মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে পশ্চিমাদের আরো নমনীয় হতে হবে

Soumaya Ghannoushiসুমাইয়া ঘানুশি: পশ্চিমারা সেনা সরিয়ে নিচ্ছে। একই সাথে অর্থনৈতিকভাবে ধুঁকতে শুরু করেছে। যদিও তাদের আওয়াজ এখনো কমেনি। এখনো তারা নিজেদের প্রভু এবং অন্য দেশ-মহাদেশের ভাগ্য নির্ধারক বলে মনে করে। রাশিয়া, ইউক্রেন বা জর্জিয়া পূর্বের অংশ না পশ্চিমের? তুরস্কেরই বা অবস্থান কোথায়? এই দেশটির সর্ববৃহৎ শহর ইস্তাম্বুলে প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ লোক বাস করে। ইউরোপে (?) এটিই হলো তৃতীয় সর্বোচ্চ জনবহুল শহর। আর বলকানদের অবস্থাই বা কী? ওসমানীয় সাম্র্রাজ্যের নির্যাতনের চিহ্ন কি তারা আজো বয়ে চলেছে? সমাজতন্ত্রের বিষয়েই বা তাদের অভিজ্ঞতা কেমন হচ্ছে? তারা কাদের অংশ? পূর্বের না পশ্চিমের?
পশ্চিমাদের অবস্থান কি শুধুই ভৌগোলিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নির্ধারণ করা হয়? অবশ্যই না। তাহলে তো অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের অবস্থান হতো এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায়। আর ইসরাইলের অবস্থান হতো আরব বিশ্বের মাঝখানে। তারা কোনো অবস্থাতেই ‘পশ্চিমা বিশ্বের’ অংশ হতো না। পশ্চিমা বিশ্বের যে সীমান্তরেখা আমরা আঁকি তা অনেকাংশেই কল্পনাপ্রসূত; বাস্তবভিত্তিক নয়। আবার সুনির্দিষ্টও নয়। রাজনীতি আর ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে অবিরাম এর সীমানা পাল্টাচ্ছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজনৈতিক আদেশ দেয়ার কেন্দ্র ছিল লন্ডন। তাদের পরের অবস্থানই ছিল প্যারিসের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসে। মোড়লের স্থানে গিয়ে বসে ওয়াশিংটন।
পশ্চিমের প্রাধান্য আজো প্রায় একই রকম। ক্ষমতা, উন্নতি, কারণ ও সৃজনশীলতা- সব ক্ষেত্রেই চালকের আসনে রয়েছে এরাই। পশ্চিমারা নিজেদের যেভাবে উপস্থাপন করে এবং বাস্তবিক অর্থে তারা যা, এর মধ্যে বেশ কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। বিশেষ করে তাদের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রাধান্য এবং বিশ্বের নেতৃত্ব দানকারী হিসেবে পরিচিতি। প্রাচ্যের ওপর তাদের প্রাধান্য দীর্ঘ দিনের। প্রাচ্য যে শুধু সামরিক, অর্থনৈতিক বা প্রযুক্তিগত দিক থেকে পিছিয়ে, তাই নয়; বরং নৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবেও পশ্চাৎপদ, স্বৈরতান্ত্রিক, বদ্ধ ও অধীন।
সাংস্কৃতিকভাবে পশ্চিমারা বরাবরই নিজেদের সর্বোৎকৃষ্ট মনে করে আসছে। অবশ্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিকভাবে বহু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। ঊনবিংশ বা বিংশ শতাব্দীতে পশ্চিমারা যা ছিল, তা আজ আর নেই। বিশ্বমোড়লের স্থানটি লন্ডন বা প্যারিসে না থেকে ওয়াশিংটনে চলে গেছে। এর অবস্থান বিশ্বের পশ্চিমাংশে নয়।
আমরা বহু মেরুর এক বিশ্বে বাস করি। যেটাকে অনেকেই কোনো মেরুমুখী ব্যবস্থা হিসেবে দেখতে চান না। বাস্তবতা হলো, আজকের পৃথিবীতে এমন কোনো একক শক্তি নেই, যারা যেকোনো সঙ্কটকে নিজের উপায়ে বা তাদের দৃষ্টিতে সঠিক- এমন পদ্ধতিতে মিটিয়ে ফেলতে পারে।
