মুসলিম ভূখণ্ড হাতছাড়া হওয়ার ইতিহাস
ড. মুহাম্মদ সিদ্দিক: একসময় আরব, তুর্কি, মুঘল মুসলমানেরা পূর্ব গোলার্ধের অনেক এলাকা দখল করে সভ্যতার বীজ বপন করলেও অষ্টাদশ শতকের পরে বিশেষ করে তুর্কি ও মুঘলদের দুর্বলতার সুযোগে ইউরোপীয়দের হাতে নাস্তানাবুদ হলো। মুসলমানরা যেখানে গেছেন, তারা সে এলাকাকে সভ্য ও উন্নত করেছে। ইউরোপ করেছে ঠিক বিপরীত। তাদের মুখ্য মতলব ছিল উপনিবেশ তৈরি। উপনিবেশবাদীরা তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মকে পর্যন্ত উপনিবেশে প্রতিষ্ঠা করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। অন্যত্র শতভাগ সফল হলেও, মুসলিম এলাকায় তারা প্রচণ্ড হোঁচট খায়। অধ্যাপক উইলিয়াম মন্টগোমারি ওয়ার্টের মতে, ইউরোপ মুসিলম বিশ্বে তাদের দেয়া শিক্ষার সিলেবাস কার্যকর করে বশংবদ সামরিক বেসামরিক আমলা ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর সৃষ্টি করে। যারা নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মকে এড়িয়ে গিয়ে এমনকি তাদের নব্য প্রভুদের প্রায় সব কিছু গ্রহণ করে। ভারতের প্রখ্যাত গবেষক ড. রফিক জাকারিয়া তার প্রখ্যাত ‘দি স্ট্রাগল উইদিন ইসলাম’ নামক গ্রন্থে মন্তব্য করেন যে, এভাবে সেকুলার ও তথাকথিত মৌলবাদী যে দুই শ্রেণীর মুসলমান সৃষ্টি হয় সে উভয় গোষ্ঠীকে পাশ্চাত্য পরিস্থিতি বুঝে ব্যবহার করে। আমরা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ পাই ব্রিটিশ ইন্ডিয়া ও আফগানিস্তানের ইতিহাসে। আসলে পাশ্চাত্য সেকুলার ও তথাকথিত মৌলবাদী মুসলমান কোনো গোষ্ঠীরই বন্ধু নয়, তারা নিজেদেরই বন্ধু। এই খেলাটা ব্রিটিশরাই সর্বপ্রথম শুরু করে ব্যবসার আড়ালে। তার পরে পাশ্চাত্যের অন্যান্য খ্রিষ্টান জাতি। ১৭৫৭ ছিল পাশ্চাত্যের খ্রিষ্টান ব্যবসায়ীদের বিশ্বাসঘাতকতার বছর। ব্যবসায়ী হয়ে যায় শাসক। ১৮৪৯ সালের মধ্যে ব্রিটিশরা হিন্দুস্তানের প্রায় সব এলাকা দখল করে বার্মা-শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত এগিয়ে যায়। এরপর নেয় মালয় উপদ্বীপ (যা মুসলিমপ্রধান)।
ব্রিটেন আরো দখলে নেয় আফ্রিকার শেষ দক্ষিণ প্রান্তের কেপ অব ওডহোপ। তবে সর্বপ্রথমে এটি পর্তুগালের দখলে ছিল, যখন পর্তুগিজ দিয়াজ এটি আবিষ্কার করেন ১৪৮৬ সালে। ১২০ বছর পর এটি নেয় ডাচরা, যারা ২০০ বছর ধরে রাখে। ১৮০৬ সালে ব্রিটেন এটা দখলে নেয়।
