সিলেটের আঁকা বাঁকা পথে
রহিমা আক্তার মৌ: দেশের দক্ষিণাঞ্চলে নোয়াখালীতে জন্ম আমার। ছোট বেলাটা কেটে যায় ওখানেই। ১৬ বছর বয়সে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে স্বপ্নের শহর ঢাকায় চলে আসি। ১৮ বছর বয়সে এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করার পর বিয়ের পিঁড়িতে বসা। এরপর থেকে নোয়াখালী খুব একটা যাওয়া হয়নি। বিয়ে হয় উত্তর বঙ্গের কুড়িগ্রামে। বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই আছেন এই শহরে। ৪ ভাই বোনের মাঝে আমি ২য়। আমার ছোট দুই ভাই বড় ১ বোন। ৩ বছরের ছোট বড় ভাই টিপু তার পরিবার নিয়ে থাকে দেশের বাহিরে। প্রতি দু’বছর পর পর দেশে আসে ওরা।
নোয়াখালী ঢাকা আর কুড়িগ্রাম এই তিনটি জায়গা ছাড়া তেমন কোথাও যাওয়ার ভাগ্য হয়নি। টিপু দেশে আসার আগেই পরিকল্পনা হয় কোথায় যাব সবাই মিলে ঘুরতে। ২০১২ সালে সবাই মিলে যাই কক্সবাজার। খুব মজা হয়। পুরো ১৩ সদস্যের ঘুরে বেড়ানো। ২০১৫ সালের পুরো বর্ষার সময় টিপু তার পরিবার নিয়ে আসে দেশে। এবার আমাদের ভ্রমণের জায়গা ঠিক হয় সিলেটের আঁকা বাঁকা পথে।
এবার আমাদের ভ্রমণের সদস্য মোট ১২ জন আর দুই গাড়ির ড্রাইভারসহ ১৪ জন। মায়ের বাসা সাভারে, আমার বাসা তেজগাঁও, টিপুর শ্বাশুড়ির বাসা বনশ্রী। আপার বর থাকতেন নোয়াখালীর চাটখিলে। ছোট ভাইয়ের বউ কুমিল্লার মুরাদ নগর। এতগুলো জায়গা থেকে মানুষগুলো এক সাথে হওয়াই ছিল আনন্দের ব্যাপার।সকাল ৮টায় আপা ও ছোট ভাই অনয় সাভার থেকে রওয়ানা দেয় পাবলিক গাড়িতে। বৃষ্টি কাদা পথ পুরো রাস্তায় জ্যাম। সকাল ১০টায় ওরা আসে তেজগাঁও। এখানে সামান্য বিরতি নিয়ে ১০টা ১৫মিনিটে আমরা মাইক্রোগাড়ি নিয়ে বের হই বনশ্রী টিপুর শ্বাশুড়ির বাসায়। সেখান থেকে উঠে টিপুর পরিবারের ৫ জন। তখন আমাদের মাইক্রো কানায় কানায় ভর্তি। টিপু আগেই বলেছে কেউ বড় ব্যাগ নিবে না গাড়িতে জায়গা কম হবে। ব্যাগ ছোট করবে তাহলে সীটের নিচে রাখা যাবে। ছোট বললেই কি ছোট হয়। সিলেট ভেজার কত জায়গা। কাপড় তো বেশি করে নিতেই হবে। একি গাড়িতে মানুষের চেয়ে ব্যাগের সংখ্যা বেশি। সবাই গাড়িতে উঠার পর গাড়ি চলতে শুরু করে। বনশ্রী এলাকার রাস্তা গুলোতে ঘন ঘন স্পিড ব্রেক একটু পর পর গাড়ির পেছনের বাম্পার লেগে যায় রাস্তায়। কিছু দূর যাবার পর বাম্পারের একটা পাশ খুলে যায়। ড্রাইভার কামল গামছা দিয়ে ওটা বাঁধে। একটু সামনে যাবার পর আবার গামছা ছিঁড়ে যায়। টিপু বলে- তাহলে বাম্পারটা খুলে রাখাই ভালো। গাড়িটা পেছনে ব্যাক করে টিপুর শাশুড়ির বাসার সামনে। টিপু অয়ন ও ড্রাইভারসহ চেষ্টা করে বাম্পারের অন্য পাশ খুলতে। কিন্তু ওদিকটা খোলা যায় না। বাধ্য হয়ে দড়ি দিয়ে খুলে যাওয়া দিকটা আবার বাঁধা হয়। এবার চলতে শুরু করে। আবার সেই স্পীড ব্রেকে ঠক ঠক শব্দ। আমাদের টিমের বাকী সদস্যরা অপেক্ষা করছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। দুলাভাই ভোরে চাটখিল থেকে রওয়ানা দিয়ে আসে মুরাদ নগর। সেখানে ছোট ভাইয়ের বউ সুস্মিসহ গাড়িতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসবে। আমরা সেখানে গিয়ে এই গাড়ি থেকে কিছু সদস্য ওই গাড়িতে যাবে।
