সেকালের পত্রিকা ‘ইসলাম দর্শন’
হোসেন মাহমুদ: ঊনিশ শতকের সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে বাঙালি মুসলিম সমাজে সাময়িকপত্র প্রকাশের ধারা সূচিত হয়। বিশ শতকে এসে এ ধারাটি আরো বেগবান রূপ লাভ করে এবং সাময়িকপত্র-পত্রিকার সংখ্যাও যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। উল্লেখ করা দরকার যে এসব পত্র-পত্রিকার কারণে সমাজ-শিক্ষা-অর্থনীতি-রাজনীতিতে পিছিয়ে থাকা বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতার সৃষ্টি হয়। তারা উপমহাদেশের অগ্রসরমান জনসমাজ তথা হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশে নিজেদের শামিল করার তাগিদ অনুভব করে যা পরিণতিতে বাঙালি মুসলমানকে সার্বিকভাবে অনেকটাই এগিয়ে দেয়। বিশিষ্ট গবেষক ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম তার ‘সাময়িকপত্রে জীবন ও জনমত’ গ্রন্থে ১৮৭৪ থেকে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৫৬ বছর সময়কালে বাঙালি মুসলমান কর্তৃক মোট ১৫৩টি সাময়িকপত্র প্রকাশিত হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। এসবের অধিকাংশই ছিল স্বল্পায়ু বা কিছুকাল স্থায়ী। এর প্রধান কারণ ছিল সেকালের মুসলিম সমাজের আর্থিক দৈন্য। যারা প্রবল উৎসাহ নিয়ে সাময়িকপত্র প্রকাশ করতেন কিছুদিনের মধ্যেই তারা আর্থিক সঙ্কটের বাস্তবতার সম্মুখীন হয়ে পত্রিকা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হতেন। স্ব-সমাজের কাছ থেকে তেমন সাড়া না পাওয়ায় অর্থাৎ পর্যাপ্ত গ্রাহক সৃষ্টি না হওয়ার কারণে পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার অনেক ঘটনা জানা যায়। যাই হোক, প্রতিকূল পরিবেশের সে দিনগুলোতেও একের পর এক পত্র-পত্রিকা প্রকাশে এগিয়ে আসার মধ্যে সেকালের উদ্যোক্তাদের অদম্য ইচ্ছাশক্তির পরিচয় মেলে।
এ পটভূমিতেই বৈশাখ ১৩২৭, এপ্রিল ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ লাভ করে ‘ইসলাম দর্শন’ পত্রিকা। ‘জাতীয় মাসিকপত্র’ হিসেবে কলকাতা থেকে প্রকাশিত এ পত্রিকা ছিল ‘আঞ্জমনে ওয়ায়েজীনে বাংলা’র মুখপত্র। এর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ফুরফুরা শরীফের পীর হযরত মাওলানা আবুবকর সাহেব। প্রধানত ধর্ম ও সমাজবিষয়ক পত্রিকা হলেও ‘সাহিত্য ক্ষেত্রে মোসলমানের বিশুদ্ধ জাতীয় আদর্শটি পরিস্ফুট’ করে তোলাও ছিল এর অন্যতম ব্রত। এ প্রসঙ্গে পত্রিকার প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যার ‘অবতরণিকা’ (সম্পাদকীয়) থেকে কিছুটা অংশ উদ্ধৃত করা যেতে পারে:
“উন্নতিশীল বাংলাভাষা ধর্ম্মগত, জাতিগত ও সম্প্রদায়গত বিদ্বেষ-বিষে জর্জ্জরিত ও কণ্টকিত হইয়া উঠিয়াছে। ইহার ফলে বঙ্গভাষা ও সাহিত্য যেমন উদার ও উন্নত ভাব এবং উচ্চ আদর্শে ভূষিত হইতে পারিতেছে না, উক্ত ভাষাভাষী ও এদেশবাসী হিন্দু-মোসলমানগণও সেইরূপ পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন হইয়া জাতীয় জীবন ও জাতীয় সাহিত্যের উন্নতি সাধন করিতে পারিতেছেন না। …বিশেষত হিন্দু সাহিত্য সারথিগণ ইসলামের যে আদর্শ এবং মোসলমান জাতির যে চিত্র বঙ্গ সাহিত্য ভা-ারে আকিয়া রাখিয়াছেন তাহাতে হিন্দু-মোসলমানের মিলন ও প্রকৃত পরিচয়ের পথে সহস্র যোজনের ব্যবধান রচিত হইয়া রহিয়াছে। নিরপেক্ষ ও সুনিপুণ আলোচনা দ্বারা উপরোক্ত মহা অনর্থের নিদান নির্ণয় ও মূল উৎপাটন করাও ইসলাম দর্শন প্রচারের অন্যতম উদ্দেশ্য।…
অধুনা চারদিকে কপট মিলনের বিজয়ডঙ্কা খুব উচ্চরোলে নিনাদিত হইতে থাকিলেও এ যুগ বিষম প্রতিযোগিতার যুগ। প্রবল প্রতিযোগিতার মুখে টিকিয়া থাকিতে না পারিলে এ যুগে ধর্ম্ম, সমাজ, সাহিত্য ও জাতীয়তা প্রভৃতি কিছুরই অস্তিত্ব থাকিবে না। সেই জন্য যদিও মানবজাতির কল্যাণের জন্য ইসলামকে বহু বিষয়ে ত্যাগ স্বীকার করিতে হইবে যদিও বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর সহিত সম্মিলনের জন্য মোসলমানকে অন্তরের সহিত যত্ন করিতে হইবে, তথাপি তাহার নিজের ধর্ম্ম, নিজের সমাজ ও নিজের আদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব ও গৌরবগুলি খুব দৃঢ়তার সহিত প্রদর্শন করিতে হইবে; তাহার নিজের জ্ঞানের আলোটিকে সবচেয়ে বড় করিয়া জ্বালাইতে হইবে। তবেই তাহার উদ্দেশ্য সফল হইবে। ইসলাম দর্শন এই মহান ব্রত অবলম্বন করিয়াই সমাজে আত্মপ্রকাশ করিতেছে।…”
‘ইসলাম দর্শন’ পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন প্রখ্যাত কবি ও লেখক মোহাম্মদ আবদুল হাকিম। পত্রিকার সম্পাদকীয় কার্যালয় ছিল ১৩৯, মেছুয়া বাজার স্ট্রিট, কলিকাতা। ছাপা হত মোহাম্মদী প্রেস, ১৬০ বেলিয়াঘাটা মেইন রোড, কলিকাতা থেকে। ৪৮ পৃষ্ঠা পত্রিকার মূল্য ছিল চার আনা। সুধী পাঠকদের কৌতূহল মেটাতে এখানে ‘ইসলাম দর্শন’ পত্রিকার প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যার লেখক ও লেখাসমূহের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া হলো:
‘ইসলাম দর্শন’ প্রথমবর্ষ প্রথম সংখ্যার প্রথম রচনা হিসেবে গদ্যে ‘হামদ্ ও নাত’ ছাপা হয়েছে। দ্বিতীয় রচনা হিসেবে আছে মোহাম্মদ আবদুল হাকিমের কবিতা ‘প্রার্থনা।’ তৃতীয় রচনা হিসেবে ছাপা হয়েছে ‘অবতরণিকা’ বা সম্পাদকীয়। চতুর্থ রচনা হলো ‘মুসলমান জাতির অতীত শিক্ষা ও সাহিত্যানুরাগ।’ লেখক মীর আবদুল গণি ফরিদপুরী। এ লেখার নিচে পাদটীকায় বলা হয়েছে ‘প্রবন্ধটি ফরিদপুর মুসলমান সাহিত্য সভার বার্ষিক অধিবেশনের জন্য লিখিত হইয়াছিল। কিন্তু তখন লেখকের অসুস্থতা নিবন্ধন পঠিত হয় নাই।’ পঞ্চম রচনা মোহাম্মদ আবদুল হাকিমের ‘ইসলামের নীতি ও শিক্ষা’ শীর্ষক প্রবন্ধ। লেখক এখানে তওহিদ বা একত্ববাদ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। ষষ্ঠ রচনা হিসেবে মুদ্রিত হয়েছে শ্রী প্রফুল্ল কুমার মজুমদার, ফরিদপুরের রচিত কবিতা ‘ইসলাম’। সপ্তম রচনা আলতাফ হোসেন বিএ-এর প্রবন্ধ ‘ফরিদপুরের ঐতিহাসিক সম্পদ’। অষ্টম রচনা হলো মোজাম্মেল হক, শান্তিপুরের কবিতা ‘নৈকট্যানুভূতি’। নবম রচনা ‘ইসলামের উত্থান ও পতন’। লেখক সৈয়দ আবদুল কুদ্দুস রুমী। লেখক এ প্রবন্ধে মুসলমান জাতির ঘোর অধঃপতনের কথা বর্ণনা করেছেন। দশম রচনা হিসেবে ছাপা হয়েছে ‘জনৈক সম্ভ্রান্ত মহিলা’র ‘গোলাপ ও বুলবুল’ নামক কবিতা। এটি মোগল শাহ্জাদী ও কবি জেবুননেসার এটি কবিতার অংশবিশেষ অবলম্বনে রচিত। এগারোতম রচনা মোহাম্মদ ইসহাক বিএ রচিত কবিতা ‘নায়াতে রসুল’। এ, লোহানী রচিত ‘বাঙ্গালার ইতিহাসের কয়েক পৃষ্ঠাÑশোভা সিংহ ও রহিম খাঁ’ বারোতম রচনা হিসেবে ছাপা হয়েছে। তেরোতম রচনা হিসেবে রয়েছে হবিবর রহমান ফরিদপুরী’র ‘সমাজের কথা’। এ নিবন্ধে লেখক ‘ইসলাম দর্শন’র কাছে বাঙালি মুসলমান সমাজের প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করেছেন। চৌদ্দতম রচনাটি হলো মোহাম্মদ আবদুল হামিদ কাব্যবিনোদের কবিতা ‘ইসলাম দর্শন’। এতে লেখক আহ্বান জানিয়েছেন:
“কে কোথায় আছ মোসলেম তনয়
এসো সবে ছুটি আজি এ সময়
‘ইসলাম দর্শন’ করিয়া গ্রহণ
জাগাও জাতীয় জীবন তান
নব তেজে ভরি সমাজ-প্রাণ।”
শমসের আলি খাঁর কবিতা ‘আবেদন’ ও এএফএম আবদুল মজিদের কবিতা ‘প্রিয়-সংবর্ধনা’ যথাক্রমে পনেরো ও ষোলোতম রচনা হিসেবে ছাপা হয়েছে। সতেরোতম রচনা মোহাম্মদ আবদুল মজিদের গল্প ‘নাস্তিক’। গল্পের শেষে খোদার ওপর অবিশ্বাসের পরাজয় ও বিশ্বাসের জয় দেখানো হয়েছে। আঠারোতম রচনা হলো ‘শরীয়ত সঙ্কলন : খেলাফত প্রসঙ্গ’। নিবন্ধটি আসলে খেলাফত আন্দোলন সম্পর্কে শাহ্ সুফী মোহাম্মদ আবুবকর সাহেবের অভিমত। ঊনিশতম রচনা হিসেবে ছাপা হয়েছে মোহাম্মদ রুহোল আমিনের ‘এলমে তাসাউফ এবং আসল ও নকল পীর।’ আবদুল ওদুদ বিএ-এর ‘সুন্নত ও বেদআত’ কুড়িতম রচনা। একুশতম রচনাটি হলো ‘চয়নিকা।’ এ বিভাগে প্রথম নিবন্ধে ‘তুর্ক সাম্রাজ্যে শিক্ষা বিস্তার ’ প্রসঙ্গে ‘প্রবাসী’, বৈশাখ ১৩২৭ সংখ্যায় প্রকাশিত অভিমত, ‘ধর্ম্ম বিষয়ে প্রতিবেশীগণের সহিত আমাদের সম্বোন্ধ’ প্রসঙ্গে ‘বঙ্গনূর’ পত্রিকায় ফাল্গুন, ১৩২৬ সংখ্যায় মুদ্রিত অনা: নওয়াব সৈয়দ নওয়াব আলি চৌধুরীর অভিমত এবং ‘নূতন যুগের নূতন কথাÑ আমাদের কথা ’ শিরোনামে ‘আঙুর’ , বৈশাখ ১৩২৭ সংখ্যায় সম্পাদক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ এমএ বিএলের সম্পাদকীয় ভাষ্যের নির্বাচিত অংশ উদ্ধৃত করা হয়েছে। বাইশতম রচনাটি হলো ‘সাময়িক সাহিত্য’ বিভাগ। এত ‘প্রবাসী’ বৈশাখ ১৩২৭, ‘ইসলামিক রিভিউ’, ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’, ‘বঙ্গনূর’, ‘নূর’, ‘ভাস্কর’ ও ‘আঙুর’ পত্রিকার আলোচনা-সমালোচনা করা হয়েছে। ‘সাহিত্য সন্দেশ’ হলো পত্রিকার প্রথম সংখ্যার তেইশতম ও শেষ রচনা। এ বিভাগে মৌলবী আবদুল হাকিম রচিত ‘প্রতিদান’ ও মৌলবী এ, লোহানী রচিত ‘শপথ’ নামক উপন্যাস দুটি প্রকাশের এবং মৌলবী ফজলুর রহিম চৌধুরী এমএ রচিত ‘সোহরাব রোস্তম’ নামে একটি উপন্যাস শীঘ্রই প্রকাশিত হবে বলে খবর দেয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে ‘ইসলাম দর্শন’র আগে মাঘ ১৩২২, ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে কলকাতা থেকে মাসিক পত্র হিসেবে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। তখন এর সম্পাদক ছিলেন শেখ আবদুর রহিম। সেসময় এটি উন্নতমানের পত্রিকা হিসেবে সুনাম অর্জন করলেও বেশিদিন চলতে পারেনি। ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম জানিয়েছেন, পত্রিকাটি ছিল স্বল্পায়ু। ‘আঞ্জমনে ওয়ায়েজীনে বাঙ্গালা’র মুখপত্র রূপে ফুরফুরা শরীফের পীর সাহেবের পৃষ্ঠপোষকতায় বৈশাখ ১৩২৭, এপ্রিল ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে পুনঃপ্রকাশের পর ষষ্ঠবর্ষেও পত্রিকাটি চালু ছিল।
সেকালে মুসলমান লেখকের সংখ্যা বেশি ছিল না। তাদের মধ্যে যারা খ্যাতি অর্জন করেছিলেন সে লেখকদের সবাই যে এ পত্রিকায় লিখেছেন, তাও নয়। মূলত, নবীন-প্রবীণ সবার লেখাই এতে প্রকাশিত হতো। লেখকদের মধ্যে ছিলেন : কায়কোবাদ, শেখ মোহাম্মদ ইদরিস আলি, মোহাম্মদ আবদুল হাকিম, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, শেখ ফজলল করিম, মোহাম্মদ মোজফ্ফরুদ্দীন, হাসিনা খাতুন, দেওয়ান শামসুদ্দিন আহমদ নীতপুরী, মোহাম্মদ আবদুল হামিদ কাব্যবিনোদ, কাজী কাদের নওয়াজ, এ লোহানী প্রমুখ। সেকালের মুসলিম সমাজে পত্রিকাটি জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। তারপর আর পাঁচটি সাময়িকপত্রের মতো একপর্যায়ে ‘ইসলাম দর্শন’র প্রকাশনাও চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।
তথ্যসূত্র : ১. সাময়িকপত্রে জীবন ও জনমত : ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, বাংলা একাডেমি, ১৯৮৩; ২. ‘ইসলাম দর্শন’, প্রথমবর্ষ প্রথম সংখা, বৈশাখ ১৩২৭; ৩. ঐ চতুর্থবর্ষ প্রথম সংখ্যা, শ্রাবণ ১৩৩১; ৪. ঐ দ্বিতীয় সংখ্যা, ভাদ্র ১৩৩১ ও সপ্তম সংখ্যা, মাঘ ১৩৩১।