ব্রিটিশ দখলে যাওয়ার পর সেখানকার ডাচ কৃষকেরা (যাদের বুয়ার বলা হতো) উত্তরে সরে গিয়ে দুটো কলোনি বানায় ট্রান্সভাল ও অরেঞ্জ ফ্রি স্টেট। তবে ১৮৭০ সালে মেসিল রোডস নামক এক ইংরেজ দক্ষিণ আফ্রিকা এলাকায় এসে ধীরে ধীরে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে রোডেশিয়া নামে একটি কলোনি বানায়। ১৯০২ সালের বুয়ার যুদ্ধে ইংরেজরা জিতে ট্রান্সভালড অরেঞ্জ ফ্রি স্টেট কলোনি জিতে নতুন বড় কলোনি ইউনিয়ন অব সাউথ আফ্রিকা বানায়।
১৭৯৮ সালে মিসর দখল করেছিল ফ্রান্সের নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, কিছু সময়ের জন্য। পরে ফ্রান্স সুয়েজখাল খুঁড়ে মিসরকে লাভবান না করে দেউলিয়া বানায়। ব্রিটিশরা মিসরের শাসক ইসমাইল পাশার শেয়ার কিনে মিসরে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিকভাবে ঢুকে পড়ে। ব্রিটিশরা অর্থনৈতিক সাহায্যের আড়ালে পরে সামরিক বাহিনী নামিয়ে ১৭৫৭-এর বাংলা বিহার উড়িষ্যার মতো মিসরকে ১৮৮২ সালে দখলই করে নেয়।
১৮৭৫ সালের পরে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের পরে সেখানকার ধনিক ব্যবসায়ী শ্রেণী সস্তায় কাঁচামাল সংগ্রহ ও তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়ের জন্য এবার দূরের অপেক্ষাকৃত দেশগুলো সরকারি সহযোগিতায় দখল করার প্রতিযোগিতায় নামে। এর সাথে যুক্ত হয় খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচারকেরা।
আফ্রিকার পিঠা ভাগ : ১৮৬৬ সালে ড. লিডিংস্টোন ও পরে হেনরি এস স্টানলি আফ্রিকার ভেতরে ঢুকে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারে নামেন। এর পরে সুযোগ নেন বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড। ১৮৭৬ সালে তিনি রাজধানী ব্রাসেলসে ‘দি ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দি এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড সিভিলাইজেশন অব আফ্রিকা’ সম্মেলন ডাকেন। তিনি আফ্রিকায় খ্রিষ্টধর্ম প্রচারক গোয়েন্দা হেনরি এস স্টানলিকে কাজে লাগালেন। বেলজীয় ব্যবসাদারও এতে থাকে। ১৮৭৯ সালে গোয়েন্দা স্টানলিকে কঙ্গোয় পাঠিয়ে রাজা কঙ্গোর বিশাল এলাকা নিজের বলে দাবি করেন।
