আরেকটি সঙ্কটের ঝুঁকিতে বিশ্ব অর্থনীতি
জোসেফ ই. স্টিগলিজ: ২০০৮ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে মন্দা দেখা দিয়েছিল, তারপর সাতটি বছর কেটে গেছে। কিন্তু অর্থনীতির হোঁচট খাওয়া বন্ধ হয়নি আজো। ২০১৬ সালে বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে জাতিসঙ্ঘ যে রিপোর্ট দিয়েছে তাতে দেখা যায়, সঙ্কট শুরু হওয়ার পর থেকে উন্নত দেশগুলোর গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৫৪ শতাংশের বেশি কমে গেছে। এসব দেশে মোটামুটি সাড়ে চার কোটি মানুষ বেকার, যা ২০০৭ সালের চেয়ে এক কোটি ২০ লাখ বেশি। যদিও সঙ্কটের সময় থেকে মূল্যস্ফীতি এখন সর্বনিম্ন। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, উন্নত দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি আরো বেশি উদ্বায়ী হয়েছে। এটা বিস্ময়ের ব্যাপার। কারণ উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতি পুরোপুরি উন্মুক্ত ক্যাপিল্যা অ্যাকাউন্টের, সেগুলোর অবাধা পুঁজিপ্রবাহ এবং আন্তর্জাতিক রিস্ক শেয়ারিং থেকে লাভবান হওয়ার দরকার ছিল। এর ফলে ম্যাক্রোইকোনমিক ভোলাটিলিটি হওয়ার কথা ছিল স্বল্প। অধিকন্তু, বেকার সুবিধাসহ সামাজিক স্থানান্তর পরিবারগুলোকে তাদের ভোগ স্থিতিশীল রাখাবে বলে কথা ছিল। কিন্তু সঙ্কটোত্তরকালে রাজনীতির আধিপত্য, বেশির ভাগ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফিসক্যাল রিট্রান্সমেন্ট এবং কোয়ান্টিটিভ ইজিং (কিউই) পরিবারভিত্তিক ভোগ, বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি চাঙ্গা করতে সহায়ক হয় সামান্যই। এর বিপরীতে এগুলো পরিস্থিতিকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রে কোয়ান্টিটিভ ইজিং ভোগকে চাঙ্গা করতে পারেনি এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেছে সামান্যই। কারণ, বাড়তি তারল্যের বেশির ভাগ কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর কোষাগারে ফেরত যায় অতিরিক্ত রিজার্ভের আকারে। ২০০৬ সালের ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস রেগুলেটরি রিলিভ অ্যাক্ট, ফেডারেল রিজার্ভকে প্রয়োজনীয় এবং অতিরিক্ত রিভার্ভের ওপর সুদ পরিশোধের অনুমতি দেয়। এর ফলে কিউই’র উদ্দেশ্য উপেক্ষিত হয়।
বস্তুত, যুক্তরাষ্ট্রেও আর্থিক খাত যখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়, ২০০৮ সালের ইমার্জেন্সি ইকোনমিক স্ট্যাবিলাইজেশন অ্যাক্ট, রিজার্ভের ওপর সুদ দেয়ার কার্যকর সময় বাড়িয়ে তিন বছর করা হয়। ওই বছরের ১ অক্টোবর এই আইন কার্যকর হয়। এর ফলে অতিরিক্ত রিজার্ভ আটকা পড়ে। এই রিজার্ভ যেখানে ২০০০-২০০৮ সালে গড়ে ছিল ২০০ বিলিয়ন ডলাল, সেখানে তা ২০০৯-২০১৫ সালে ১.৬ ট্রিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অর্থ প্রকৃত অর্থনীতিতে বিনিয়োগের চেয়ে ফেড-এ জমা রাখা লাভজনক মনে করে। এখান থেকে পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্তভাবে তারা গত পাঁচ বছরে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার আয় করে নেয়। এই অংকটি মূলত ছিল গোপনীয় এবং ফেড থেকে আর্থিক খাতকে দেয়া এক ধরনের সাবসিডি। এল ফলে গত মাসে ফেড সুদ-হার বাড়িয়েছে। আর সেই সাথে ওই সাবসিডি এ বছর আরো ১৩ বিলিয়ন ডলার বেড়ে যাবে।
