ভিসাপ্রক্রিয়া ঢাকা থেকে সরিয়ে নেয়ায় বিপাকে বাংলাদেশিরা
ব্রিটেন ও কানাডা হাইকমিশনের ভিসাপ্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ ঢাকা থেকে সরিয়ে নেয়ায় বিপাকে পড়েছেন অনেক বাংলাদেশি। দিল্লি ও সিঙ্গাপুর থেকে ভিসা প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করায় এক দিকে সময় লাগছে বেশি, অন্য দিকে সাক্ষাৎকারের সুযোগ না থাকায় জরুরি প্রয়োজনের কথা হাইকমিশনগুলোকে বোঝানো যাচ্ছে না।
ভিসা প্রক্রিয়ার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ঢাকায় ফিরিয়ে আনার জন্য দুই দেশের সরকারকে বারবার তাগাদা দিচ্ছে বাংলাদেশ।
এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ব্রিটেনের ভিসার জন্য এখন সাধারণ আবেদনকারীদের তিন সপ্তাহ সময় প্রয়োজন হয়। সরকারি কর্মকর্তা বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য দরকার হয় অন্তত এক সপ্তাহ। আগে সরকারি পাসপোর্টধারীরা দু-এক দিনের মধ্যেই ব্রিটিশ ভিসা পেতেন।
তিনি বলেন, ব্রিটেনে প্রায় ছয় লাখ বাংলাদেশি রয়েছেন। তাদের আত্মীয়-স্বজন ব্রিটেনে যাওয়া-আসা করতে সমস্যার মধ্যে পড়েছেন। এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা বা বিভিন্ন সেমিনারে যোগ দেয়ার প্রয়োজনতো রয়েছেই।
কর্মকর্তাটি জানান, ব্রিটেন খরচ কমিয়ে আনার জন্য ভিসা প্রক্রিয়া দিল্লি থেকে নিয়ন্ত্রণের কথা বললেও এর পেছনে রয়েছে তদবির থেকে রক্ষা পাওয়া ও অনিয়ম সামাল দেয়া। এ ছাড়া নির্বাচন ইস্যুতে বর্তমান সরকারের সাথে সৃষ্ট দূরত্বও একটা কারণ হতে পারে। ব্রিটেনের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এখন কাঙ্খিতপর্যায়ে নেই। ব্রিটেনের নতুন হাইকমিশনার হিসেবে অ্যালিসন ব্লেক দায়িত্ব নেয়ার পর পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির গণমাধ্যমকে বলেন, ব্রিটেন ও কানাডার ভিসাপ্রার্থীদের অভিযোগ রয়েছে, সাক্ষাৎকারের সুযোগ না থাকায় তারা প্রকৃত প্রয়োজনীয়তার কথা হাইকমিশনের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারছেন না। ঢাকায় সাক্ষাৎকার নেয়ার ব্যবস্থা থাকলে তারা কনস্যুলার অফিসারকে বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে পারতেন। এখন মূলত কাগজ-পত্র বা দলিলাদির ভিত্তিতে ব্রিটেন ও কানাডার ভিসা দেয়া হয়। অনেক মানুষের ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো শুধু কাগজ দিয়ে উপলব্ধি করার সুযোগ সীমিত। সে জন্যই সারা বিশ্বে ভিসা দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা রাখা হয়।
তিনি বলেন, ভিসাপ্রক্রিয়া দিল্লি ও সিঙ্গাপুরে চলে যাওয়ায় ব্রিটেন ও কানাডা হাইকমিশনে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার প্রায় অনুপস্থিত বলা চলে। যে সব বাংলাদেশি বিশেষ করে চিকিৎসার জন্য এসব দেশে যান তাদের এবং প্রবীণ মানুষদের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বিষয়টিকে মানবিক দিক থেকে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
হুমায়ুন কবির আরও বলেন, ব্রিটেন ও কানাডার সাথে বাংলাদেশের শতবর্ষের সম্পর্ক রয়েছে। ব্রিটেনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছেন। তাদের আত্মীয়-স্বজন সেখানে যাতায়াত করেন। বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য দেশ দুটি আকর্ষণীয় গন্তব্য। অনেকে বেড়ানোর জন্যও যান। কাজেই দীর্ঘ সম্পর্কের আলোকে বাংলাদেশীদের জন্য ভিসাপ্রক্রিয়া পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। শুধু আর্থিক সাশ্রয়ের বিষয়ে আটকে না থেকে দুই দেশের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিশেষ করে মানুষের মধ্যে যোগাযোগের বিষয়টা মাথায় রেখে তাই আগের মতই ভিসা সেকশনটি পূর্ণাঙ্গভাবে ঢাকায় ফিরিয়ে আনা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
ঢাকায় দায়িত্ব নেয়ার পর গত ২০ জানুয়ারি তার প্রথম সংবাদ সম্মেলনে ব্রিটেনের ভিসাপ্রক্রিয়া ঢাকা থেকে দিল্লিতে সরিয়ে নেয়ার ফলে ভিসাপ্রার্থীদের উদ্বেগের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে অ্যালিসন ব্লেক বলেন, ব্রিটেনে ভিসাপ্রার্থীদের যাতে একই মানের সেবা দেয়া যায় সে জন্যই এ অঞ্চলে প্রক্রিয়াটি দিল্লি থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। আধুনিকায়নের সাথে দিন দিন অনেক কাজই অনলাইনে হচ্ছে। আমরা দেখেছি একটি আঞ্চলিক কেন্দ্র তৈরি করে ভিসা অফিসার নিয়োগ দেয়া হলে যাচাই প্রক্রিয়াটি অনেক দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করা যায়। ব্রিটিশ ভিসার জন্য নিয়মকানুন সব দেশের জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য। বাংলাদেশকে এ ক্ষেত্রে পৃথক করা হয়নি।
বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ ভিসা প্রত্যাখ্যানের হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে এমন অভিযোগ সম্পর্কে হাইকমিশনার বলেন, ভিসার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও তথ্য-প্রমাণের যথার্থতার ব্যাপারে ব্রিটেন বেশ কঠোরতা অনুসরণ করে। ভিসা আবেদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে যে সমস্যাটার কথা শোনা যায় তা হলো হয় তারা আবেদনের নিয়ম-কানুন সঠিকভাবে বুঝতে পারে না অথবা জাল কাগজপত্র দিয়ে থাকে। ভিসা আবেদনের নিয়মকানুন সঠিকভাবে বুঝতে পারাটা গুরুত্বপূর্ণ এবং জাল কাগজপত্র দিয়ে ভিসা নেয়ার চেষ্টা থেকে অবশ্যই বিরত থাকা উচিত।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অপর একজন কর্মকর্তা জানান, কানাডার ভিসাপ্রক্রিয়া সিঙ্গাপুর থেকে নিয়ন্ত্রণের অন্যতম কারণ হলো জাল কাগজপত্র দিয়ে আবেদন করা। এখন সরকারি (অফিসিয়াল) পাসপোর্ট, এমনকি কূটনৈতিক পাসপোর্টও জাল করে মানব পাচারের ঘটনা ঘটছে। ফলে যেসব দেশ বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের অন-অ্যারাইভাল ভিসা দিত, তারাও তা পুনর্বিবেচনার চিন্তা-ভাবনা করছে। তাই বিদেশ যাওয়ার পথটা বাংলাদেশীদের জন্য উন্মুক্ত রাখতে এসব জালিয়াতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে, না হলে কিছু খারাপ মানুষের কাজের ফল সবাইকে ভোগ করতে হবে।