্ভে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল পিয়ংইয়ং। ২০০৬, ২০০৯ আর ২০১৩ সালে। আগের চালানো পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির কারণে দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র।
তবে হাইড্রোজেন বোমা আর পরমাণু বোমা এক জিনিস নয়। হাইড্রোজেন বোমা অনেক বেশি শক্তিশালী। এক যুগ আগে পোখরানে ভারতও ভূগর্ভে পরীক্ষামূলকভাবে হাইড্রোজেন বোমা ফাটিয়েছিল বলে অভিযোগ।
তবে তার জেরে ভূকম্পন হয়নি। কিন্তু নিরাপত্তার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় এ দিন উত্তর কোরিয়ায় হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরণের পরপরই ভূমিকম্প হয়।
উত্তর কোরিয়ার এ দিনের দাবি যদি পুরোপুরি সত্যি হয়, তবে পারমাণবিক শক্তির অস্ত্র-ভাঁড়ারের নিরিখে দেশটি কার্যত চূড়ান্ত পর্যায়েই পৌঁছে গেল, বলা যায়।
কূটনৈতিক সূত্রের মতে, পরীক্ষামূলকভাবে হাইড্রোজেন বোমা ফাটনোর নির্দেশটা দিয়েছিলেন খোদ উত্তর কোরিয়ার একনায়কতন্ত্রী নেতা, প্রেসিডেন্ট কিম জং-উন।
গত ৩ জানুয়ারি তিনি ওই নির্দেশে সই করেন। আর দু’দিন পরেই প্রেসিডেন্ট কিম জং-উনের জন্মদিন। তার আগে এমন পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হওয়ায় তিনি খুশি বলে সে দেশের সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে।
তাদের হাতে হাইড্রোজেন বোমা আছে আর তা যে কোনো সময় তারা ফাটাতে পারে বলে গত নভেম্বরের শেষে হুমকি দিয়েছিলেন উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট।
উত্তর কোরিয়ার সংবাদমাধ্যম আরো জানিয়েছে, সাম্প্রতিক পরীক্ষা সম্পূর্ণ ভাবেই সে দেশের প্রযুক্তি-নিভর্র। ওই প্রকল্পে শুধুই উত্তর কোরিয়ার বিজ্ঞানীরা কাজ করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রশাসনিক কর্তা বলেছেন, আমেরিকার জন্যই আমাদের আত্মরক্ষার প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে।
ও দিকে, এই খবর প্রকাশ্যে আসার পরেই আন্তর্জাতিক মহলে শোরগোল পড়ে যায়। উত্তর কোরিয়ার দাবি সত্যি কি না, তা খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
পরমাণু বোমায় পরমাণুর বিয়োজন ঘটানো হয়। আর হাইড্রোজেন বোমায় দু’টি হাইড্রোজেন পরমাণুকে জুড়ে দেওয়া হয়। আর ঘটানো হয় ‘চেন রিঅ্যাকশন’।
এই প্রক্রিয়ায় প্রচুর তাপশক্তি উৎপন্ন হয়। যার পরিমাণ, সাধারণ পরমাণু বোমার চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি।
আমেরিকা এখনো এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। যে সব তথ্য তাদের হাতে পৌঁছেছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সত্যি ওটা হাইড্রোজেন বোমা কি না তা জানতে কয়েক দিন সময় লাগবে।
এদিকে, দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ইয়োনহ্যাপ জানিয়েছে, উত্তর কোরিয়ার পরমাণু পরীক্ষার খবরে দক্ষিণ কোরিয়ার মন্ত্রীরা জরুরি বৈঠক করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, পুংগাই-রি থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে নতুন ভূমিকম্পন শনাক্ত হয়। এটির উৎপত্তিস্থল ছিল মাটির ১০ কিলোমিটার গভীরে।
জাপানের মন্ত্রিসভা সচিব ইয়োশিহিদে সুগা বলেন, আগের ঘটনাগুলো বিবেচনা করে বলা যায়, এটি উত্তর কোরিয়ার একটি পরমাণু পরীক্ষা হতে পারে।
হাইড্রোজেন বোমা এটম বোমা থেকেও বহুগুন শক্তিশালী ও ধ্বংসাত্মক। এটম বোমা নামে পরিচিত ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম নিউক্লিয়াস বোমায় ফিশন প্রক্রিয়ায় বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। কিন্তু হাইড্রোজেন বোমা বা থার্মোনিউক্লিয়ার বোমায় ভারী হাইড্রোজেনের আইসোটোপ ব্যবহার করা হয় এবং এতে ফিউশন প্রক্রিয়ায় বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
এই ফিউশন প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য ট্রিগার হিসেবে একটি ফিশন বোমা বা এটম বোমা ব্যবহার করা হয়। সূর্যে যে প্রক্রিয়ায় শক্তি উৎপন্ন হচ্ছে ঠিক সেই একই প্রক্রিয়ায় হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরণেও অনুসরণ করা হয়।