যাত্রাবাড়ির কাছে যাওয়ার পর মাইক্রোর বাম্পার আবার খুলে যায়। দূর থেকে দেখা যায় সামনেই একটা গ্যারেজ। আস্তে আস্তে গাড়িটা ওখানে নেয়া হয়। টিপু অনয় নেমে বাম্পার লাগানোর কথা বলে। কিন্তু এদের এখানে ভালো কাজ হবে না ভেবে থেমে থাকা গাড়ি চালাতে শুরু করে। হঠাৎ একটা চিৎকার। কি হলো কি হলো।
গাড়ি যখন থেমে ছিল একটা কুকুর এসে গাড়ির নিচে শুয়ে পড়ে। গাড়ি চলতে শুরু করলেই চাকার নিচে পড়ে কুকুরটি সাথে সাথেই মারা যায়। আশে-পাশের অনেক লোক জড়ো হতে থাকে। ক্রমে পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। টিপু কয়েকজন লোকে বুঝালো। মধ্যবয়সী একটা লোক এসে ড্রাইভারকে চড় মারে। আমরা জানি এখানে ড্রাইভারের কোন ভুল ছিল না। এরপর একটা লোককে কিছু টাকা দিয়ে অনয় বলে- ভাই কুকুরের দেহটা একটু ফেলে দিবেন। লোকটা তাই করে। কয়েকটা দোকান পরে আরেকটা গ্যারেজ দেখা যায়। ওরা বলে বাম্পার লাগাতে অনেক সময় লাগবে। বাধ্য হয়ে ওই দোকানে বাম্পারটা রেখে আমরা রওয়ানা দিই। তখন প্রায় সাড়ে ১২টা হবে। এদিকে সবার পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা, কেউ চিপস কেউ চকলেট বাদাম এগুলো খেয়েই যাচ্ছে। সুস্মি আর দুলাভাই অনেক আগেই গন্তব্যে এসে পৌঁছেছে। বৃষ্টির কারণে গাড়ি ঠিকভাবে চালানো যাচ্ছে না। তার উপর গাড়িতে অনেক লোক। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটা নামী-দামী হোটেলে আমাদের দুপুরের খাবার কথা। সেখানে যেতে যেতে তিনটা বেজে যায়। পুরো টিমের ১৪ জন সদস্য এক হই। অনেক গল্প হচ্ছে। হোটেলে খেতে বসে সেলফি তোলাও বাদ পড়েনি। দুই ড্রাইভার কামাল ও রাজুকে ৫শ টাকা দিয়ে অনয় বলে যাও তোমরা তোমাদের মতো খেয়ে নাও। রাজু টাকা নিয়ে খেতে যায়। কিসের দাম কত তা জিজ্ঞেস না করেই দু’জন খেতে বসেছে। জাতীয় মাছ ইলিশ আছে শুনে পছন্দের মাছটিকে হাতছাড়া করেনি দুই ড্রাইভার। খাওয়া শেষে বিল দিতে গিয়ে শুনে তাদের বিল হয়েছে ৭৫০ টাকা। চুপে চুপে রাজু উপরে আসে।
স্যার আরো ২৫০ টাকা লাগবে।
মানে, কি বলো, দু’জনের ৫শ’ টাকায় হয়নি।
স্যার আগে দিন পরে বলছি।
টিপু আরো ৩শ’ টাকা তুলে দিল রাজুর হাতে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা নিচে নামি সবাই মিলে মিষ্টি পান খাই। তখন রাজু বলে, আপা আমরাতো মাছের দাম জিজ্ঞেস করিনি। পরে দেখি দু’জনের বিল আসছে ৭৫০ টাকা। কথা শুনে সবাই সে কি হাসি। অত:পর রাজুকে বলি রাজু তুমি আজ এখানে শিখলে?
