পর্বতের ভাঁজে ভাঁজে অলৌকিকতার সন্ধান
শুষ্ক বিস্কুট রঙের পাহাড় ঘেরা পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর কোয়েটায় রয়েছে একটি অপ্রত্যাশিত ধনভাণ্ডার। মৌচাকের মত দেখতে ছোট খোপের টানেলগুলো পরিপূর্ণ হয়ে আছে বাক্স ভর্তি কুরআনে। এখানে পুরাতন পাণ্ডুলিপিগুলোকে একত্র করা হয় যাতে গ্রন্থগুলোকে অপবিত্রতা, অমর্যাদা থেকে রক্ষা করা যায়।
‘জাবালে নূর’ বা ‘আলোর পাহাড়’ নামে পরিচিত এ পাহাড়টি দেখতে হাজার হাজার দর্শনার্থী আসেন তখন থেকে যখন দু’ভাইয়ের চেষ্টায় এ জায়গাটি পবিত্র গ্রন্থের আবাসে পরিণত হয়। এটির রক্ষণাবেক্ষণকারীরা বলেন এখানে এমন কিছু কুরআনের কপি রয়েছে যেগুলো ৬০০ বছরেরও বেশি পুরোনো।
জাবালে নূরের পরিচালক হাজী মুজাফফর আলী বলেন, ‘আমরা কমপক্ষে ৫০ লাখেরও বেশি কুরআনের কপি এখানে সমাহিত করেছি।’
কিন্তু পাহাড়ের নিচে থাকা টানেলগুলোর ধারণ ক্ষমতা আস্তে আস্তে কমে আসছে। পবিত্র গ্রন্থের শতশত বস্তা বন্দী কপিগুলোকে এখন পাহাড়ের গা ঘেঁষে শায়িত করে রাখা হয়েছে। এর কারণ রক্ষণাবেক্ষণকারীরা পর্যাপ্ত যায়গার ব্যবস্থা করতে হিমশিম খাচ্ছেন। পুরো পাকিস্তানেরই কুরআনের প্রতি কোনো অসম্মানকে ব্লাসফেমি বা ধর্ম অবমাননা হিসেবে ধরা হয়, যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
মুসলিমদের বিশ্বাস ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ কুরআন স্রষ্টার বাণী যা নবী মুহাম্মদ (স:)-এর মাধ্যমে মানুষের কল্যাণে প্রেরণ করা হয়েছে। এ কারণে এই বাণীগুলো পবিত্র। এরফলে মুসলিমরা তাদের পুরাতন কুরআনগুলোকে খুবই সম্মানের সাথে ধ্বংস করে।
ধর্মীয় আলেমরা দুটি মাধ্যমে তা ধ্বংস করার অনুমতি দিয়েছেন। প্রথমত, কাপড়ের মধ্যে পেচিয়ে আগুনে পুড়ে ফেলা যা জাবালে নূরে করা হয়। দ্বিতীয়ত, কোনো প্রবাহমান পানিতে ভাসিয়ে দেয়া যাতে তার কালিগুলো এক পর্যায়ে পৃষ্ঠা থেকে ধুয়ে যায়। তবে পাহাড়ের পিছনের মানুষটি, ৭৭ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ ব্যবসায়ী আব্দুল সামাদ লেহিরির কাছে একটা সমাধান রয়েছে। যা কিনা ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিবর্তনমূলক, তাহলো পাকিস্তানে প্রথম কোনো কুরআন পুনঃব্যবহার্য কারখানা (রিসাইকেল) স্থাপন করা। তবে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করলে লেহিরির এই পবিত্র স্থান তখন হামলার শিকার হতে পারে।
২০১১ সালে আফগানিস্তানে ১০০০ ক্ষুব্ধ বিক্ষোভকারী কুরআন থেকে টয়লেট পেপার বানানোর অভিযোগে একটা পেপারমিলকে আংশিকভাবে ধ্বংস করেছিল। ২০১৫ সালের নবেম্বরে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশেও এক ক্ষুব্ধ হামলাকারী একটি কারখানায় আগুন দিয়েছিল বয়লারে কুরআন পোড়ানোর অভিযোগের ভিত্তিতে। তবে বিস্ময়করভাবে পাকিস্তানের ধর্মীয় আলেমরা বলছেন, এ কাজ করা যেতে পারে।