ফরাসিরা দেখে যে, বেলজিয়াম কঙ্গোর সব নিয়ে নিচ্ছে। তখন ফ্রান্স ও বেলজিয়ামে কাড়াকাড়ি লেগে যায় পিঠার ভাগ নিতে। ১৮৮৫ সালে বার্নিলে সম্মেলন হয়। রাজা লিওপোল্ড পেলেন আপার কঙ্গো, ফ্রান্স সমুদ্রের ধারের কিছু অংশ পায়। রাজার ব্যক্তিগত সম্পত্তি হলো কঙ্গো। এলাকাটা সম্পূর্ণ জার্মানি, ফ্রান্স, হল্যান্ড ও বেলজিয়ামের সমান। এরপর চলে রাজার ব্যক্তিগত শোষণ। রাজা সৈন্য পাঠিয়ে চালান গণহত্যা। অবশেষে ১৯০৮ সালে এলাকাটি রাজার ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে বেলজিয়াম সরকারের কর্তৃত্বে চলে যায়।
এ দিকে মিসরের দক্ষিণে সুদানে ইসলাম ধর্মীয় আন্দোলন শুরু হলে হানাদার ব্রিটিশ জেনারেল গর্ডন নিহত হন ১৮৮৪ সালে। তবে ১৮৯৮ সালে জেনারেল কিচনারের অধীনে ব্রিটিশ বাহিনী মিসরীয় বাহিনীর সাথে মিলে মাহদিকে হত্যা করে।
ব্রিটিশদের ক্ষুধা তাতেও শেষ হয় না। পর্যটক ও খ্রিষ্টধর্ম প্রচারকদের মাধ্যমে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে নাইজেরিয়া, গোল্ডকোস্ট, সিয়েরালিওন, গাম্বিয়া, উগান্ডা, কেনিয়া ও সোমালিল্যান্ডের এক অংশ দখলে নেয়।
অন্য দিকে, পিঠা ভাগাভাগির টুকরো ফ্রান্সকেও দিতে হয়। ফ্রান্স পায় কঙ্গোর এক অংশ, ডেহোমি, আইভরি কোস্ট, গিনির এক অংশ, সেনেগাল, সোমালিল্যান্ডের এক অংশ, সাহারা মরুভূমির বেশির ভাগ অংশ ও মাদাগাসকার। এমনকি ফরাসি হানাদারেরা তিউনিসিয়াও দখল করে নেয়।
ইটালিও পিঠার অংশ হিসেবে পায় ইরিনিয়া ও সোমালিল্যান্ডের একটি অংশ। জার্মানি কেন বসে থাকবে। তারও চায় পিঠার ভাগ। সে সাধুবেশী খ্রিষ্টধর্ম প্রচারক ও পর্যটক পাঠিয়ে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে দক্ষিণ আফ্রিকার কিছু অংশ ক্যামেরুনস, টোগো ও পূর্ব আফ্রিকার অংশবিশেষ পায়। তবে স্থানগুলো অর্থনীতি বিবেচনায় তেমন মূল্যবান নয়।
খ্রিষ্ট ইউরোপ ১৯০২-১৯০৪ সময়ে নিজেদের কামড়াকামড়ি কমাতে অনেক চুক্তি করে যাতে সহজে ভূখণ্ড ভাগাভাগি করে নেয়া যায়। চুক্তি হয় ফ্রান্স মরক্কো পাবে, ইতালি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবে, তবে এর বদলে ইটালি ট্রিপলি নিতে পারবে। এদিকে স্পেন নাখোশ হয় পিঠার ভাগ নিয়ে। তাই মরক্কোর একটা টুকরো তাকে দেয়া হয় মুখ বন্ধ করতে। চুক্তি হয় : ব্রিটেন মিসরে যা খুশি করবে, ফ্রান্স মরক্কোতেও তাই করতে পারবে। এটি আরেক গোপন সাইকস-পিকো চুক্তির মতো। ফ্রান্স পেয়ে গেল মরক্কো ১৯১১ তে। ইটালি মনে করল, এখন তার যে ট্রিপলি পাওয়ার কথা সে এলাকাটা তখন তুরস্কের। হানাদার বাহিনী পাঠিয়ে পোপের দেশ ইতালি ত্রিপলি (আধুনিক নাম লিবিয়া) দখল করে।