আপা তা আর বলবেন না, আর কখনো এই ভুল করব না। যেখানেই খেতে বসি আগে দাম শুনব তারপর খাব। আজ কামালেরও কিছু শিখা হয়েছে। সবাই বলে কামাল আবার কি শিখলো। আমি বলি- কখনো কোথাও গাড়ি থামালে এরপর গাড়ি চালানোর সময় আগে কয়েকবার হর্ন দিবে তারপর গাড়ি চালানো শুরু করবে। প্রয়োজনে গাড়ির নিচটা দেখে নিবে।
দুই ড্রাইভার বলে আসলে শেখার কোন শেষ নেই। প্রতিদিন নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করছি।
এবার দুই গাড়িতে সবাই ভাগ হয়ে বসে। গাড়ি চলতে শুরু করে সিলেটের পথে। কখনো এই গাড়ি আগে কখনো ওই গাড়ি আগে। দূর থেকে চা বাগান দেখলেও এই প্রথম কাছ থেকে চা বাগান দেখছি। চা বাগানের পাশে গাড়ি থামাতে বলি। দুটো গাড়িই থামানো হয়। কে আগে কে পরে ছবি তুলবে। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে মাত্র ১টা ছবি তুলি। আপা আর ভাইয়া যায় চা বাগানের ভিতরে। দুটো ছবি তোলার পরই আপা একটা জোঁক দেখতে পায়। অমনি দে ছুট। সবাই দৌড়ে এসে জামা কাপড় ঝাড়তে ঝাড়তে গাড়িতে উঠে বসে। আগে থেকে ঠিক করা আছে গেস্ট হাউস। আমরা মৌলভিবাজার কুলাউড়া সিআরপির গেস্ট হাউসে উঠব। এক সময় টিপু এখানকার দায়িত্বে ছিল। টিপু আমাদেরকে গেস্ট হাউসের অনেক গল্প শুনায়। অনেক ভয়ানক কথাও বলে। এখানে সাপ জোঁক আছে। তার উপর পাহাড়ি এলাকা এখানে অনেক হাওয়া বাতাস ভূত-পেঁতনির খবরও বলে। আমরা সবাই সেই ভয়ে ভয়ে থাকি। সন্ধ্যার পর প্রায় পৌনে ৮টায় আমরা পৌঁছাই। সবাই সবার রুম ঠিক করে নেয়। বড়বড় ৩টা বেড রুম। গেস্ট হাউসটা পাহাড়ের উপরে। রাতের বেলা তেমন বুঝতে পারিনি। গেস্ট হাউসে বিদ্যুৎ থাকলেও আশেপাশে অন্ধকার। এক এক করে সবাই ফ্রেস হচ্ছে। অনয় ওয়াশ রুমের সামনে সুস্মিকে দাঁড় করিয়ে ভিতরে যায়। নিজে ফ্রেস হয়ে বের হয়ে দরজায় দাঁড়ায় সুস্মি ভেতরে যায়। বিষয়টা না বুঝে বারান্দা থেকে অনয়কে খুব ডাকছি আমি। অনয় দৌড়ে আসে। সুস্মি ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে দেখে অনয় নেই। তখনি চিৎকার শুরু করে।
