নানা সমীকরণে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ ও ন্যাটো
আমেরিকান কর্মকর্তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা শুরু করেছেন। বিশেষ করে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ১২ ফেব্রুয়ারি বলেছেন, যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার মধ্যে আমেরিকার ‘খুবই জোরালো’ স্বার্থ রয়েছে। এখন পর্যন্ত অবস্থা যা, তাতে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ইউরোপিয়ানরা নিজেরাই ইইউর সমস্যাগুলো মিটিয়ে ফেলতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে না, ইউরোপের সমস্যাগুলো সরাসরি মার্কিন স্বার্থকে প্রভাবিত করছে, ইইউর নীতিকে প্রভাবিত করার মতো নিজেকে সামর্থ্যপূর্ণও ভাবছে না আমেরিকা। সমস্যা এত গভীর যে, তাতে দাঁত বসানো কঠিন।
ইইউতে বিভক্তির মাত্রাটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই হিসাবটা বদলে দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে গভীর ফাটল সেখানেই সীমিত থাকবে না, ন্যাটোতেও তা প্রতিফলিত হবে। ইউরোপে মার্কিন নীতি নিরাপত্তাগত বিষয়েই কেন্দ্রীভূত, আর ইউরোপিয়ান শক্তিগুলো মোটামুটিভাবে অন্যান্য বিষয়ভিত্তিক মহাদেশীয় সম্পর্ক গড়ার কাজে গুরুত্ব দিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জার্মানির উদ্বেগ নতুন পোলিশ সরকার নিয়ে, আর হাঙ্গেরির ফিদেজ সরকার মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে বার্লিনের ভূমিকা প্রশ্নে নির্দেশিকা দিয়ে যাচ্ছে। অথচ রাশিয়াকে কৌশলগতভাবে সংযত রাখার জন্য বাল্টিক দেশগুলো থেকে রোমানিয়া পর্যন্ত পূর্ব ইউরোপে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সৃষ্টির মার্কিন প্রতিশ্র“তির সাথে সাংঘর্ষিক। কোনো কোনো ইউরোপিয়ান মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করে সত্যি সত্যি বাহিনীও পাঠিয়েছে, আবার কেউ কেউ এ ব্যাপারে কিছুই করেনি। তাদের সিদ্ধান্ত বরং অনেক জটিল হবে এবং তা রুশ হুমকিকেন্দ্রিক নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সিরিয়া থেকে আসা উদ্বাস্তুর ঢল কেবল ইউরোপের জন্যই নানা সমীকরণের ব্যাপার নয়, বরং তা অন্যান্য স্থানে সন্ত্রাসী সক্ষমতার বিষয়ও। পুঙ্খানুপুঙ্খ উদ্বাস্তু কর্মসূচি তৈরিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অক্ষমতা আসলে ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় টহল দিতে সৈন্য মোতায়েন নিয়ে তাদের অক্ষমতাই ফুটিয়ে তুলছে। কয়েক মাস হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত অনিশ্চিত, ইউরোপিয়ানরা কার্যকর পর্যাপ্ত শক্তি মোতায়েন করবে কি না। তারা চায়, বাহিনী আসুক ন্যাটো থেকে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র এতে অংশ নিক। মানবপাচার কমাতে সহায়তা করার জন্য জার্মানি, তুরস্ক ও গ্রিস অনুরোধ করায় ১১ ফেব্র“য়ারি এজিয়ান সাগরে জাহাজ মোতায়েনের ঘোষণা দেয় ন্যাটো। তবে এমন এক বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক পরিবেশে বাহিনী মোতায়েন নিয়ে আমেরিকানরা উদ্বিগ্ন।
