ইসলামী মূল্যবোধের অভাব ও মানবিক বিপর্যয়ে নৃশংসতা বাড়ছেই

নাছির উদ্দিন শোয়েব: ইসলামী মূল্যবোধের অভাব ও মানবিক বিপর্যয়ে নৃশংসতা এবং ভয়ঙ্কর অপরাধমূলক কর্মকা- ঘটেই চলছে। অপরাধের ধরন ও বিবরণ অবিশ্বাস্য মনে হলেও বাস্তবে এধরনের ঘটনা এখন অহরহ ঘটছে। একটি শেষ না হতেই ঘটছে আরেকটি। একটির তদন্ত শেষ না হতেই আরেকটি চাঞ্চল্যকর-নৃশংস ঘটনা ঘটছে যা সমাজে মহামারির মতো রূপ নিচ্ছে। ভাবিয়ে তুলছে অভিজ্ঞমহল ও সমাজ চিন্তকদের। ঘটনা তদন্তে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের। কিন্তু এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা তোড়জোড় চালালেও নৃশংসতা যেন থামতে পারছে না।
মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত দেড় মাসে ৪৫ শিশু হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে। চলতি মাসের ফেব্রুয়ারির ১৭ দিনেই হত্যাকাণ্ডে শিকার হয়েছে অন্তত ১৪ শিশু। গত মাসে এই সংখ্যা ছিল ২৯।
এদিকে গতকাল শুক্রবার বাদ জুমা দেশের মসজিদে মসজিদে শিশু হত্যার মতো ও নৃশংস ঘটনা বেড়ে যাওয়া ও সমাজে নৈতিক অবক্ষায় ঘটনায় এ থেকে মুক্তি চেয়ে মহান আল্লাহর কাছে মোনাজাত করা হয়েছে। বিভিন্ন মসজিদে এ ধরণের দোওয়া চাওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসলামী মূল্যবোধের অভাব, মানবিক অবক্ষয়, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ন্যায় বিচারের অভাবে এধরণের জঘন্য ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে । সমাজ থেকে মূল্যবোধ দিনদিন লোপ পাচ্ছে। ধর্মীয় অনুভূতি ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। ন্যায়বিচারের মানদ-ে আস্থাহীনতা সৃষ্টি ও ধরাকে সরাজ্ঞান করার প্রতিযোগিতায় পরিস্থিতি ক্রমে খারাপ হচ্ছে। এছাড়াও পারিবারিক কলহের জের, চিন্তাশক্তিতে অনৈতিকতার মিশ্রণ ঘটায় একের পর এক নৃশংস হত্যার ঘটনা ঘটছে ।
আর এর ফলেই পৃথিবর সবচেয়ে আপনজন মায়ের কাছেও সন্তানরা হয়ে ওঠছে অনিরাপদ। প্রিয় মায়ের কোলও যেনো এখন মৃত্যুকূপ। মায়ের আঁচলে থাকা সন্তানের নির্মম মৃত্যু হতে হচ্ছে মায়ের হাতেই। কখনো কখনো সন্তানের হাতেও খুন হচ্ছে প্রিয় মা-বাবা। গর্ভধারিনী মা তার ফটুফটে নবজাতককে হত্যার উদ্দেশ্যে কোল থেকে ছুড়ে মেরে ফেলে দেয় পাঁচ তলা থেকে। নবজাতক সন্তানকে ঠেলে হয় কুকুরের মুখে। ফেলে দেয়া হয় ডাস্টবিনে। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, এসবই সামাজিক-মানবিক পর্যয়। অদূর ভবিষ্যতে এর পরিণতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. জিয়া রহমান বলেন, পুরনো মূল্যবোধের সাথে বর্তমানের আধুনিক চিন্তা-ভাবনা সাংঘর্ষিক হচ্ছে। মানুষ নানা ধরনের অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে তার মাঝে হিতাহিত জ্ঞান লোপ পাচ্ছে। মানুষের মাঝে কোমলতা কমে যাওয়ায় সমাজে অপরাধের মাত্রা বাড়ছে বলার পাশাপাশি আইনের পর্যাপ্ত প্রয়োগ নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ড. জিয়া রহমান বলেন, মানুষের মাঝে দূরত্ব দূর করতে হবে। সামাজিক মূল্যবোধের জায়গা তৈরি করতে হবে। সামাজিক বন্ধনগুলোকে শক্ত করার চেষ্টা করতে হবে। একের প্রতি অন্যের ভালোবাসা, মতামতের মূল্যায়ন আর বস্তুতান্ত্রিক চেতনা থেকে বেরিয়ে উদারনীতিই পারে সমাজের এই অসংগতি কমাতে এমনটাই পরামর্শ সমাজবিদদের।