হৈ হুল্লোর আর হাসাহাসি চলছেই। ঘণ্টা খানেকের মাঝে সবাই ফ্রেস হয়ে ডাইনিং টেবিলে আসে। গরম গরম খাবার। খুব মজা করে সবাই রাতের খাবার শেষ করি। ডাইনিং টেবিলের পাশে ঝুলানো বড় একটা কলার ছড়া। যার যা ইচ্ছে নিচ্ছে আর খাচ্ছে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সবাই বসে ড্রয়িং রুমে। টিভি চলছে। ড্রয়িং রুমের এক পাশে সিআরপি’র প্রতিষ্ঠাতা ভেলোরি টেইলরের ছবি ঝুলানো। উল্লেখ করার বিষয় হলো মুক্তিযুদ্ধের পরপরই ভেলোরি টেইলর বাংলাদেশের আহত মুক্তিযুদ্ধাদের সেবা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশে আসেন। এখানেই থেকে যান। সাভারে ভেলোরি টেইলের প্রতিষ্ঠানের সিআরপি’র প্রধান কার্যালয়।
সকাল হলে কোথায় যাওয়া হবে তাই নিয়ে চলছে আলোচনা। দুই ভাই তাদের পরিচিত ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করছে। অতঃপর ঠিক হলো আমরা আগামী কাল বিছনাকান্দি আর রাতারগুল যাব। তবে সেই দিকের রাস্তা খুব খারাপ, নিজেদের গাড়ি নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। সেই সব জায়গায় যাওয়ার জন্যে মাইক্রো ভাড়া পাওয়া যায়। তবে তাই হবে। রাত ১২টার দিকে সবাই ঘুমাতে যাই। সকালে উঠেই বাইরে আসি। প্রকৃতির এই লীলাভূমি চোখে না দেখলে বুঝা কষ্টকর। পাহাড়ি এলাকা। অনেক উপরে আমাদের গেস্ট হাউজ। তারও উপরে আরেকটা। টিপুভাই আমাদের সব দেখাচ্ছে আর বলছে।
সকালের নাস্তা খেয়ে আমরা নিজেদের গাড়ি দুটো নিয়ে বের হই। খবর নেওয়া হয় সিলেট শহরের কুইন ব্রিজের পাশেই ভাড়া নেয়া সেই মাইক্রোগুলো পাওয়া যায়। কুইন ব্রিজ পর্যন্ত আমাদের গাড়িতে করে আসি। এরপর বড় একটা মাইক্রো ভাড়া করে আমরা রওয়ানা দিই বিছনাকান্দির পথে। বর্ষার দিন থেমে থেমে বৃষ্টিও হচ্ছে। রাস্তার অবস্থা এতটা খারাপ চিন্তাও করতে পারিনি। আমাদের দুই ড্রাইভার গাড়ির সাথে কুইন ব্রিজের ওখানেই থেকে যায়। একটা জায়গায় এসে গর্তের মাঝে গাড়ির চাকা আটকে যায়। অনেক বার চেষ্টা করেও কিছু হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে ছেলেরা নেমে পড়ে। ওরা গাড়িকে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে একটু উপরে উঠায়। প্রতিটি মুহূর্তই ছিল আমাদের কাছে অন্যরকম। বিছনাকান্দির পথের এক-তৃতীয়াংশ পথ যাবার পর ড্রাইভার বলে আর সামনে যাওয়া যাবে না। কিন্তু কেন?