১৯১১-সালের পর লন্ডনে এক তথাকথিত শান্তিচুক্তিতে তুর্কির অধীন আলবেনিয়াকে নতুন রাষ্ট্র করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পাশ্চাত্য আরবদের স্বাধীনতা দেয়ার কথা বলে তাদের ব্যবহার করে তুর্কিদের হত্যা করে আরব মুলুকে। ব্রিটিশ গোয়েন্দা অফিসার লরেন্স আরব পোশাক পরে ধ্বংসাত্মক কাজ করে। ফিলিস্তিনি আরবদের সাহায্যে ব্রিটিশ জেনারেল এডমান্ড এলেনবি জেরুসালেমসহ ফিলিস্তিন দখল করে। ফিলিস্তিনিরা স্বাধীনতা পায়নি। ব্রিটিশ ও ইহুদিদের গোপন বেলফোর চুক্তিতে ফিলিস্তিন চলে গেল ইহুদিদের হাতে। উচিত শিক্ষা পায় আরবেরা।
তুরস্ক টুকরো হলো : তুরস্কে যখন সেকুলার ও ধর্মমুখীদের অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছে তখন ইতালি তুরস্কের অন্তর্ভুক্ত ত্রিপলি দখল করে নেয়। তারপর ইউরোপের দখলি ছাড়া খ্রিষ্টান শক্তিগুলো বলকান লিগ গঠন করে তুরস্কের বলকান এলাকাকে বিচ্ছিন্ন করতে। এর মধ্যে প্রথম যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় (১৯১৪-১৮)। তুরস্ক পরিস্থিতির কারণে জার্মানির সাথে থাকায়, যুদ্ধ শেষে জার্মানির পরাজয়ে, ব্রিটেন-ফ্রান্স ও তাদের মিত্রদের কাছে বিশাল এলাকা হারায়।
প্যারিস পিস কনফারেন্স : শান্তির নামে পিঠা ভাগের সম্মেলন হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ীদের। অন্যান্য বিষয়ের সাথে সিদ্ধান্ত হলো এজিয়ান সাগরের সমগ্র উত্তর উপকূলসহ কনসটান্টিনোপল পর্যন্ত তুরস্কের কাছে থেকে গ্রিসের অন্তর্ভুক্ত হবে। তুর্কি বাহিনীর নেতৃত্বে সমগ্র বিশ্বের মুসলমান সামরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে স্ট্যালিপলি থেকে কনসটান্টিনোপল রক্ষা করেছিল পরবর্তীকালে।
এই তথাকথিত শান্তি সম্মেলনে পাশ্চাত্য ইরাক, ফিলিস্তিন, ট্রান্সজর্ডান, সিরিয়া ও লেবাননকে তুরস্ক থেকে কেটে নেয়া হলো। তবে ওয়াদা মতো স্বাধীনতা না দিয়ে এ দেশগুলোকে ব্রিটেন ও ফ্রান্স ভাগ করে নিলো ম্যানডেটের নামে পিকো সাইকস গোপন চুক্তির আড়ালে।
হল্যান্ড : ১৫৯০-এর দশকের দিকে ডাচ গোল্ডকোস্টের নাম পাওয়া যায়।
শ্রীলঙ্কা দখলে নিতে ব্রিটিশদের কাছে ব্যর্থ হয়ে হল্যান্ড ১৮৪০ সালে ইন্দোনেশিয়ার এলাকা দখল করে। এর ভেতর ছিল মালাক্কা সুমাত্রা, জাভা, বোর্নিও, সেলিবিস ও অন্যান্য দ্বীপ। ১৬১৯ সালে জাভার বাটাভিয়াতে (জার্কাতায়) কুঠি প্রতিষ্ঠা করে ডাচ ইস্ট ইন্ডিজের রাজধানী করে। ১৬৩৮ তারা মরিসাস দখল করে। ১৮৭১ ডাচ গোল্ড কোস্ট বিক্রয় হয় ব্রিটেনের কাছে। দেশ কেনাবেচা দেশের বাইরে!