স্নায়ুযুদ্ধকালে মিশন ছিল সহজ। তখন রাজনৈতিক মতৈক্য ছিল, পরিকল্পনাও ছিল তৈরি। অবশ্য নানা ধরনের মতভেদও ছিল। কারণ ফ্রান্স তখনো পরাশক্তি হিসেবে নিজেকে দেখতে চেয়েছিল। তবে ওই সব মতভেদ ছিল একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনমাত্র ন্যাটোর মিশন হয়ে পড়ে একেবারে কম। রুশ শক্তির নতুন করে আত্মপ্রকাশ এবং উদ্বাস্তু নিয়ে নতুন নতুন জটিলতার মধ্যে (সিরিয়া ও ইরাকের) ইসলামিক স্টেটের মোকাবেলা থেকে সাগরপথে আসা উদ্বাস্তুদের আলাদা রাখা ইত্যাদি ব্যাপারে আবারো যুক্তরাষ্ট্র-ইইউ সমন্বয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র দেখতে পাচ্ছে, ইইউর বিভেদ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ার জটিলতায় ন্যাটো সমস্যায় পড়ছে। রাশিয়ার সাথে ন্যাটো সদস্য তুরস্কের সামরিক সঙ্ঘাত অবশ্যই ন্যাটোর স্বার্থের সংজ্ঞার মধ্যে পড়তে হবে। এটি আবার উদ্বাস্তু প্রশ্নটির মধ্যে পড়ে যায়, উদ্বাস্তু সমস্যাটি আবার পড়ে ইউরোপিয়ান অবাধ চলাচল এলাকা ‘শেনজেন জোনের’ মধ্যে। নির্ভেজাল ন্যাটো ইস্যু, নির্ভেজাল ইইউ ইস্যু এবং সঙ্কট ইস্যুগুলো পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। ইউরোপিয়ান মন ভয়ে চমকে উঠছে। আমেরিকান মন স্থবির হয়ে পড়েছে।
একতরফা সব কার্যক্রমের জন্য মার্কিন প্রতিরক্ষানীতির দার্শনিক ভিত্তি হিসেবে এখনো রয়ে গেছে ট্রান্স-আটলান্টিক জোটের ধারণাটি। ধরে নেয়া হচ্ছে (যুক্তিপূর্ণ হতে হবে, এমন নয়), চরম যেকোনো পরিস্থিতিতে ন্যাটোর সবাই একসাথে কাজ করবে। আমেরিকান যুদ্ধ-কৌশল জোটগত যুদ্ধ-কৌশল মূলনীতিভিত্তিক। যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব গোলার্ধে তার সামরিক শক্তি নিয়োজিত রেখেছে। তার বাহিনী ইউরোপিয়ান বাহিনীর চেয়ে বড় হলেও এর বেশির ভাগই পাওয়ার প্রজেকশনে নিয়োজিত। পূর্ব গোলার্ধে যে আক্রমণকারী বাহিনী যুক্তরাষ্ট্র মোতায়েন করতে পারে তা সেখানকার প্রয়োজন মেটানোর জন্য কোনোভাবেই পর্যাপ্ত নয়।
ইরাকের ব্যাপারে বলা যায়, আগ্রহী একটি জোটের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নির্ভরশীল। সেখানে ন্যাটো ছিল না। ব্রিটিশরা ছিল। ইউরোপের একমাত্র ব্রিটেনই আগ্রহী জোটে যোগ দিতে এবং শক্তিশালী বাহিনী পাঠিয়েছিল। ন্যাটোর মধ্যে ব্রিটেনেরই একটি বাহিনী আছে, যে সদস্যদের রাজি করানোর চেষ্টা করছে। আমেরিকানদের ভয়টা হলো, তারা যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটিশ সম্পর্ককে গুরুত্ব দিলেও ইইউ থেকে ব্রিটেন বের হয়ে গেলে তা ব্রিটিশ-ইইউ সম্পর্ককে বিষাক্ত করে ফেলবে এবং ন্যাটোতে আরো জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে।