আশপাশের লোকজন বলছে- রাস্তায় অনেক পানি উঠেছে গাড়ির চাকা ডুবে যাবে। এই রাস্তা দিয়ে গাড়ি নিয়ে গেলে যে কোন মুহূর্তে গাড়ি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অনেকে সেখান থেকে বড়নৌকা ভাড়া করে বিছনাকান্দি যাচ্ছে। আমাদেরকে যেতে বলল, কিন্তু তা সম্ভব ছিলো না। পুরো নদী ভরা পানি। তার উপর বৃষ্টি হচ্ছে। সবার মন খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু করার তো কিছু নেই। বাধ্য হয়ে গাড়িকে পেছনে ফেরাতে বলে।
এবার গাড়ি চলতে শুরু করে রাতারগুলের দিকে। গাড়িতে কেউ গল্প করে কেউ গান গায়, খুব মজা হচ্ছে। আমরা এসে যাই রাতারগুলে। তখন বৃষ্টি পড়ছে। গাড়ি যেই এসে থামলো অনেকগুলো ১০/১২ বছরের বাচ্চা ছাতা হাতে এসে দাঁড়ালো। কিছুটা অবাক হলাম। এরপর জানতে পারি এই বাচ্চারা ওদের ছাতা ঘণ্টা হিসাবে ভাড়া দেয় ঘুরতে আসা ব্যক্তিদের। কারণ সবার কাছে ছাতা থাকে না। আমরা কয়েকটা ছাতা নিই ওদের কাছ থেকে। এখানেও পানিতে টুইটম্বুর। রাতারগুলে নাকি সুন্দরবনের মতো অনেক কিছু দেখা যায়। কিন্তু নদীতে ভরা পানি দেখে নৌকা করে ওই দূরে জঙ্গলের ভিতর যেতে ভয় করছিল। শুরু হলো নানান কথা। কেউ যাবে কেউ যাবে না। আমি সরাসরি বলেছি রৌদ্র আর অভ্রকে যেতে দিব না। অতঃপর আমার দুইভাই। ছোট ভাইয়ের বউ, বড় ভাইয়ের ছেলে ও বড় ভাইয়ের শ্যালক। ওরা ৫ জন নৌকা ভাড়া করে ভেতরে যায়। আমরা বাকিরা এখানে নদীর পাড়েই থাকি।
ঘণ্টা খানেক পর ওরা ঘুরে আসে। সুস্মি ভেতরের অনেক ছবি তুলে আনে। নিচু নিচু গাছের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। ভেতরে সাপ কেঁচো অনেক জীব-জন্তুকে দেখতে পায়। রাতারগুল ঘুরে আমরা চলে আসি কুইন ব্রিজের কাছে। নিজেদের গাড়িতে উঠে খাবার হোটেল খুঁজি। তখন বিকেল সাড়ে ৪টা। সবাই সারাদিন হালকা খাবার খেয়ে আছি। আগেই বলা আছে আমরা এই দিন খাব সিলেটের নাম করা ৫ ভাই হোটেলে। সেভাবে ওখানে গিয়ে খাবার খেয়ে নিই। অনেক পদের ভর্তা ডাল ভাত মাছ মাংস।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আশপাশে একটু ঘুরে রওয়ানা দিই গেস্টহাউজের দিকে। তখন রাত ৮টা হবে। পুরো রাস্তা অন্ধকার। রাস্তার দুইপাশে সারি সারি গাছ।
আঁকাবাঁকা। এই ডানদিকে তো, আবার বাম দিকে। ভয়ও লাগছে। আমাদের ছোট গাড়িতে তখন দুই ভাই আর তাদের বউরা। বড় গাড়িতে আমরা অন্য সবাই। ভয় পেয়ে আবার ভয়কে দূর করার জন্যে ভয়ানক শব্দ করা হচ্ছে। এই ফাঁকে বুদ্ধি হলো যে ভয়ানক দৃশ্য ভিডিও করা যাক। আমরা তাই করি। একেক জন একেক ধরনের আওয়াজ করি তাই আবার ভিডিও করি দুই ভাইয়ের বউদের ভয় দেখানোর জন্য।
ওদিকে গেস্টহাউজ বারবিকিউ আয়োজন চলছে। সবাই গেস্টহাউজ গিয়ে ফ্রেস হয়ে বারবিকিউর জন্য তৈরি হচ্ছে। আমাদের দুই ড্রাইভার পাশে এক পুকুরে হাত-পা ধুতে যায়। দেখতে পায় ঘাটে সাদা সাদা পোশাক পরা কেউ অযু করছে। প্রথমে কামাল বলে চাচা আপনার বাসা কোথায়?
