যে রাষ্ট্র সোহাগীদের বাঁচতে দেয় না

Tonuসুমন্দভাষিণী: দুই ভাইয়ের এক বোন ছিল সে। বাবা-মা আদর করে তার নাম রেখেছিল সোহাগী। পুরো নাম সোহাগী জাহান তনু (১৯)। বন্ধুরা তনু নামেই চিনে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের (সম্মান) ছাত্রী এবং একই কলেজের নাট্য সংগঠন ‘ভিক্টোরিয়া কলেজ থিয়েটারের (ভিসিটি) সদস্য ছিল এই তনু। এখন আর নেই। সে গত রোববার রাতে লাশ হয়ে গেছে। একটি স্বপ্নে বিভোর মেয়েকে ছিঁড়ে-ছুবড়ে খেয়ে ফেলেছে এই রাষ্ট্র।
হ্যাঁ, আমি রাষ্ট্রই বলবো। কারণ যে রাষ্ট্র সাধারণের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, একের পর এক দুর্নীতি, অবিচার-অনাচার-অত্যাচার-নির্যাতনের সংস্কৃতির ধারক-বাহক হয়, তখন এসব কিছুর জন্য রাষ্ট্রকেই দায়ী করবো আমি।
এ কোন রাষ্ট্রের অধীনে আছি আমরা? যেখানে হাজার-কোটি টাকা লোপাট হয়ে যায়, অথচ নিজেদের ডিজিটাল ডিজিটাল বলে গলা ফাটাই, এ কোন রাষ্ট্র, যেখানে সরকার প্রধান পরিবেশ পদক নিয়ে এসে সুন্দরবন ধ্বংসে নৃত্যগীত শুরু করেন, এ কোন রাষ্ট্র, যেখানে শুধুমাত্র একটি ধর্মেরই অনুভূতি টনটনে হয়, অন্যধর্মের মানুষ লাইন ধরে কাঁটাতারের বেড়ার দিকে, প্রকাশ্যে ফেসবুকে ক্রিকেট খেলা নিয়ে ক্ষোভ থেকে হিন্দুদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার, হিন্দুদের পুড়িয়ে মারার হুমকি দেয়া হয়, তারপরও কোনো বিচার হয় না? এ কোন রাষ্ট্র আমাদের?
এই অসভ্য-ইতর রাষ্ট্রেই শখ করে লেখাপড়া শিখে মানুষ হতে চেয়েছিল বাবা-মায়ের আদরের সোহাগী মেয়েটি। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে বলে পড়ালেখা চালাতে তাকে টিউশনি করতে হতো। কাকলী তালুকদারের ভাষায় বলতে হয়, ‘ছাত্র পড়িয়ে লেখাপড়া শিখছিলো, জীবনকে চিনবে বলে। সে গত রাতে লুট হয়েছে, মৃত্যু তাকে মুক্তি দিয়েছে! সে হয়ত বাঁচতে চেয়েছিল, তুমি, তোমরা মৃত্যুর কাছে সোহাগীকে পাঠিয়ে দিয়েছো! পাহারা দিয়েছো তার পরিবার যেন আইনের কাছে না যায়”!  তনু হয়তো মৃত্যুর আগে খুব ভালোভাবেই চিনে গেছে মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়ার সুন্দর জীবনটা।
ওর ছবিটার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। পুরো মাথা তার হিজাবে ঢাকা। তবুও রক্ষা পেল না ধর্ষকদের হাত থেকে।
খবর পড়ে যতোটুকু জানা গেল, সোহাগী কুমিল্লার তিতাস উপজেলার বাসিন্দা ইয়ার হোসেনের মেয়ে। ইয়ার হোসেন ময়নামতি সেনানিবাস এলাকায় অলিপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। সেই সুবাদে সোহাগীরা অনেকদিন ধরেই অলিপুর এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করে আসছে।
সেনানিবাসের মতো এমন সুরক্ষিত স্থানে এরকম একটি ঘটনা ঘটিয়ে ধর্ষকরা পার পেয়ে গেল, কেউ টেরও পেল না? শুনলাম, পরিবার যাতে এ ব্যাপারে মুখ না খোলে সেজন্য চাপের মুখে রাখা হয়েছে। আজ মেয়েকে হারিয়ে পরিবার শোক করার চাইতে নিজেদের জীবন নিয়েই হয়তো টানাটানি করছে। মনে পড়ে যাচ্ছে, ওই যে জিহাদ নামের বাচ্চাটা পাইপে পড়ে গিয়েছিল। এটা মিথ্যা প্রমাণের জন্য জিহাদের বাবাকে ওরকম একটা কষ্টের সময় ধরে নিয়ে জেরার মুখে ফেলেছিল। এই রাষ্ট্র কী না পারে? ‘রাষ্ট্র সোহাগীর পথে ধর্ষক বসিয়ে রাখে, তাদের আইনই আবার সোহাগীর পরিবারকে এখন ধর্ষণ করবে!