রাশিয়া : ১৭২২ পিটার দি গ্রেট পারস্যের সাফাভিড রাজ্য থেকে ককেসাস ও কাস্পিয়ান সাগরের নিকটস্থ স্থান দখলে নেয়। এসপ্রেস এনার ওসমানি সুলতানের অধীনস্থ ক্রিমিয়ার খানেট রাজ্য দখলে নেয়। কাথেরিন দি গ্রেট (১৭৬২-১৭৯৬) ওসমানি সুলতানকে পরাজিত করে ব্ল্যাক সি পর্যন্ত সীমানা বাড়ায়। ১৮০২ সালে পারস্য থেকে জর্জিয়া আলাদা করে রাশিয়া ওসমানি সাম্রাজ্য থেকে সলভোভিয়া নেয় ১৮১২ সালে। ১৮০২ সালে পারস্য থেকে মুসলিম দাগেস্তান দখল করে। আজারবাইজানের কিছু অংশও নেয় রাশিয়া। আর্মেনিয়াও চলে যায় রুশ দখলে। সেই সাথে ইগডির। রাশিয়া গ্রিকদের উসকানি ও সাহায্য দেয় তুর্কির বিরুদ্ধে। খ্রিষ্টধর্মীয় দায়িত্বে রাশিয়া তুরস্ক থেকে বুলগেরিয়া ও সার্বিয়াকে আলাদা করে। রুশ স্বেচ্ছাসেবক (সন্ত্রাসী নয় কেন?) খ্রিষ্টবাহিনী সেখানে প্রবেশ করে। রুশ খ্রিষ্টানরা রোমানিয়া ও মন্টিনেগ্রোকেও বিচ্ছিন্ন করে তুর্কি থেকে।
১৮৭৭-৭৮ সালে রুশ-তুর্কি যুদ্ধে জিতে রাশিয়া তুর্কি এলাকার বাটুমি, আরদাহান ও দক্ষিণ ককেশাসের কারস এলাকায় খ্রিষ্টানদের বসতি স্থাপন করে মুসলমান বিতাড়ন করে।
এশিয়ার কিরগিস তৃণভূমি: ১৯ শতকের শেষেই রাশিয়া পৃথিবীর ছয় ভাগের এক ভাগ নিয়ে নেয়, যার বিশাল অংশ মুসলমানদের ছিল। সমগ্র এলাকার রুশভাষী জনগণ ছিল শতকরা পঁয়তাল্লিশ ভাগ। প্রায় একশো জাতিসত্তাকে রাশিয়া দাবিয়ে রাখে। আরো গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হলো মধ্য এশিয়ায় কাজখস্তান, কিরগিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও উজবেকিস্তান, উসমানি তুর্কি থেকে নেয়া আরদাহান, আর্টভিন, ইগডির, কারস ও এরজুরুমের উত্তর-পূর্ব এলাকাগুলো।
১৮১২ সালে তুরস্কের অধীনস্থ মলদোভিয়া নেয় রাশিয়া। তুরস্ক থেকে বেসারাবিয়াও যায় রাশিয়ার ঘরে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তুরস্কের অধীনস্থ আর্মেনিয়ার অংশও নেয় রাশিয়া।
১৮৮৯ রাশিয়া উত্তর আফ্রিকার জিবুতির কাছে সাগাল্লোতে কলোনি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা নেয়। তবে ফরাসি বাধায় তা ব্যর্থ হয়। সব সাম্রাজ্যবাদী চায় লোহিত সাগরের কাছে ঘাঁটি। আমুর নদীর উত্তরে সব মুসলিম অঞ্চল রাশিয়া দখল করে এক এক করে। প্রতিবেশীই বড় শত্রু প্রমাণিত হয় তুরস্কের।
রাশিয়া ১৮৭৫ সালে বলকানের সার্বিয়া, মন্টিনেগ্রো ও বুলগেরিয়াকে উসকালো তুরস্ক থেকে আলাদা হয়ে যেতে। ১৮৭৮ সালের সান স্টেফানোর অপমানজনক চুক্তি সই করতে বাধ্য হলো তুরস্ক রাশিয়ার সাথে। তুরস্কের সেই পূর্ববর্তী সামরিক শক্তি তখন ছিল না। সার্বিয়া, মন্টিনেগ্রো ও রুমানিয়া বিচ্ছিন্ন হলো। বুলগেরিয়া আরো এলাকা পেয়ে প্রায় বিচ্ছিন্ন হলো। আর রাশিয়া পিঠার ভাগ পেল কারস ও বাটুম শহর, আর কিছু নগদ অর্থ।
