ইসলামী চিন্তাবিদ হাসান তুরাবি আর নেই
সুদানের মূল ধারার ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতা, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ বহু ভাষাবিদ ও ইসলামী চিন্তাবিদ ড: হাসান আব্দুল্লাহ আল-তুরাবি আর নেই। গত শনিবার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সুদানের রাজধানী খার্তুমের রয়েল কেয়ার হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। গত শনিবার সকালে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সমাপ্ত হয় তার দীর্ঘ ৪০ বছরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের।
১৯৩২ সালে সুদানের ওয়াদ আল-তুরাবি শহরে জন্মগ্রহণ করেন ইসলামী আন্দোলনের এই প্রাণপুরুষ। যিনি ১৯৯৯ সাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পপুলার কংগ্রেস পার্টির সেক্রটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করনে। তিনি ১৯৯৬ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদের স্পীকার ছিলেন। এর আগে ১৯৮৯ সালে এক বছর সুদানের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত সুদানের এটর্নী জেনারেল হিসেবেও যোগ্যতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ন্যাশনাল ইসলামীক ফ্রন্টের সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন ড. তুরাবী।
১৯৩২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি কাসালা এ্যাবলো ইজিপশিয়ান সুদানে তার জন্ম এবং ২০১৬ সালের ৫ মার্চ সুদানের খার্তুমে তার ইন্তিকালের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটে তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের। এছাড়াও তিনি ১৯৯৬ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টি এবং ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত সুদানিস সোশ্যালিস্ট ইউনিয়নের সাথে যুক্ত ছিলেন। হাসান তুরাবির পিতা ছিলেন, ইসলামী আদালতের একজন বিচারক, খার্তুম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয় ডিগ্রি অর্জনের পর তুরাবী ইউরোপে লেখাপড়ার জন্য মনোনীত হন। এরপর ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে আইন বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন অতপর প্যারিসের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয় ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি সুদানে প্রত্যাবর্তন করেন এবং দেশে নেতৃস্থানীয় ইসলামীক আইন বিশারদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি খার্তুম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। হাসান তুরাবি ছিলেন একাধারে সুদানের ইসলামী রাজনীতিক ও অধ্যাত্মিক নেতা। সুদানের আধুনিক রাজনৈতিক অঙ্গনের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। তিনি সুদানের উত্তরাঞ্চলে ইসলামিক শরিয়া আইনের প্রচলন করেন। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের অধিকারী তুরাবিকে বিভিন্ন সময় কারাবরণ করতেও হয়েছে।
এক সময় সুদানের প্রেসিডেন্ট বশিরের সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু ১৯৮৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন বশির। এরপর থেকেই তিনি বশির সরকারের বিরোধিতা শুরু করেন। প্রেসিডেন্ট বশিরের দীর্ঘ শাসনামলে তিনিই ছিলেন তার প্রধান সমালোচক। তিউনিশিয়ার আদলে দেশে একটি রাজনৈতিক বিপ্লবেরও স্বপ্ন দেখেছিলেন এই নেতা।
সুদানে নির্বাচনের পরপরই ২০১০ সালের মে মাসে তাকে গ্রেফতার করা হয়। নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগে তাকে আটক করেছিল সুদান সরকার। সামরিক অভ্যুত্থানের দীর্ঘ দুই যুগ পর দেশে প্রথমবারের মতো ওই নির্বাচন হয়। নিজের দীর্ঘ চল্লিশ বছরের রাজনৈতিক জীবনে আরো বেশ কয়েকবার কারাবন্দী হতে হয়েছিল তুরাবিকে। ২০০৯ সালেও একবার তাকে আটক করা হয়েছিল।
তখন যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে প্রেসিডেন্ট বশিরের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত। দারফুরে গণহত্যার ঘটনায় বশিরকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করেছিল আদালত। তুরাবি ছিলেন সুদানের একমাত্র রাজনৈতিক নেতা যিনি ওই গ্রেফতারি পরোয়ানাকে সমর্থন করেছিলেন। অবশ্য নিজের ওই কর্মকান্ডের জন্য তাকে মাসুল দিতে হয়েছে। এ ঘটনার দুদিন পরই ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে তাকে গ্রেফতার করেছিল সরকার।
এক সময়ের বন্ধু বশিরের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার পর তিনি নিজের দল ‘পপুলার কংগ্রেস পার্টি’ গড়ে তুলেছিলেন।
উচ্চশিক্ষিত তুরাবির ইংরেজি, ফারসি, জার্মান ও আরবি ভাষায় সমান দক্ষতা ছিল। ভাষাগত পান্ডিত্যের কারণেই বিদেশী সংবাদ মাধ্যমগুলোতে তার কদর ছিল।
হাসান তুরাবী মুসলিম বিশ্বের একজন রাহবার ছিলেন- মাওলানা মুহিউদ্দীন খান: সুদানের মূল ধারার ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতা, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ বহু ভাষাবিদ ও ইসলামী চিন্তাবিদ ড: হাসান আব্দুল্লাহ আল-তুরাবীকে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম রাহবার হিসেবে উল্লেখ করলেন বাংলাদেশের শীর্ষ আলেম ও রাবেতা আলম আল ইসলামীর সদস্য, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র সহসভাপতি, মাসিক মদীনা সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান।
তিনি তুরাবীকে বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, তাঁর মৃত্যুতে যে ইসলামী আন্দোেনের ময়দানে যে শুন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা সহজে পুরন হওয়ার নয়। একেএকে সবাই চলে যাচ্ছেন। মুসলিম বিশ্বের সেরা মনীষীগন চলেই যাচ্ছেন। সোমবার বিকেলে গেন্ডারিয়াস্থবাসভবনে পত্রিকায় তুরাবীর মৃত্যুর সংবাদ শুনে তিনি অশ্রুসিক্তহয়ে তুরাবীর সাথে নানা বিষয়ের স্মৃতিচারণ করেন মাওলানা মুহিউদ্দীন খান।