১৩ মাসে ৩২১ শিশুকে হত্য, সামাজিক অবক্ষয় ও বিচারহীণতাও দায়ী
শিশুদের লাশ মিলছে খালে-বিলে ম্যান হোলে, মাটির নিচে…
নাছির উদ্দিন শোয়েব: মুক্তিপন আদায়, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে প্রান দিতে হচ্ছে নিষ্পাপ-কোমলমতি শিশু-কিশোরদের। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোটের সরকারের আমলে দেশে শিশু হত্যার ঘটনা ভয়াবহ রুপ নিয়েছে। বাবা-মায়ের কোল খালি করে বুকের ধন ছিনিয়ে নিয়ে ওরা নৃশংসভাবে হত্যা করছে নিরপরাধ শিশুদের। হত্যার পর লাশ গুম করতে মাটিচাপা কিংবা খাল, বিল, নদী ও ঝোপে ফেলে দিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। এখন শিশুদের লাশ পাওয়া যাচ্ছে, ড্রেনে, ডাঙ্গায় পানির ট্যাঙ্কি ও ম্যান হোল-বাগাড়ে। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ঘটছে এমন নৃশংস ঘটনা। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে শিশুদের লাশের মিছিল।
শিশু অপহরণ ও হত্যাকান্ডের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে, প্রতিটি পরিবারে। বাবা-মা তার প্রিয় সন্তানদের নিয়ে এখন উদ্বিগ্ন। সন্তানকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাতেও ভয় পাচ্ছেন। শিশুদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে ফিরে না আসা পর্যন্ত এক অজানা আতঙ্কে কাটাতে হচ্ছে স্বজনদের। এমন ভয়াবহ অবস্থায় শিশুদের নিরাপত্তা পড়েছে চরম হুমকিতে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে জানিয়ে তেমন কাজ হচ্ছে না। থানায় জিডি কিংবা মামলা করা হলেও জীবিত উদ্ধার করা যাচ্ছে না অপহৃত বা নিখোঁজ শিশুটিকে। পরে মিলছে লাশ। তবে এর ব্যতিক্রম ঘঢ়টচনাও ঘটছে। কিছু ঘটনায় সফলও হলেও অধিকাংশ ঘটনায় জীবিত উদ্ধারে ব্যর্থ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলাবহিনীর সদস্যরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন-দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মানুষের জনমালের নিরাপত্তার চেয়ে নিজেরাই অপরাধে জড়িয়ে পড়ায় অপরাধীচক্র সুযোগ নিচ্ছে। দুর্বৃত্তচক্র এখন তুচ্ছ ঘটনায় ভয়ঙ্কার অপরাধ করার সাহস পাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীল সদস্যরা বিতর্কিত হয়ে অনেক ঘটনায় তারা কাঠগড়ায় যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ধস নেমেছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে পরিস্থিতি কোন পর্যায় পৌঁছবে তা বলা মুশকিল হয়ে পড়ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক মাসে দেশে শিশু নির্যাতনের ঘটনার হার অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। চলতি মাসের ফেব্রুয়ারির প্রথম ১৭ দিনেই হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে অন্তত ১৪ শিশু। গত মাসে এই সংখ্যা ছিল ২৯টি। এই হিসাবে সারা দেশে প্রতিদিন গড়ে ঝরে পড়ছে একটি কোমলমতি শিশুর প্রাণ। শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, গত ১৩ মাসে সারাদেশে ৩২১ শিশুকে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া ২০১৫ সালে ২৪০ শিশুকে অপহরণ করা হয়। তাদের মধ্যে ১৬৭ শিশুকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ৪০ জনকে। বাকিদের কোনো খোঁজ নেই।গত মাসে শিশু নির্যাতনের এই হার বিশ্বে শিশু নির্যাতনের ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই হারে শিশু নির্যাতনে চলতে থাকলে তা নতুন এক রেকর্ড হয়ে দাঁড়াবে বলে মন্তব্য করছেন অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা।
গত বছর দেশে শিশু নির্যাতনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল সিলেটে শিশু রাজন হত্যা এবং খুলনায় শিশু রাকীব হত্যা। এই দুটি হত্যার পর সারাদেশে শিশু হত্যার প্রতিবাদে পদক্ষেপ নেয়ার দাবি উঠে। গেল বছরই এ দুটি হত্যা মামলার রায় হয়েছে। কয়েকজন অপরাধীকে সর্বোচ্চ শা¯িস্ত দিয়েছেন আদালত। তবুও দেশে শিশু নির্যাতনের মাত্রা না কমায় তা নিয়ে উদ্বিগ্ন সচেতন মানুষ। গত ৫ জানুয়ারি এক দিনেই দেশে ছয় শিশুকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে গাজীপুরের টঙ্গীতে চোর সন্দেহে মোজাম্মেল হককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ঢাকায় রানা নামের এক শিশুকে বিষ খাইয়ে হত্যা করে তার সৎ বাবা। চট্রগ্রামে ছুরিকাঘাতে নিহত হয় আজিম হোসেন।