এই ন্যায়ভ্রষ্ট ইসসেনটিভই হলো, নিম্ন সুদহারের বহু রকম সুবিধা আর বাস্তবে রূপলাভ করেনি। প্রায় সাত বছর ধরে কিউই প্রায় শূন্যের কাছাকাছি সুদহার ধরে রাখতে সক্ষম হওয়ায় তা উন্নত দেশগুলোর সরকারকে অর্থ ঋণ নিয়ে অবকাঠামো, শিক্ষা ও সামাজিক খাতে ব্যয়ে উৎসাহিত করে থাকবে।
সঙ্কটোত্তরকালে ক্রমবর্ধমান সামাজিক স্থানান্তর সমষ্টিগত চাহিদা চাঙ্গা করে এবং ভোগের ধরনটি মসৃণ করতে সহায়ক হয়। অধিকন্তু, জাতিসঙ্ঘ রিপোর্টে স্পষ্টভাবে দেখা যায়, উন্নত বিশ্বজুড়ে সবাই যেমনটা আশা করেছিল বেসরকারি বিনিয়োগ তেমন বাড়েনি। এর কারণ ছিল অতিমাত্রায় নিম্ন সুদহার। ১৭ থেকে ২০টি বৃহৎ উন্নত অর্থনীতিতে ২০০৮-পরবর্তী সময়ে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ছিল সঙ্কট-পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে অনেক নিচু। এসব দেশের মধ্যে পাঁচটি ২০১০-২০১৫ সময়ে বিনিয়োগে অবনতি ঘটে।
এই সময়ে বিশ্বব্যাপী নন-ফিন্যান্সিয়াল করপোরেশনগুলোর ঋণ সিকিউরিটি ইস্যু ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ধারণা করা হয়েছিল এগুলো হবে ফিক্সড ইনভেস্টমেন্ট। আরো অন্যান্য প্রমাণ থেকে বুঝা যায়, স্বল্প সুদের সুযোগ নিয়ে অনেক নন-ফিন্যান্সিয়াল করপোরেশন ঋণ গ্রহণ করে। তারা ঋণ করা অর্থ পুনর্বিনিয়োগ না করে তা তার নিজেদের ইক্যুইটি পুনঃক্রয় বা অন্যান্য সম্পদ কেনার কাজে ব্যবহার করে। ফলে কিউই লিভারেজ, মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন ও আর্থিক খাতের লাভজনকতার বৃদ্ধি ঘটায় ব্যাপকভাবে।
কিন্তু, এগুলোর কোনোটিই প্রকৃত অর্থনীতিকে সহায়তা করে না। স্পষ্টতই, সুদহার শূন্যের কাছাকাছি রাখা উচ্চপর্যায়ের ঋণদান বা বিনিয়োগ সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়। ব্যাংকগুলোকে যখন বেছে নেয়ার স্বাধীনতা দেয়া হলো, তারা ঝুঁকিমুক্ত লাভের খাত এমনকি ফিন্যান্সিয়াল স্পেকুলেশনের পথ বেছে নিলো। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বৃহত্তর উদ্দেশ্যগুলোকে সহায়তা দেয়ার জন্য যে পরিকল্পনা করা হয় সেদিকে তারা অগ্রসর হয় না।
এর বিপরীতে, বিশ্বব্যাংক বা আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল যখন দেশগুলোর উন্নয়নে সস্তায় টাকা দেয়ার কথা জানাল, তখন এসব দেশ ওই টাকা দিয়ে কী করবে সেই শর্ত দিয়ে বসল। তাই প্রত্যাশিত ফল পেতে হলে কিউইকে ক্ষতিগ্রস্ত ঋণদান চ্যানেলগুলো (বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো) স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কেবল সরকারের তরফ থেকেই সহায়তা পেলে হবে না, এগুলোকে ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট ঋণদান টার্গেট থেকেও সহায়তা পেতে হবে। তাই ফেড-এর উচিত ছিল অতিরিক্ত রিজার্ভ ধরে রাখার জন্য ব্যাংগুলোকে শাস্তি দেয়া।