তনুর এক পরিচিত বড় ভাই ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মাকে বলে গিয়েছিলো, মা, টেইলারের কাছ থেকে আমার নতুন জামাটা আজ নিয়ে আইসো, আমি কাল নতুন জামা পরে কলেজ যাবো। সেই কাল আর আসলো না ওর জীবনে। ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে প্রথমে খোঁজ নেয়া হয় যে বাসায় টিউশনি করে সেখানে। তারা জানায়, সাড়ে সাতটাতেই বেরিয়ে গেছে তনু। ফোনটাও বন্ধ পাওয়া যায়। বাবা তখন মেয়েকে খুঁজতে গিয়ে দেখেন, ময়নামতি সেনানিবাসের অলিপুর এলাকায় একটি কালভার্টের কাছে তার মেয়ের মাথার চুল পড়ে আছে, তার একটু সামনেই পড়ে আছে জুতা , তার একটু দূরে মোবাইলটা, আর একটু দূরে তনুর লাশ। বাবা চিৎকার করে বলল মা, মা, মা, মা আমার।’
একজন লিখেছেন, সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে নাটক, নৃত্য ও আবৃত্তিতে জড়িত ছিলো সে । বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থিয়েটারের সে ছিল একজন নিয়মিত সদস্য । আর তার সাথেই কিনা ঘটে গেলো এমন দুঃখজনক এক ঘটনা । তনুর পরিবার মামলা করেছে, কিন্তু পরিবারের সদস্যদের নানাভাবে মিডিয়া থেকে দূরে রাখা হচ্ছে ।
বিচারহীনতার সংস্কৃতির এই দেশে বিচার তো আমরা সকল সময়েই চেয়ে থাকি, তবু বিচার পাই না। স্বাভাবিক মৃত্যু বা গুম-অপহরণ ঘটনারই যেখানে বিচার হয় না, সেইখানে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে এমন ঘটনার বিচার কতটুকু হবে তা আসলেই দেখার বিষয়।
তনুর খবরটা পড়েই সকাল থেকে মনটা বিষন্ন হয়েছিল। তখনই খবর এলো, খাগড়াছড়িতে এক নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। পাহাড়ে এটা তো নৈমিত্তিক ঘটনা, এ নিয়ে আমাদের চেতনায় আঘাত লাগে না। ফরিদপুরে এক সংখ্যালঘু স্কুলশিক্ষিকাকে অপহরণ করে মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছে। ঘটনার বিশদ জানি না। হয়তো জায়গা-জমিই এই অপহরণের পিছনের মূল কারণ হবে। অন্তত বর্তমান সময়ে যা যা ঘটছে দেশে, তাতে এটাই অনুমিত হয়।
মানুষও আজ নির্লিপ্ত হতে শিখে গেছে। সব চলছে নিয়মমতোই, আমরাও তাই। তাই কোন দু:খ, কোনো ঘটনা আমাদের আর স্পর্শ করে না। মলিনা রায় যেমন লিখেছেন, আমি ভালো আছি কেননা, জোহা আমার ভাই না, আদিবাসী নারী আমার বোন না, আমার ভাই ত্রিুকেট খেলে না আর স্কুল শিক্ষিকাকে আমি চিনিনা ——-তাই দেশে যাই হোক না কেন আমার তো কিছু আসে যায় না।
‘বাঙালীর কিছুই কি আছে আর অবশিষ্ট’?

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button