সমাজ বিশ্লেষকদের মতে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া লুটপাট, ক্ষমতার অপব্যবহারের পাশাপাশি আমাদের সমাজে দ্রুত কিছু পরিবর্তন ঘটে গেছে যা আমাদের ধারণক্ষমতার সাথে মানানসই ছিল না। একদিকে রাতারাতি অর্থনৈতিক উন্নতি, দ্রুত প্রযুক্তির বিকাশ, আকাশ সংস্কৃতির জোয়ার, নগরায়নএবং এর বিপরীতে সমান তালে বাড়ছে শোষন, বৈষম্য। যেভাবে বস্তগত উন্নতির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে সে তুলনায় নৈতিক উন্নতির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি।
রাজধানীর বনশ্রীতে ভাইবোন অরণী ও আলভী হত্যার কথা স্বীকার করেছে মা মাহফুজা। হত্যার দায় স্বীকার করলেও ইতোমধ্যে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গতকাল শুক্রবার পাঁচ দিনের রিমান্ডে এনেছে পুলিশ। এর একদিন পরই (বৃহস্পতিবার) সিলেটে এক বৃদ্ধ বাবাকে হত্যার অভিযোগ ওঠছে তারই দুই ছেলের বিরুদ্ধে। এরআগে যশোরের অভয়নগরে তিন মাসের এক শিশুর মুখে কীটনাশক ঢেলে দিয়ে হত্যা করেছে তার বাবা। পরপর চার মেয়ে সন্তান জন্মের পর পঞ্চম সন্তানও কন্যা হওয়ায় তা মেনে নিতে না পেরে এ হত্যার ঘটনা ঘটায় বাবা। নিষ্ঠুরতার যেন কোনো শেষ নেই। কখনো ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও ধর্ষণ শেষে হত্যা ছড়িয়ে পড়ছে মহামারি আকারে। আবার বর্তমানে ঘটে চলেছে একের পর এক লোমহর্ষক শিশু হত্যার ঘটনা।
মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত দেড় মাসে ৪৫ শিশু হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে। প্রতিবেদনে গত সোমবার উল্লেখ করা হয়েছে, অপরাধীরা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নিষ্পাপ শিশুদের সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে। শিশুহত্যার মতো ঘৃণিত অপরাধে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় শিশু হত্যার ঘটনা ক্রমশই বাড়ছে। চলতি মাসের ফেব্রুয়ারির প্রথম ১৭ দিনেই হত্যাকান্ডে শিকার হয়েছে অন্তত ১৪ শিশু। গত মাসে এই সংখ্যা ছিল ২৯। আর গত দেড় মাসে হত্যা করা হয়েছে ৪৫ শিশুকে। দেশে একের পর এক এই শিশু হত্যার ঘটনা অতীতের যেকোনো সময়কে হার মানিয়েছে। দেশে সম্প্রতি শিশু হত্যা ও অপহরণের ঘটনায় মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেইসঙ্গে এ ঘটনায় তীব্র ক্ষোভও প্রকাশ করেছে সংগঠনটি।
এদিকে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনরে প্রতিবেদনে দেশের হত্যাকন্ড বৃদ্ধি সম্পর্কে বলা হয়েছে, এ ধরনের হত্যাকাণ্ড অবশ্যই আইন শৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতি। কমিশন এই হত্যাকান্ডের হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গতিশীল কার্যক্রমের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ড কমিয়ে শুণ্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব। বাংলাদেশের গণতন্ত্র ব্যবস্থাপনাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান এবং মানবাধিকার সম্মত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে অবশ্যই সর্বস্তরে আইনের শাষণ প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবলমাত্র এ ধরণের ক্রমবর্ধমান হত্যাকাণ্ড হ্রাস করা সম্ভব। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, যৌতুকের কারণে হত্যা ৪, পারিবারিক সহিংসতায় ১৭, সামাজিক সহিংসতায় ৪৭, রাজনৈতিক কারণে ২, আইন শৃংখলা বাহিনীর হাতে ১২, বিএসএফ কর্তৃক ৪, চিকিৎসকের অবহেলায় মৃত্যু ১, গুপ্ত হত্য ১৫, রহস্যজনক মৃত্যু ৭৪, ধর্ষণের পর ৪, অপহরণের পর ৪ জন হত্যা করা হয়। এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনায় ১৭৩, আত্মহত্যা ২২ জন।