যদিও অত্যধিক নিম্নহারের সুদ উন্নত দেশগুলোকে কিছুটা সুবিধা এনে দেয়; কিন্তু তারা উন্নয়নশীল ও উদীয়মান অর্থনীতির ওপর উচ্চমাত্রায় মূল্য চাপিয়ে দেয়। আর্থিক শিথিলতার ফলে আন্তঃসীমান্ত পুঁজিপ্রবাহ বেড়ে যায়, যা কাক্সিক্ষত না হলেও যা অপ্রত্যাশিত ছিল না। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পুঁজি গমনের পরিমাণ ২০০৮ সালে ২০ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০১০ সালে ৬০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ছাড়িয়ে যায়।
এ সময়ে অনেক উদীয়মান বাজারকে আকস্মিক পুঁজিপ্রবাহ সামাল দিতে গিয়ে কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। এর খুব অল্পই ছিল স্থাবর বিনিয়োগ। বস্তুত, সঙ্কটোত্তরকালে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে স্থবির হয়ে পড়ে। ২০০৬ সালের পর এ বছর উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে ক্যাপিটাল আউটফ্লো’র রেকর্ড সৃষ্টি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সম্মিলিতভাবে যার পরিমাণ দাঁড়াবে ৬১৫ বিলিয়ন ডলার।
যা করা উচিত তা আর্থিক নীতি বা অর্থায়ন খাত কোনোটিতেই করা হচ্ছে না। মনে হচ্ছে তারল্যের প্রাচুর্য প্রকৃত অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার বদলে সামঞ্জস্যহীনভাবে আর্থিক সম্পদ এবং অ্যাসেট বাবল সৃষ্টির দিকে এগিয়ে চলেছে। বিশ্বব্যাপী ইক্যুইটি মূল্যের তীব্র পতনের কারণে বিশ্ব জিডিপির অংশের অনুপাতে মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন এখনো উচ্চপর্যায়ে থেকে গেছে। তাই আরেকটি অর্থনৈতিক সঙ্কটের ঝুঁকি উপেক্ষা করা যায় না।
আরো কিছু কৌশল আছে যা দিয়ে টেকসই এবং ইনক্লুসিভ প্রবৃদ্ধি ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। এগুলো হলো বৃহত্তর সমতা নিশ্চিত করা, অধিকতর দীর্ঘমেয়াদি চিন্তাভাবনা এবং কার্যকর বিধিমালা ও যুতসই ইনসেনটিভ কাঠামোর মাধ্যমে আর্থিক খাতের রাশ টেনে ধরার জন্য বাজার অর্থনীতির আইনগুলো নতুন করে লেখা। কিন্তু অবকাঠামো, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে সরকারি বিনিয়োগেরও ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটাতে হবে। আর অংশত হলেও এগুলোকে অর্থায়ন করতে হবে পরিবেশকর, একচেটিয়াত্ব ও অন্যান্য যেসব খাত বাজার অর্থনীতিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে সেগুলোর ওপর কর, ইত্যাদি বসিয়ে। কারণ এই শেষোক্ত বিষয়গুলোই ব্যাপকভাবে অসমতা সৃষ্টি করছে এবং প্রবৃদ্ধিকে ধীর করে দিচ্ছে।
–অনুবাদ : মাসুম বিল্লাহ