কোন জবাব নেই। শুধু অযু করেই যাচ্ছে। আবার রাজু বলে- চাচা আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন না। আপনার বাসা কি এই দিকেই।
কোন জবাব না পেয়ে অন্ধকারের মাঝে একে-অন্যের দিকে তাকায়। কিছু একটা বুঝতে পেরে দু’জন হাত ধরে দেয় দৌড়। দৌড়াতে দৌড়াতে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেস্টহাউজের সামনে। দুইজনের চোখ দেখেই বুঝা যায় খুব ভয় পেয়েছে। পরে সব খুলে বলে আমাদের।
এদিকে খাবার রেডি হয়। সবাই মিলে খেতে বসে আর সারা দিনের হিসাব করে। সকাল হলে কোথায় যাওয়া যাবে। মাধবকুণ্ড যাবার জন্য সবাই তৈরি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারে এদিকের রাস্তা কিছুটা ভালো। রাস্তায় পানি আছে তবে কম হবে। সবাই বাড়তি কাপড় নিয়ে যাবে। ওখানে গিয়ে ঝর্নার পানিতে নামবে। সব আলোচনা শেষ করে ১২টার দিকে সবাই ঘুমিয়ে পড়ি।
সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে আশপাশের চা-বাগানগুলো একটু দেখা হয়। আজই আমরা ঢাকার পথে রওয়ানা দিব। তার আগে মাধবকুণ্ড যাব। পরিকল্পনামতো সবাই বাড়তি পোশাক নিয়ে বের হই। মাধবকুণ্ডের পথ অনেকটাই ভালো ছিলো। ২/৩ জায়গায় পানি উঠলেও ছিল অল্প। এক এক করে ঝর্ণার পানিতে সবাই নামতে শুরু করে। একমাত্র আপা ছাড়া আর সবাই পানিতে নামে। আপা আমাদের ব্যাগ পোশাক পাহারায় বসে থাকে। ভেজা ভেজা শেষ করে কেউ কাপড় চেঞ্জ করে কেউ ভেজা কাপড়েই গাড়িতে উঠি। বেলা ২টায় আমরা গেস্ট হাউজ আসি। গোসল করে দ্রুত খাবার টেবিলে বসি। টিপু তাড়া দিচ্ছে যে করে হোক ৩টায় আমাদের বের হতে হবে। সেই ভাবে বের হই।
এখান থেকে কিছুতো নিয়ে যেতে হবে। কিছুদূর আসার পর একটা কাঁচা বাজার দেখতে পাই। আমি আর টিপু বাজার থেকে তিন ছড়া কলা, পান সুপারি, লেবুসহ বিভিন্ন জিনিস কিনে গাড়িতে উঠি। ছোট গাড়িতে অনয় ও তার বউ, আপা, ভাইয়া উঠে। অন্য গাড়িতে আমার পরিবার আর টিপুর পরিবার উঠি। অনয় ওর বউকে পৌঁছে দেয় মুরাদনগর। যাত্রাবাড়ী এসে নোয়াখালীর বাসে উঠে ভাইয়া। অনয় আর আপা সোজা চলে যায় সাভারে। আর আমরা প্রথমে যাই বনশ্রী। ওখানে টিপুদেরকে নামিয়ে দিয়ে রাত ১টায় আসি তেজগাঁও এলাকায়।
পুরো পরিবারকে নিয়ে এটাই ছিল আমাদের ২য় ভ্রমণ। টিপু আগেই বলে রেখেছে এরপর আসলে সবাই বান্দরবান, রাঙ্গামাটি যাওয়া হবে। রৌদ্র আর অভ্রকে বলে, এখন থেকে টাকা জমা করতে থাকো। দেখি কত টাকা জমাতে পারো। আমাদের এই দেশের প্রাকৃতিক দৃশ্য কতটা সুন্দর তা কাছে গেলেই বুঝা যায়। সব সময় টিভিতে চা বাগান, পাহাড়, ঝর্র্ণা এগুলো দেখেছি। কিন্তু নিজের চোখে দেশে এসে সত্যিই গলাছেড়ে বলতে ইচ্ছে করে এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি। আমার জন্মভূমি।