পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা বঞ্চিতই রয়ে গেছে: অমর্ত্য সেন
সামাজিক সুযোগ-সুবিধা থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা বঞ্চিত ও পিছিয়ে, একটি সমীক্ষার পর্যবেক্ষণে এই মত অমর্ত্য সেনের। সমীক্ষাটি চালায় প্রতীচী ইনস্টিটিউট, অ্যাসোসিয়েশন স্ন্যাপ এবং গাইডেন্স গিল্ড। রোববার এক অনুষ্ঠানে রিপোর্টটি প্রকাশ করেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন।
রিপোর্টের পর্যবেক্ষণে অমর্ত্য সেন বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের দরিদ্র এবং বিভিন্ন সামাজিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিতদের মধ্যে অধিকাংশই মুসলমান। মুসলমানদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ বিভিন্ন সামাজিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পথে কোন বিষয়গুলি বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তা খুঁজে বার করতে হবে।
পাশাপাশি নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, উচ্চবর্গের মুসলমানদের বিশেষ সুযোগ সুবিধা দিলে, তাতে নিম্নবর্গের যে মুসলমানরা শিক্ষা অর্থ জমি থেকে বঞ্চিত, তাদের কোনও উপকার হয় না।
বিভিন্ন সভা-সমাবেশ থেকে প্রায়শই মুসলিমদের জন্য তার সরকারের কাজের ফিরিস্তি দেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু, বাস্তবে এ রাজ্যের মুসলমানরা কেমন আছেন? তৃণমূল জমানায় সত্যিই কতটা উন্নতি হয়েছে তাদের? তা দেখতেই এই সমীক্ষা চালিয়েছে প্রতীচী ইনস্টিটিউট, অ্যাসোসিয়েশন স্ন্যাপ এবং গাইডেন্স গিল্ড। এই সমীক্ষার রিপোর্টেই প্রশ্নের মুখে পড়েছে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি।
দু’দফায় এই সমীক্ষাটি হয়েছে ২০১২ ও ২০১৩ সালে। অর্থাৎ তৃণমূল জমানাতেই। সমীক্ষার রিপোর্টে বলা হয়েছে, এ রাজ্যে যতসংখ্যক মানুষের মধ্যে সমীক্ষা করা হয়েছে, তার মধ্যে এক পঞ্চমাংশ মুসলিম এখনও নিরক্ষর।
২০১৫ সালের হিসেব অনুযায়ী, উচ্চপদস্থ সরকারি চাকরিতে মুসলিম প্রতিনিধিত্ব মাত্র ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ২০১৩-১৪ আর্থিক বছরের হিসেব অনুযায়ী, এরাজ্যে সরকারি চাকরিপ্রাপ্ত হিন্দুর সংখ্যা যেখানে ৩ লক্ষ ২৪ হাজার ৪৬৭, সেখানে মুসলিমের সংখ্যা ১৯ হাজার ৩৪২। সরকারিতে চাকরিতে মুর্শিদাবাদের মতো মুসলিম অধ্যুষিত জেলার প্রতিনিধিত্ব মাত্র ৪ দশমিক ৪ শতাংশ।
শুধু শিক্ষা বা চাকরি ক্ষেত্রেই নয়। অন্যান্য ক্ষেত্রেও যে বঞ্চনার শিকার মুসলিমরা, তা স্পষ্ট সমীক্ষায়। সেখানে বলা হয়েছে, ১৮ শতাংশ মুসলিম এমন জায়গায় বাস করেন, যেখানে রাস্তা কাঁচা। সাইকেল চালানোরও অযোগ্য।
সমীক্ষার রিপোর্টে যেখানে রাজ্যের মুসলমানদের দুন্দশার এই ছবি উঠে এসেছে, সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেন, সংখ্যালঘু উন্নয়নে এরাজ্য এক নম্বরে! এই প্রতিবেদিনের সূত্র ধরে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানায়, পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতি ১০টি মুসলিম পরিবারের মধ্যে ৮টি পরিবারের মাসিক আয় ৫০০০ রুপি অথবা তার চেয়েও কম। প্রতি ৫ পরিবারের একটি বাস করে দারিদ্র্য সীমার নিচে। রাজ্যের ৩৮.৩ শতাংশ সংখ্যালঘুর গড় মাসিক আয় ২৫০০ রুপি অথবা তারও নিচে আর এই সংখ্যালঘুদের ২৭ শতাংশই মুসলমান।
রিপোর্ট প্রকাশ অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছেন, আমাদের সমাজজীবনে বিভিন্ন অংশের মধ্যে পারস্পরিক অপরিচয় আছে। তার থেকে আসে অজ্ঞানতা। সেখান থেকে জন্মায় অবিশ্বাস। তার থেকে আসে অসহিষ্ণুতা। সেখান থেকে তৈরি হয় অশান্তি, যা কখনও কখনও দাঙ্গা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। পরস্পরের মধ্যে পরিচয়ই এই সমস্যা ঠেকানোর পথ এবং সেটা সরকারের নয়, সমাজের দায়িত্ব বলে শঙ্খবাবু মনে করেন।
রিপোর্ট নিয়ে অমর্ত্য সেন তার লিখিত বক্তব্যে জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের অন্যদের তুলনায় বাঙালি মুসলিমরা কত বঞ্চিত, তা এখন বোঝা সম্ভব হচ্ছে। যদিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বারে বারেই বলে এসেছেন যে, তার জমানায় মুসলিমদের বিরাঁ উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু এদিনের রিপোর্টে সেই তথ্য ধরা পড়েনি। অমর্ত্য সেন আরও বলেন, ‘অতীতের প্রেক্ষিতে বর্তমানের বঞ্চনাকে বোঝার ক্ষেত্রে একটি অঞ্চলের ইতিহাস খুব গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গের বঞ্চিত মুসলিমদের বর্তমান অবস্থা জমি সম্পর্ক, সামাজিক বাধা, ব্যবসার সুযোগ, সরকারি সাহায্যের ব্যাপ্তী এবং সীমা এবং অন্যান্য বিষয়ের উপর নির্ভরশীল।’ তার মন্তব্য অতীতের আলোয় বর্তমানকে বুঝতে হলে ইতিহাসে ভাল দখল থাকা প্রয়োজন।
উদ্যোক্তারা রিপোর্টের কপি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠাবেন বলে জানিয়েছেন। এই রিপোর্টে মুসলমানদের উন্নয়নের একটি দিশা রয়েছে বলে দাবি তাদের।