নববর্ষ : নতুন দিনের উদয় না অস্তাচল?
সুমাইয়া হাবীবা: ঝলমলে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের বারতা নিয়েই বৈশাখ আসে। কিন্তু বর্তমানে কেবল ছাপার অক্ষরেই কিংবা চিত্রীর চিত্রতেই আসে। বাস্তবে বৈশাখ এখন শুধুই বাণিজ্য। বছরের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য মূলত নববর্ষের আবরণেই হয়ে থাকে। শুরুতে কেবল মেলা। তারপর দুর্গাভক্তের সিম্বল লালপেড়ে সাদা শাড়ি, টিপ, মঙ্গল প্রদীপ, শোভাযাত্রা সংযোজন। একে একে দেব-দেবী, লক্ষ্ণী-অলক্ষ্ণী, অসুর-মহীষাসুর সবাই উপস্থিত। লিস্ট অনেক বড়। বহু লেখালেখি হয়েছে। ব্যঙ্গও হয়েছে। কিন্তু নিট রেজাল্ট হলো মত্ত বাঙালির সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে চেতনা ব্যবসায়ীর ব্যবসা। বাড়তেই হবে।
ক্ষয়ে যাওয়া ঈমানের জৌলুশ ফেরাতে যে শিরিষ কাগজের প্রয়োজন তার বড় অভাব। কালেভদ্রে সেটি মিললেও ঘর্ষণের উপযোগী বলিষ্ঠ হাতের আকাল। বাঙালি এমনিতেই অপুষ্ট। আমি ব্যবসায়ী, আমি উঠতি মডেল, আমি ফ্যাশন ডিজাইনার, আমি শিল্পী, আমি ফেরিওয়ালা, আমি লেখক। আমি সফলতা চাই, ইনকাম চাই। আমি কেন তাহলে ছেড়ে দেবো এত বড় সুযোগ আর বাঙালির উৎসবপ্রিয়। তাহলে দোষটা কোথায় অর্থাৎ, নববর্ষ বর্তমানে নিছক একটি ব্যবসায়িক উদ্যোগে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রত্যেকে তার নিজস্ব লাভ-ক্ষতির বিবেচনায় নববর্ষকে ব্যবহার করছেন। এটির নবজন্ম মূলত ব্যবসায়িকই ছিল। এবং তা হয় সম্রাট আকবরের সময়ে বাংলা সন প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে। সম্রাট অকবর এটিকে সার্বজনীন রূপ দিয়েছিলেন শুধু এবং শুধু ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যেই। ফল-ফসলের উৎপাদন এবং তার বার্ষিক খাজনা আদায়ের হিসাব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার একটি সহজ উপায় হিসেবে। মাঝে বহু যুগ কেটে যাওয়ার পর বর্তমানকালে আবার বাংলা নববর্ষকে একটি সার্বজনীন রূপ দেয়া হচ্ছে। এ দেশের মানুষ সত্যিকার ধর্মপ্রাণ। তাদের মধ্যে নিজস্ব ধর্মপরায়ণতা এবং অপর ধর্মের প্রতি সহনশীলতা ও শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে। এটি বাঙালির একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। নববর্ষে মুসলিমদের অংশগ্রহণ মেহমানসুলভ ছিল। ভালো খাবার বিনিময়ের মাধ্যমে অনেকটা। সেটা আমি মনে করি তাদের শ্রদ্ধাবোধ থেকেই। যেমনটা আগেরকালে দেখা যেত ঈদের দিন হিন্দুরাও গ্রামের মুসলমানদের বাড়িতে বেড়াতে যেত এবং মুসলমান বাড়ি থেকেও ঈদ উপলক্ষে রান্না হওয়া ভালো-মন্দ খাবার হিন্দু প্রতিবেশীর বাড়িতে যেত। হিন্দু প্রতিবেশীরা তাদের পূজা-আচার নিজেদের মতো করে নিজেরাই পালন করতেন। অর্থাৎ, সে সময়ে তারা জানত বাংলা নববর্ষ মুসলিমদের জনজীবনে আলাদা কোনো প্রভাব বা ভূমিকা রাখে না এবং এটি হিন্দুদেরই একটি পূজা উৎসব হিসেবেই