দুর্ভিক্ষে ধুঁকছে সিরিয়াবাসী ‘ভরসা কেবল পশুর খাদ্য’
বিশ্ব সভ্যতার চরম উন্নতি ও অগ্রগতির যুগেও পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষ পশুর মতই ঘাস, লতাপাতা , এমনকি পোষা কুকুর ও বিড়ালের মাংস খেয়ে বেঁচে আছে! হ্যাঁ এ ধরনের ঘটনা অবিশ্বাস্য মনে হলেও তা ঘটছে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে। যেখানে অনাহারে, অর্ধাহারে থেকে নিরুপায় হয়ে কেবল জীবন রক্ষায় মানুষ বেছে নিয়েছে পশুর খাদ্য। সেই দুর্ভিক্ষ কবলিত দেশ সিরিয়ার একটি কঙ্কালসার কিশোরের কণ্ঠ থেকে ভেসে আসলো এমনই আর্তি ‘কত দিন মানুষ না খেয়ে থাকতে পারে বলুন? আমি সাত দিন ধরে কিছুই খাইনি। আল্লাহর কসম ‘আমি খুবই ক্ষুধার্ত।’ তুমি এখন কী চাও এমন প্রশ্নের জবাবে সে বলছে, ‘আমাদের খাবার আনার অনুমতি দেওয়া হোক।’এদিকে সাত মাসের ক্রন্দনরত এক শিশুকে তার স্বজন বলছে, ‘ঠিক হয়ে যাবে সোনা। আল্লাহ সাহায্য করবেন, তিনি তাড়াতাড়ি এর সমাধান দেবেন।’ ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে খাবার খেতে দেখা গেল অভুক্ত এক সিরীয় যুবককে। এ ধরনের বেশকিছু ভিডিও এবং অনাহারক্লিষ্ট অসংখ্য মানুষের হৃদয়বিদারক স্থিরচিত্র এখন হাহাকার তুলছে অনলাইন দুনিয়ায়। সিরিয়ার আলেপ্পো প্রশাসনিক অঞ্চলের মাদায়া, ফারিয়া ও ফোয়া শহরে চলছে এই মরণদশা। শহর তিনটির মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪৫ লাখ। খাবারের অভাবে শহরগুলোর বাসিন্দারা এখন ঘাস, লতাপাতা এবং এমনকি পোষা কুকুর, বিড়ালের মাংস খেয়ে বেঁচে আছে। অনেক ভিডিওতে অনেককে ঘাসের স্যুপ খেতেও দেখা যায়। শহরগুলোর বাসিন্দারা বলছে, খাবারের অভাব নেই, উচ্চমূল্য এবং খাবার সংগ্রহ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণেই এমন খাদ্যাভাব চলছে। বিভিন্ন গণমাধ্যম জানাচ্ছে, শহরগুলোতে এখন এক কেজি চালের দাম পৌনে আট হাজার টাকা। এ ছাড়া এক কেজি চিনির দাম সাড়ে ১৫ হাজার টাকা। এক লিটার দুধের দাম সাড়ে ২৩ হাজার টাকা।শহর তিনটির মধ্যে সবচেয়ে করুণ অবস্থা চলছে মাদায়ায়। সিরিয়ান বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত এ শহরটিকে গত জুলাই থেকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে সিরিয়া সরকারি বাহিনী ও তাদের মিত্র লেবাননভিত্তিক হিজবুল্লাহ গ্রুপ। ফলে শহরটির মানুষ খাবার সংগ্রহ করতে পারছে না। কেউ খাবার সংগ্রহে বের হলে তাকে হয় গুলী খেয়ে মরতে হচ্ছে, নয়তো স্থলমাইনে আক্রান্ত হচ্ছে। জাতিসংঘের হিসাব মতে, এখন পর্যন্ত একজন মারা গেছে অনাহারের কারণে। তবে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম বলছে, এ পর্যন্ত কেবল মাদায়া শহরেই ৪০ থেকে ৬০ জনের মতো মানুষ মারা গেছে। তবে আশার বাণী হলো, সিরিয়া সরকার শহরগুলোতে খাবার পাঠাতে জাতিসংঘের আহ্বানে রাজি হয়েছে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি এবং আন্তর্জাতিক রেডক্রস তাদের মানবিক সাহায্য দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। অবরুদ্ধ মাদায়া শহরের পরিস্থিতি খুবই করুণ বলে খবর দিয়েছে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো। বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে, এর অনেক বাসিন্দা অভুক্ত অবস্থায় রয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন না খেয়ে মারা গেছে। তবে অবরুদ্ধ থাকার কারণে নিরপেক্ষ সূত্রে মৃত্যুর সংখ্যা যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না। দামেস্ক থেকে ২৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে এবং লেবানন সীমান্তের মাত্র ১১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মাদায়া শহর। মাদায়ার একজন বাসিন্দার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বিবিসিকে তিনি জানান, খেতে না পেরে তাদের দুজন মানুষ গত বৃহস্পতিবার মারা গেছে। আব্দেল ওয়াহাব আহমেদ নামের ওই বাসিন্দা আরো জানান, সরকারি বাহিনী ও হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা ওই শহরটিতে অবরোধ আরোপের পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৬০ জন মানুষ মারা গেছে। তবে মাদায়ায় প্রকৃতপক্ষে কত মানুষ অনাহারে মারা গেছে সে বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য জানা যাচ্ছে না। ফ্রান্সভিত্তিক সাহায্য সংস্থা মেদাসাঁ সঁ ফ্যাঁতিয়ে বলছে, শুধু ডিসেম্বর মাসে তাদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবা নিতে আসা অভুক্ত মানুষের মধ্যে ২৩ জন মারা গেছে।ওয়াহাব বলেন, ‘এখানকার লোকজন এখন মাটি-ঘাস-গাছের পাতা খাচ্ছে, কারণ খাবার কিছুই নেই। শীতের কারণে পরিস্থিতিও ভয়াবহ আকার নিয়েছে। ঘাস-পাতাও শুকিয়ে যাচ্ছে। সেভ দ্য চিলড্রেন জানাচ্ছে, মাদায়ায় যদি জরুরি ভিত্তিতে খাবার, চিকিৎসা সামগ্রী, জ্বালানিসহ জরুরি সামগ্রী পৌঁছানো না যায়, তাহলে আরো শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটবে সামনে। শহরটির হাসপাতালের অবস্থাও শোচনীয়। ওয়াহাব বলেন, ‘হাসপাতালে এখন দেড় শ’র বেশি মানুষ অচেতন অবস্থায় আছে। অবরোধ আরোপের পর থেকে শহরটিতে জ্বালানি ও চিকিৎসা সরঞ্জামের সরবরাহ কমে গেছে। কোনো ওষুধ নেই এখন, কোনো বেডও খালি নেই এমনকি অ্যাম্বুলেন্সও নেই। এক দিনের জন্য যেন অবরোধ তুলে নেওয়া হয়, আমরা এটিই চাই।’ দুর্দশাগ্রস্ত দুই শহর ফারিয়া ও ফোয়া বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে যায় এক বছরেরও বেশি সময় আগে। তবে গত সেপ্টেম্বর থেকে শহর দুটির বাসিন্দাদের অবস্থার অবনতি ঘটতে শুরু করে, বিশেষ করে যখন বিদ্রোহীরা একটি বিমানঘাঁটি দখল করে এবং হেলিকপ্টারযোগে সরকারি বাহিনীর প্রতি হামলা চালাতে থাকে। তখন থেকেই শহর দুটির প্রায় তিন হাজার মানুষ খাদ্য, শাক-সবজি বা রুটি সংগ্রহ করতে পারছে না। দুটি শহর থেকে পালিয়ে আসা সরকারপন্থী কিছু যোদ্ধা বলেন, কিছু বাসিন্দা স্রফে ঘাস খেয়ে জীবন ধারণ করে আছে। হাসপাতালগুলোতে অনেককে জরুরি অস্ত্রোপচার করতে হলে তা অজ্ঞান করার ওষুধ (অ্যানেসথেশিয়া) ছাড়াই করা হচ্ছে।সরকারপন্থী আহত যোদ্ধা ১৬ বছর বয়সী হুসেইন মাহদি বলেন, ‘ফোয়া ও ফারিয়ায় আমাদের জীবনে এখন করুণ দশা চলছে।’ হিজবুল্লাহ পরিচালিত রাসুল আল-আজম হাসপাতালে বর্তমানে তার চিকিৎসা চলছে। আর পাহাড়বেষ্টিত মাদায়া শহরটি বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার পর গত জুলাই থেকে সরকারি বাহিনী ও হিজবুল্লাহ গ্রুপ অবরুদ্ধ করে রাখে। খাদ্যাভাবের পাশাপাশি তীব্র শৈতপ্রবাহে নিদারুণ কষ্টে ভুগছে মানুষগুলো। মোহসেন দারবিশ নামের এক শিয়া ধর্মীয় নেতা বললেন, ফারিয়ায় মানুষের স্বপ্ন এখন একটাই, আর তা হলো এক গ্রাস সবজি খেতে পারা।এদিকে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডাব্লিউএফপি) জানিয়েছে, তারা ফারিয়া ও ফোয়া শহরে খাদ্য সহায়তা পৌঁছানের জন্য সিরিয়া সরকারের অনুমতি পেয়েছে। তবে মাদায়া শহরের প্রবেশের অনুমতি এখনো পাওয়া যায়নি। তারা আশা করছে, অনুমতি পাওয়া গেলেও আগামী সোমবারের মধ্যেই তারা তিনটি শহরে ট্রাকে করে সহায়তা পৌঁছাতে পারবে। ডাব্লিউএফপির মুখপাত্র গ্রেগ বেরো গত বৃহস্পতিবার জানান, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তারা মাদায়ায় খাদ্য সহায়তা পৌঁছাতে পারবেন বলে আশা করছেন।