পশ্চিমের দেশগুলোর মুসলিম জমি দখলের উৎসবে, রাশিয়া ককেশাস ও মধ্য এশিয়ার মুসিলম এলাকা গিলে খায় ১৮৬৫-১৮৭৩ সালের মধ্যে। রাশিয়ার এই পিঠা ভাগের সফলতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে অস্ট্রেলিয়া ও গ্রেট ব্রিটেন ১৮৭৮ সালে কংগ্রেস অব বার্লিন নামক সভা ডেকে বসনিয়া ও হারজেগোভিনাকে অস্ট্রিয়ার হাতে দিয়ে দেয়। গ্রেট ব্রিটেন তুরস্কের সাইপ্রাস দ্বীপ পায়।
১৯০৭ সালে রাশিয়া মেনে নেয় যে, আফগানিস্তান তার প্রভাব বলয়ের বাইরে অর্থাৎ ব্রিটিশ প্রভাবে থাকবে। আর পারস্যের পিঠাকে তিন টুকরো করা হয়। উত্তর অংশে থাকে রুশ প্রভাব, দক্ষিণ অংশে ব্রিটিশ প্রভাব, আর মধ্যাংশে রাশিয়া-ব্রিটিশ উভয়ের প্রবাব।
রাশিয়া তুরস্কের সাম্রাজ্যের মধ্য এশিয়ার বিরাট তুর্কি এলাকা দখল করে নেয়। রাশিয়া আফগান সরকারকে উৎখাত করে কমিউনিজমের নামে দশ লাখ আফগানকে হত্যা করে।
চীন : কিং ডাইন্যাস্টির শাসনের সময় বিশেষ করে ডুনগান বিদ্রোহ (১৮৬২-১৮৭৭) এবং পানসে বিদ্রোহ (১৮৫৬-১৮৭৩) হয়। পানসে বিদ্রোহে দশ লাখ হুই মুসলিম ও ডুনগান বিদ্রোহে আরো বেশি হুই মুসলিম (কয়েক মিলিয়ন) নিহত হয়।
পূর্ব তুর্কিস্তান দখল করেছিল চীনের মানচু বংশীয় রাজা, ১৮৭৬ সালে। আট বছরের যুদ্ধ শেষে এই তুর্কি মুসলিম এলাকা চীনের সাথে মিশিয়ে দেয়া হয় জিনজিয়াং (নয়া মুলুক) নাম দিয়ে ১৮৮৪ সালের ১৮ নভেম্বরে। সোভিয়েত ইউনিয়ন চীন থেকে স্বাধীনতা পেতে উইঘুর তুর্কিদের সাহায্য করে, তবে যখন চীনে কমিউনিজম আসে, তখন আবার সেই বিদ্রোহ সোভিয়েত ইউনিয়নই দমন করে।
তুর্কিস্তান এলাকায় নকশাবন্দী সুফিরা চীনের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। এগুলো হয় ১৮২০-২৮, ১৮৩০, ১৮৪৭ ও ১৮৬১ সালে। ইয়াকুব বেগ (১৮২০-৭৭) পুরনো তুর্কিস্তান মুক্ত করে দশ বছর শাসন করে। সুফি দরবেশরা বাংলার ফকির সুফিদের মতো যুদ্ধ করেন চীনের অন্যত্র মুসলিম এলাকায়। এ সময় একজন মহান মুসলিম বীর ছিলেন মা সিং সিন (মৃত্যু ১৭৮১)। পরে আরেক মুসলিম বীর ছিলেন মা মুয়া সিং, যিনি ১৮৬২-১৮৭৭ সালে যুদ্ধ করেন। তবে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের কাছে নিঃশেষ হয়ে যান সবাই। ইউনান এলাকায় মুসলিম বীর টুওয়েন সিন চীনা সম্রাটের বাহিনীকে পরাজিত করে সুলতান সোলায়মান নাম নিয়ে পনেরো বছর রাজত্ব করেন।
লেখক : ইতিহাসবিদ, গবেষক