জানা গেছে, সিলেটের হবিগঞ্জে বৃদ্ধ বাবাকে গলা টিপে হত্যার অভিযোগ উঠেছে দুই ছেলের বিরুদ্ধে। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে শহরের মাহমুদাবাদে এ ঘটনা ঘটে। নিহত ব্যক্তির নাম কিতাব আলী (৭০)। তিনি হবিগঞ্জ শহরের মাহমুদাবাদ এলাকায় থাকতেন। কিতাব আলীর ছোট ভাই বিলাত মিয়া বলেন, নিহতের ছেলে জুনায়েদ মিয়া ওরফে জুয়েল ও আল-আমিন সম্পত্তির লোভে তার বাবাকে হত্যা করে আমাদের না জানিয়ে লাশ দাফনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সংবাদ পেয়ে আমরা এ বিষয়টি পুলিশকে জানাই। নিহত কিতাব আলীর বোন পুতুল বেগম অভিযোগ করেন, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে তিনি তার ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পান। কিন্তু কিতাব আলীর ছেলে-মেয়েরা তার ভাই বোনসহ অন্য আত্মীয়স্বজনদের কোনো খবর না দিয়ে তাড়াতাড়ি করে লাশ দাফনের প্রস্তুতি নেয়। এরই মধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে নিহতের ছোট ভাই বিলাত মিয়া, বোন জমিলা বেগম ও পুতুল বেগম তাদের ভাই কিতাব আলীর মৃত্যুর খবর পেয়ে রাত ১০টায় দিকে তার বাসায় যান। এ সময় তারা কিতাব আলীর গলায় আঘাতের চিহ্ন দেখতে পান। এতে তাদের সন্দেহ হয়, সন্তানরা কিতাব আলীকে হত্যা করেছে।
গত ১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর রমনায় ১৫ বছর বয়সী কুমারী কাজের মেয়ে বিউটি তার সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুকে চারতলা থেকে ছুড়ে ফেলেছে রাস্তায়। কয়েক মাস আগে সাভার এলাকায় এক পাষন্ড বাবা হাসপাতালের ছাদ থেকে ছুড়ে ফেলে হত্যা করে সদ্যজাত শিশুকে। পাবনার ইশ্বরদীতে স্বামীর পরকীয়াজনিত কারণে কলহের জের ধরে দুই শিশু সন্তানের মুখে বিষ ঢেলে দিয়ে মা পাপিয়া সুলতানা (৩০) আত্মহত্যা করেছেন। ১৩ মাস বয়সের শিশু সন্তান জীবন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে। আরেক শিশু সন্তান ইমন’র অবস্থাও আশঙ্কাজনক। ১২ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে জেলার মুলাডুলি ইউনিয়নের বহরপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। গত ডিসেম্বরে নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলায় দেশীবাড়ি আশ্রয়ন প্রকল্পে দুই কন্যা শিশু সন্তানকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর মা ফেন্সি বেগম (৩০) গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি বুধবার রাতে পিরোজপুর শহরের সিআইপাড়া মোলা বাড়িতে এ ঘটনা ঘটেছে।
২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট রাতে রাজধানীর চামেলিবাগের চামেলি ম্যানশন-২ এর ৬ তলার ৫-বি ফ্যাটের নিজ বাসায় খুন হন পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান (৪৫) এবং তার স্ত্রী স্বপ্না রহমান (৪২)। পর দিন ১৫ আগস্ট সকালে তাদের এক মাত্র কন্যা ঐশী রহমান, ভাই অহি এবং কাজের মেয়ে সুমীকে নিয়ে সে বের হয়ে যায়। এরপর আস্তে আস্তে বিষয়টি জানাজানি হলে ১৬ আগস্ট সন্ধ্যার পরে পুলিশ ওই বাসার তালা ভেঙে লাশ দুইটি উদ্ধার করে। ঘটনার ব্যাপারে ঐশীর চাচা মশিহুর রহমান বাদী হয়ে থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। এ মামলায় ঐশীর ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button