সিলেট ও যশোরে অপহরণের পর সালমা ও লিমাকে হত্যা করা হয়। নিখোঁজ হওয়ার দুই মাস পর ২৮ জানুয়ারি মিঠাপুকুরে একটি জমির গর্ত খুঁড়ে পুলিশ শিশু রাহিমুল ইসলামের লাশ উদ্ধার করে। ৩০ জানুয়ারি মুন্সিগঞ্জের সদরে মালির পাথর এলাকায় একটি পরিত্যক্ত ঘর থেকে নীরব নামের এক মাদ্রাছাত্রের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। রাজধানীর রামপুরা এলাকার গৃহকর্মী মুন্নী আক্তারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ২৪ জানুয়ারি পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে। গত ২৮ জানুয়ারি গেল মাসে রাজধানীতে আরো বেশ কয়েকটি শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে।
বিশ্লেষকদের মতে, পেশাদার অপরাধী ছাড়া শিশু অপহরণ, শিশু ধর্ষণ, শিশু হত্যার মত অতিজঘন্য কাজে লিপ্ত হতে পারে না। দেশের আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি না হলে এ সব অপরাধী শিশু নির্যাতনের মত অতিজঘন্য কাজে লিপ্ত হতে পারত না। কোন পরিবারের একজন শিশু অপহৃত হলে তার পিতা-মাতা ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। শান্তি ও স্বস্তি ঐ পরিবার থেকে বিদায় নেয়। অপহৃত শিশুকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক উদ্ধার করার দু’চারটি ঘটনা পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারলে শিশু নির্যাতন কমে যেত। কিন্তু বর্তমান সরকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দলীয় কর্মীদের মত ব্যবহার করছে। বিরোধীদলের কর্মীদেরকে দমন করাই এখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান কাজ। ফলে শিশু নির্যাতনের সাথে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেফতার এবং তাদেরকে আইনের আওতায় এনে কঠিন শাস্তি প্রদানের কাজ খুব কমই হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন বিচারহীনতার কারণে শিশু নির্যাতন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধতত্ত্ব এবং অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. জিয়াউর রহমান বলেন, দিন দিন সামাজিক অবক্ষয় বেড়েই চলছে। অবক্ষয় যখন সমাজের সর্বত্রই হয় তখন এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে কেউ রেহাই পায় না। বর্তমানে দেশে শিশু নির্যাতনের ঘটনায় সামাজিক অবক্ষয়কেই তিনি দায়ী করে বলেন, এই শিক্ষা মানুষকে জোর করে শেখানো যায় না। বরং সবাই পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং মানবিক হলেই এসব ঘটনা এড়ানো সম্ভব।
কয়েকটি ঘটনা: হবিগঞ্জের বাহুবলে চার শিশুকে হত্যার আগে ১৬ই ফেব্রুয়ারি গাজীপুরে এক শিশুকে হত্যা করা হয়। ১৪ই ফেব্রুয়ারি পাবনায় দুই শিশুকে বিষ খাইয়ে হত্যার পর আত্মহত্যা করে এক নারী। ৩রা ফেব্রুয়ারি বরিশালের গৌরনদীতে কবিতা নামে এক শিশু ও পঞ্চগড়ে আম্বিয়া নামে এক শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ১লা ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জে এক শিশুকে হত্যা করে তার মা। ৩১ শে জানুয়ারি কেরানীগঞ্জে আব্দুল্লাহ নামে এক শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়। তিনদিন পর তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ৩০শে জানুয়ারি মুন্সীগঞ্জ সদরের মালির পাথর এলাকার একটি পরিত্যক্ত ঘর থেকে নীরব (১১) নামের এক মাদরাসা ছাত্রের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিখোঁজ হওয়ার দুই মাস পর ২৮শে জানুয়ারি মিঠাপুকুরের একটি জমির গর্ত খুঁড়ে পুলিশ শিশু রাহিমুল ইসলামের (১১) লাশ উদ্ধার করে। ২৪শে জানুয়ারি রামপুরা এলাকার শিশু গৃহকর্মী মুন্নী আক্তারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ১৯শে জানুয়ারি কক্সবাজারের রামুর বড়বিল গ্রামের একটি ফলের বাগান থেকে মোহাম্মদ শাকিল (১০) ও মোহাম্মদ কাজল (৯) নামের দুই সহোদরের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ১৬ই জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের ২ নম্বর বাবুরাইলে পাঁচজনকে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে শান্ত (৫) ও সুমাইয়া (৫) নামের দুই শিশুও ছিল। নিখোঁজের এক মাস পর গাজীপুরে ৯ই জানুয়ারি রাব্বি হোসেন নামের তিন বছরের এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। একইভাবে নিখোঁজের পর কুমিল্লার তাহমিনা ও মনিকা, গাইবান্ধার মশিউর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লায়লা হোসেন ও তাসলিমা বেগম, নাটোরের খানজাহান ও নরসিংদীর তাপস বিশ্বাসের লাশ উদ্ধার করা হয়।