পাকিস্তানের ওলামা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান তাহির মেহমুদ আশরাফি বলেন, ‘আলেমরা কুরআন রিসাইকেল করার অনুমতি দিবেন যদি সেই রিসাইকেলিং কারখানাটি কুরআনের পৃষ্ঠাগুলোকে কোনো ক্ষতিকারক কাজে ব্যবহার করবে না এমন নিশ্চয়তা দিতে পারে।’
শীর্ষ স্থানীয় আলেম মুনিবুর রেহমান বলেন, ‘কুরআনের লেখাগুলোকে মুছে কাগজগুলোকে আবার কোনো ইসলামী শিক্ষার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে যেমন সে কাগজ থেকে কোনো কার্ডবোর্ড তৈরি করা অথবা এ জাতীয় কোনো কাজ।’ পাঞ্জাব কুরআন বোর্ডের সেক্রেটারি ইরফান কাদির বলেন, ‘পাকিস্তানে বর্তমান রিসাইকেল কারখানাগুলো কুরআন রিসাইকেলের কাজ করতে পারে না। কারণ এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে- যেমন, এ কাজে শুধু মুসলিমরাই অংশগ্রহণ করতে পারবে।’ লেহেরির কুরআনের বাণী রক্ষার এই আগ্রহ জন্মায় ১৯৫৬ সালে। তিনি এ সাক্ষাতকার দিচ্ছিলেন কোয়েটার নিজ বাসায়। তার চারপাশ ছিল ঔষধ এবং সংবাদপত্রে ঘেরা। তিনি একটি পত্রিকা নেন যেটাতে কাবা ঘরের একটা ছবি ছিল, এটা তার এক বন্ধুর গাড়ির মেঝেতে পড়া অবস্থায় পেয়েছেন। তিনি সেটা তুলে নেন এবং তখন থেকেই তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে আজীবন তিনি পবিত্র সব ছবি এবং বাণী গুলোর রক্ষণাবেক্ষণে কাজ করে যাবেন।
১৯৯২ সালে তিনি এবং তার ভাই আব্দুর রশিদ কোয়েটার পাহাড়ি এলাকায় ইজারা নিয়ে পাথর ভাঙ্গার ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু তারা দেখলেন ইজারাকৃত সম্পত্তির খুব অল্প জায়গাই ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহৃত হয়। তখন তিনি বলেন, ‘আমি এ পাহাড়টিকে কুরআনের পাণ্ডুলিপি সমাহিত করার কাজে ব্যবহার করবো।’
জাবালে নূরে তীর্থ যাত্রীদের পদচারণা বাড়তে থাকে, তাদের অনেকেই টানেলের গায়ে বিভিন্ন রকম কথা খোদাই করে লিখে যান, বেশিরভাগই দোয়া প্রার্থনার। একজনের আবেদন, ‘হে আল্লাহ, আমাকে আমার পছন্দের কাউকে বিবাহ করার সুযোগ দাও।’ আরেকজনের আবেদন আবার খুবই নিদির্ষ্ট, ‘হে আল্লাহ তুমি আমেনার বিবাহ ভেঙ্গে দাও এবং হামজা থেকে তাকে উদ্ধার কর।’
জাবালে নূরের রক্ষণাবেক্ষণকারীরা এখন অলৌকিক কিছুর প্রার্থনা করছেন। লেহেরি বলেন, ‘রিসাইকেল কারখানা গড়তে আমি আমার ধনী বন্ধুদের কাছে কিছু আর্থিক সাহায্য চেয়েছি।’ ‘তারা নীতিগতভাবে রাজি হয়েছেন, তবে এখন তারা কেউ সারা দিচ্ছেন না।’