বিশ্বব্যবস্থা এখন বহুমাত্রিক। এর কেন্দ্র ছড়িয়ে গেছে চীন, রাশিয়া, ভারত, জাপান বা ব্রাজিলে। বিষয়টি শুধু আন্তর্জাতিক নয়, আঞ্চলিক পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছে। প্রতিবেশীদের ওপর ইরান, তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজেরিয়া, মেক্সিকো ও ভেনিজুয়েলার প্রভাব বাড়ছে। এ ব্যাপারে তারা লন্ডন বা ওয়াশিংটনকেও ছাড়িয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যে- বিশেষ করে সিরিয়া, মিসর, ইরাক, লিবিয়া অথবা ইয়েমেনে যা ঘটছে, তা ইরাক ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজিত এবং সেনা সরাতে বাধ্য হওয়ার কারণে সৃষ্ট শূন্যতার ফলাফল।
এমনকি, রাষ্ট্রহীন কিছু গোষ্ঠীও ‘বৃহৎ শক্তিগুলোর’ চেয়ে জোরদার প্রভাব রাখতে সক্ষম হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এগুলোর বেসামরিক ও সামরিক শক্তিও রয়েছে; যেমন- হামাস বা হিজবুল্লাহ। আবার ইসলামিক স্টেট (আইএস), আলকায়েদার মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীও রয়েছে।
এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ এখন আর ওয়াশিংটন, লন্ডন বা প্যারিসের হাতে নেই। আরব বসন্তের সময়ই এরা বিস্ময়ে হতবাক হয়েছে। নিয়ন্ত্রণহীনতার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্তই ছিল ওটা। এরপর প্রতিবিপ্লবের যে ধারা দেখা যাচ্ছে, এর ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। প্রতি ক্ষেত্রেই তারা চালকের আসনে বসার চেষ্টা করেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা খুব একটা সাফল্য পায়নি। এ দু’টি বিষয়ই তারা শুধু দেখে গেছে নীরব দর্শকের মতো।
মিসরের উদাহরণই নেয়া যাক, ২৫ জানুয়ারি যে বিপ্লবটি ঘটেছিল, তার মূল নায়ক সাধারণ মানুষ। এরপর ঘটনা এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব নেয় সেনাবাহিনী। তখনকার প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারককে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল তারা। এরপর রঙ্গমঞ্চে আসে উপসাগরীয় দেশগুলো। মিসরের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র করেছে তারা। এখন দেশটি আবারো সামরিক শাসনের অধীনে। পরিস্থিতি মোবারকের আমলের চেয়েও খারাপ।
সিরিয়ার ক্ষেত্রে এক দিকে ইরান ও রাশিয়া এবং অপর দিকে তুরস্ক, সৌদি আরব ও কাতার খেলে যাচ্ছে। ইরাকের ক্ষেত্রে খেলছে ইরান এবং আইএস। আর অতিরিক্ত খেলোয়াড়ের ভূমিকায় সাইড লাইনে বসে রয়েছে পশ্চিমারা। তিউনিসিয়ায় রাজনৈতিক অচলাবস্থা, মধ্যস্থতা এবং সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর কাজটি হয়েছে অভ্যন্তরীণভাবেই। উত্তর আফ্রিকার এই দেশটিতে পশ্চিমাদের প্রভাব এ ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়নি। প্রতিবেশী লিবিয়ার ক্ষেত্রে তাদের বিপ্লবের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র বা ফ্রান্সের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব দেখা গেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর, তুরস্ক ও কাতারের।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, আজ আমরা এমন এক পশ্চিমাকে দেখছি, যারা সেনাবাহিনী প্রত্যাহারে বাধ্য হয়; যাদের অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়ে আসছে, যদিও প্রভুদের মতো কথা বলার স্বভাব এখনো তাদের যায়নি। এখন তাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো নম্রতার শিক্ষা নেয়া। তাদের আচরণ, ধরন, ভাষার ব্যবহার এবং স্ব-আরোপিত ভাবমূর্তিতে নমনীয় হতে হবে।
-সুমাইয়া ঘানুশি ব্রিটিশ-তিউনিসীয় লেখক এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ। মিডল ইস্ট আই-এ সম্প্রতি প্রকাশিত ও আলোচিত এ কলামটির অনুবাদ করেছেন তানজিলা কাওকাব

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button