এখন অনেকেরই মনে নেই যে, ইউরোপিয়ান একীভূতে প্রথম আগ্রহীদের মধ্যে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপিয়ান অর্থনৈতিক একীভূত করার আইডিয়াটি ছিল মার্শাল পরিকল্পনার অংশবিশেষ। আর ইউরোপিয়ানরা প্রথমে ধারণাটি প্রতিরোধ করেছিল। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের মতে, এর ফলে ইউরোপের ছিন্নভিন্ন অর্থনীতি জোরদার করার পাশাপাশি সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে একটি অভিন্ন প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলবে। ইইউর ঐক্যে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখতে চায় না যুক্তরাষ্ট্র, কারণ তার মতে ঐক্যই ন্যাটোকে শক্তিশালী করবে। এটি হয়তো একটা স্বপ্ন, তবে সেই স্বপ্নটা আটলান্টিকের দুই পারের দেশগুলোর। ইউরোপের অর্থনৈতিক সমস্যাবলি নিয়ে কিছু না করতে পেরে যুক্তরাষ্ট্র হতাশ, তবে ক্ষতিটা যাতে কম হয় সে চেষ্টা সে করতে চায়। আর এ কারণেই সে চায় না ইইউ ত্যাগ করুক ব্রিটেন।
যুক্তরাষ্ট্র চাক বা না-চাক, ইইউর বিভক্তিটা সত্যিকারের বিষয়। উদাহরণ হিসেবে ব্যাংকিং বিধিনিষেধ এবং ব্যাংকিং ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ নিয়ে জার্মানি ও ইতালির জাতীয় স্বার্থের মধ্যকার ভিন্নমতের কথা বলা যায়। আমার দৃষ্টিতে ন্যাটো একটি সামরিক জোট, আর সামরিক জোটের অবশ্যই একটি সামরিক বাহিনী থাকতে হবে। অনেক ইউরোপিয়ান দেশের বড় ধরনের কোনো সেনাবাহিনী নেই। তাদের আছে কেবল সামরিক অঙ্গভঙ্গি। দ্বিতীয়ত, সামরিক জোটের একটি মিশনের দরকার। স্নায়ুযুদ্ধের সময় তেমন একটা ছিল। বর্তমানে অনেক সম্ভাব্য মিশন থাকলেও সেগুলোকে মোকাবেলার অনেক উপায় রয়েছে। এটা সামরিক জোটের ভিত্তি হতে পারে না। কারণ প্রতিটি কাজ অবশ্যই থাকতে হবে রাজনৈতিক কমিটির হাতে এবং তারা কী করবে, তা নিয়ে কোনো পূর্বাভাসই নেই। মিশনের জটিলতা এবং জোটের মধ্যে বিভক্তি সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় বাধার সৃষ্টি করে।
যুক্তরাষ্ট্র ধরে নিয়েছে, ট্রান্স-আটলান্টিক জোট এসব সমস্যা কাটাতে পারবে। তবে এখন তারা বুঝতে পারছে, যেকোনো মিশন সহজে সম্পন্ন করার কোনো ঐকমত্য নেই। ব্রিটেনকে ইইউর মধ্যে রাখার দিকে নজর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আসলে ইউনিয়নের আবেগপূর্ণ সমর্থকদের নমনীয় রাখছে। এটা কৌতূহলপূর্ণ কৌশল। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কযুক্ত দেশগুলো মতানৈক্য থেকে তাচ্ছিল্য প্রদর্শনসহ নানা মতে রয়েছে। এটা কাজ করবে কি না তা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। ব্রিটেনের সম্ভাব্য প্রস্থান মানে ন্যাটোর পতন বোঝাবে কি না তা নিয়ে আমার সংশয় আছে। আমার বিশ্বাস, ইতোমধ্যেই এতটাই পতন হয়ে গেছে যে, ফেরার আর কোনো পথ নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্র সম্বলহীন নয় এবং ন্যাটোকে রক্ষার ওয়াশিংটনের চেষ্টার একটা দাম আছে। আটলান্টিকের উভয় পারেই মিত্র আছে, তবে সবাই ইইউ’র সদস্য নয়। প্রতিটি ইস্যুর সাথে জোটের পালাবদল ঘটে। ন্যাটোর কাঠামোতে গভীর বিভক্তির সৃষ্টি না হলে পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে যায়নি।
আমেরিকান ভয় হলো, আমেরিকান কৌশল নির্ধারণকারী ট্রান্স-আটলান্টিক সম্পর্ক ইউরোপিয়ান চাপে ধসে পড়বে। জোটের স্বার্থ একই থাকলে সম্পর্কও অটুট থাকবে। তবে এ জন্য ইউরোপের নানা মত কার্যকরভাবে মোকাবেলা করতে পারার মতো আরো গতিশীল কাঠামো থাকতে হবে। –মূল : জর্জ ফ্রিডম্যান , অনুবাদ : আসিফ হাসান, জিওপলিটিক্যাল ফিউচার্স থেকে