প্রচলিত ছিল। সে কারণেই বোধ করি নববর্ষ মুসলিমদের মধ্যে বিশেষ কোনো জায়গা জুড়ে ছিল না। শুভেচ্ছা জ্ঞাপনেও পরিমিতিবোধ ছিল এবং হিন্দুরাও কখনো মুসলিমদের ওপর তাদের নববর্ষ পূজার আচার চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেনি। দোকানিরা, ব্যবসায়ীরা একটি উৎসবমুখর পরিবেশে হালখাতার সূচনা করতেন। যেমনটা স্কুল-কলেজে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব কিছু আনুষ্ঠানিকতা থাকেই। তবে সেটি শুধু সেই প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। হালখাতাও এর ব্যতিক্রম নয়। যুগ যুগ ধরে এভাবেই প্রচলিত হয়ে এসেছে নববর্ষ।এ দেশের মানুষ সহজ-সরল, ধর্মপরায়ণ। নাস্তিকতা এ দেশের মানুষ কোনোকালেই গ্রহণ করেনি। তাই ১৯৬৪ সালে কয়েকজন ধর্মহীন মানুষের বাংলা নববর্ষ নিয়ে আদিখ্যেতা বাঙালির মনে কোনো প্রভাবই ফেলতে পারেনি। আশির দশক পর্যন্ত এ আদিখ্যেতা ধর্মহীনদের মধ্যেই বিদ্যমান ছিল। এমনকি সাধারণ হিন্দু পরিবারগুলোতেও এর কোনো জাঁকজমকপূর্ণ প্রচলন ছিল না। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছুসংখ্যক শিক্ষিত সংস্কৃতমনা মানুষ এতে সম্পৃক্ত হয়। এটা সম্ভব হয়েছিল আমি যেটা মনে করি তা হলো শিক্ষা, শিল্প-সংস্কৃতির উচ্চ পর্যায়গুলোতে ধর্মহীন মানুষগুলোর একটি শক্তিশালী অবস্থান এবং ধর্মপরায়ণ ইসলামিস্টদের চিন্তাগত সীমাবদ্ধতা ছিল প্রকট। সেটা এমন একটি সময় যখন পুরো পৃথিবীতেই একটি পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। আকাশ সংস্কৃতি ব্যাপক প্রসার লাভ করছিল। গ্লোবালাইজেশনের পাঠ চলছিল। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই নতুন নতুন দিক উন্মোচিত হচ্ছিল। খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছিল বিশ্ব। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। পরিবর্তন বাংলাদেশকেও ডাকছিল। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মও পরিবর্তনকে বরণ করার জন্য প্রস্তুত ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সে সময় সে আহ্বান আমাদের ডানপন্থীরা বিশেষত ইসলামিস্টরা সঠিকভাবে শুনতে পাননি। তবে ধর্মহীনরা ঠিকই শুনতে পেয়েছিলেন। ফলে স্বভাবতই সে সময়ের নতুন প্রজন্ম যারা শৈল্পিক মননের অধিকারী তারা তাদের দিকেই ঝুঁকতে থাকে। আধুনিকতার মোড়কে তাদের মনে সামাজিক শালীনতার বোধ যেমন মুছে ফেলা হয়, তেমন শৈল্পিক ও নান্দনিক মননের মোড়কে শান্তিনিকেতনী চেতনার বীজ বুনে দেয়া হয়। সে বীজ থেকেই আজ বিশাল বৃক্ষের অবয়ব সৃষ্টি হয়েছে এবং মাতৃবৃক্ষ ছড়িয়ে দিয়েছে অসংখ্য বীজ। ফলে বিশাল বনাঞ্চল গ্রাস করেছে জনপদ। এ বনাঞ্চল সৃষ্টিতে ব্যবসায়ীদের টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র। শৈল্পিক, নান্দনিকতার টোপটিও যখন জাতীয়ভাবে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারল না তখন ব্যবসায়ীদের ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যবসায়ী ব্যবসা বোঝেন। ক্রেতার লাভ-ক্ষতি তার দেখার বিষয় নয়। সুতরাং জাতীয় এবং ধর্মীয় চেতনা তাদের বিবেচ্য বিষয় হবে না সেটা সহজ সমীকরণ। তাই নিজেদের স্বার্থেই জনগণকে সেভাবেই এ উৎসবের প্রতি সম্মিলিতভাবে আকৃষ্ট করেছে ব্যবসায়ীরা। কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে সর্বস্তরের ব্যবসায় বিপুল বাণিজ্য হচ্ছে এ উৎসবকে কেন্দ্র করে। ছোট-বড় সব ব্যবসায়ী এতে লাভবান হচ্ছে। ফলে এ উৎসব পালনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে তাদের প্রচেষ্টা থাকবেই। মিডিয়াও একই উদ্দেশ্যে বিপুল প্রচারণা চালিয়েছে। ফলে তাদের উদ্দেশ্য সফলতার মুখ দেখে।উৎসব প্রধানত ধর্মীয় ও জাতীয় হয়ে থাকে। আরেক রকম হয় প্রাতিষ্ঠানিক। তাই উৎসবের আচার-অনুষ্ঠানও সে কেন্দ্রিকই হয়ে থাকে। তাতে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরাও সে বিষয়সংশ্লিষ্ট হয়ে থাকেন। যেসব অনুষ্ঠান এর ব্যতিক্রম হয়ে থাকে তাকে অত্যন্ত নিম্নমানের গণ্য করা হয়। ইদানীং যেসব উৎসব হচ্ছে সার্বজনীনতার নামে তার একটিও ওই মানদণ্ডে উৎরায় না। এসব উৎসবের নেই কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য, প্রকৃত উদ্দেশ্য। নেই কোনো ফলাফল।
অর্থাৎ, এগুলো একটি বিশৃক্সক্ষল উন্মাদনা ছাড়া কিছুই নয়। এ ধরনের জগাখিচুড়ি অবস্থার সৃষ্টি করাটা তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার অসৎ উদ্দেশ্য ছাড়া আর কিছুই নয়।গত এক দশকে নববর্ষ একটি উন্মাদনায় রূপ নিয়েছে। দু’টি খুব সহজ সমীকরণ আছে। প্রথমত, সমাজ থেকে শালীনতাবোধ দূর করতে পারলে সাধারণের মন-মগজ থেকে ধর্ম এমনিতেই মুছে যাবে। তখন শূন্যস্থানে নতুন বীজ রোপণ করা সহজ এবং দ্বিতীয়ত, প্রজন্মকে বিনোদনে ডুবিয়ে রাখলে চিন্তাশক্তি আপনাতেই বিলীন হয়ে যাবে। ফলে রোম পুড়তে থাকলেও সে সুরের মূর্ছনায় অবগাহনে মত্ত থাকবে। বর্তমানে উৎসবের উন্মাদনায় এ নীতিরই বাস্তবায়ন চলছে। নববর্ষকে সার্বজনীন রূপ দেয়ার প্রচেষ্টা এবং সার্বজনীনতার মোড়কে মুসলিম ঐতিহ্য বিবর্জিত করে শুধু পৌত্তলিকতা জুড়ে দেয়াটা সে দিকেই ইঙ্গিত করে।
জাতিকে বারো মাসে তেরো পার্বণে ব্যস্ত রেখে চেতনাহীন, নিজস্ব বিবেচনাবোধহীন, মেরুদ-হীন করে ফেলা হচ্ছে। ইতিহাস বলে বেশির ভাগ জাতিকে ধ্বংস করার জন্য প্রতিপক্ষ এ পন্থার ব্যবহারই করেছে বারংবার। সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে যারা ভাবতে চান, অস্থিরতা দূর করে শান্তিময় নির্মল পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে চান, জাতিকে এগিয়ে নিতে চান তাদের এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে গভীরভাবে। অশ্লীলতার আমন্ত্রণ সর্বদা উপভোগ্য। তবে অজেয় অবশ্যই নয়। তার সাথে লড়তে হলে সে রকমই যোগ্য হতে হবে। বলিষ্ঠ হতে হবে।
লেখিকা : সমাজ ও মানব উন্নয়ন কর্মী